ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নব্য জেএমবি আগামী সপ্তাহেই নিষিদ্ধ হতে পারে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৯ এপ্রিল ২০১৭

নব্য জেএমবি আগামী সপ্তাহেই নিষিদ্ধ  হতে পারে

শংকর কুমার দে ॥ জঙ্গী সংগঠন ‘নব্য জেএমবিকে’ নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলা করে দেশ-বিদেশে আলোড়ন তোলা এই জঙ্গী সংগঠনটি নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন। গত ৪ বছর ধরে দেশে এই জঙ্গী সংগঠনটি ‘টার্গেট কিলিং’ করে আসছে। এই জঙ্গী সংগঠনটির প্রায় সবাই ‘আত্মঘাতী দলের সদস্য’, যার মধ্যে নারী উইং আছে, যারা জঙ্গী দম্পতি বলে পরিচিত। পুলিশ সদর দফতর থেকে এই জঙ্গী সংগঠনটি নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী সপ্তাহে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জঙ্গী সংগঠনটি নিষিদ্ধ করার ঘোষণা আসতে পারে। নব্য জেএমবি জঙ্গী সংগঠনটি নিষিদ্ধ করা হলে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনের সংখ্যা দাঁড়াবে আট-এ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নব্য জেএমবির জঙ্গী আস্তানা সিলেটের শিববাড়ি, মৌলভীবাজারে নাসিরনগর, বড়হাটে সর্বশেষ জঙ্গী বিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়। মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে জঙ্গী বিরোধী অভিযানে নব্য জেএমবির জঙ্গী, জঙ্গী দম্পতি ও শিশু সন্তানসহ অন্তত ১৪ জন নিহত হয়। এই জঙ্গী সংগঠনটি নিষিদ্ধ করার জন্য সুপারিশ করে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে জঙ্গী তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। জঙ্গী তদন্তকারী সিটিটিসির সুপারিশ করা প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই নব্য জেএমবি নামের দুর্ধর্ষ জঙ্গী সংগঠনটি নিষিদ্ধ করার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে আত্মপ্রকাশ করে ‘নব্য জেএমবি’। প্রথম দিকে সংগঠনটি মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক ও সিরিয়ায় জিহাদী পাঠানোর কার্যক্রম পরিচালনা করে। ২০১৪ সালের ২৯ জুন ইরাক-সিরিয়ায় আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) খেলাফত ঘোষণার পর মাঠে নামে নব্য জেএমবি। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে বিদেশী নাগরিক, ভিন্ন মতাবলম্বী ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের টার্গেট কিলিংয়ের মাধ্যমে একের পর এক হত্যা করে ভয়ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি করে এই জঙ্গী সংগঠনটির জঙ্গীরা। গত বছরের ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে দেশী-বিদেশী ২০ নাগরিক ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার পর নতুন করে আলোচনায় আসে নব্য জেএমবি নামের এই সংগঠনটি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি নিষিদ্ধ হওয়া জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি)। নিষিদ্ধ হওয়া জেএমবির একটি অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে নব্য জেএমবি। এখন আবার এই নব্য জেএমবি নামের জঙ্গী সংগঠনটিকেও নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। নব্য জেএমবি নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করার আগে নিষিদ্ধ করা হয় জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)। ২০১৫ সালের ৫ মার্চ নিষিদ্ধ করা হয় জঙ্গী সংগঠন এবিটি। ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর নিষিদ্ধ করা হয় হিযবুত তাহরিরকে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি-বি), শাহাদত-ই-আল হিকমা ও জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি) নামের জঙ্গী সংগঠনগুলো। নব্য জেএমবিকে নিষিদ্ধ করা হলে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনের সংখ্যা দাঁড়াবে ৮-এ। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, নব্য জেএমবিসহ জঙ্গী সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ করা হয় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ ধারায়। জঙ্গী সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ করার ফলে জঙ্গীদের বিরুদ্ধে আইনের বিভিন্ন ধারা প্রয়োগ ও শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে সুবিধা হয়। সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে নতুন করে সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম বাধার সম্মুখীন হয়। আর যদি নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনের সমর্থক হিসেবে কেউ সচেতনভাবে এই সংগঠনের কার্যক্রমকে সহযোগিতা করে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে সুবিধা পাওয়া যায়। নব্য জেএমবির জঙ্গী আস্তানাগুলোতে জঙ্গী বিরোধী অভিযানের সময়ে জঙ্গীদের আত্মসমর্পণ করার জন্য হ্যান্ড মাইকে আহ্বান জানানো হলেও তারা আত্মসমর্পণ না করে আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) একজন কর্মকর্তা জানান, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পর নব্য জেএমবির বিভিন্ন আস্তানায় ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত আছে। গুলশান হামলার পর থেকে গত ৯ মাসে নব্য জেএমবির অন্তত ১১টি আস্তানায় অভিযান চালায় সিটিটিসি। এসব জঙ্গী আস্তানায় নব্য জেএমবির অন্যতম মাস্টারমাইন্ড ও সামরিক কমান্ডার বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী, সারোয়ার জাহান ওরফে আবদুর রহমান, মেজর (অব) জাহিদ, তানভির কাদেরী, নুরুল ইসলাম মারজানসহ ৩৭ জঙ্গী নিহত হয়, যারা সবাই আত্মঘাতী দলের সদস্য। এছাড়াও নব্য জেএমবির জঙ্গী আস্তানায় অভিযানের সময় চট্টগ্রামের সীতাকু- ও মৌলভীবাজারে জঙ্গীরা আত্মঘাতী হওয়ার সময় মারা যায় পাঁচ শিশু। পুলিশের জঙ্গী বিরোধী অভিযান, বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় রাজধানী ঢাকার বাইরে বগুড়া ও অন্যান্য জেলায়ও নিহত হয়েছে নব্য জেএমবির জঙ্গীরা। গত ৯ মাসে নব্য জেএমবির কমপক্ষে অর্ধশতাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পাশাপাশি জঙ্গী বিরোধী অভিযানে অংশ নিয়ে নব্য জেএমবির অনেক জঙ্গী আস্তানায় হানা দিয়ে জঙ্গীদের গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। র‌্যাবের অভিযানে গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও আশুলিয়ার অভিযানে নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা সরোয়ার জাহান ওরফে মানিক ওরফে আব্দুর রহমানসহ পাঁচ জন নিহত হয়। এছাড়া, একাধিক অভিযানে অন্তত ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। যদিও র‌্যাবের পক্ষ থেকে গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের নব্য জেএমবির সদস্য না বলে সারোয়ার-তামিম গ্রুপের সদস্য বলা হয়। সিলেটের শিববাড়ির আতিয়া মহলে নব্য জেএমবির শীর্ষ জঙ্গী নেতা মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা নিহত হয়েছে বলে সন্দেহ করা হলেও বিষয়টি এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, নব্য জেএমবির জঙ্গী সংগঠনটির জঙ্গীরা এতই ভয়ঙ্কর যে তারা পরিবার পরিজন নিয়ে আত্মঘাতী হচ্ছে। টার্গেট কিলিংয়ের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে আত্মঘাতী হওয়া জঙ্গীদের দিয়ে গঠিত এই জঙ্গী সংগঠনটি। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারি থেকে সিলেটের শিববাড়ির আতিয়া মহল ও মৌলভীবাজারের নাসিরনগর ও বড়হাট জঙ্গী আস্তানায় এই জঙ্গী সংগঠনের জঙ্গী দমন অভিযানে পুলিশ, র‌্যাব, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, সোয়াট অংশগ্রহণ করেছে। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি ও সিলেটের শিববাড়ির আতিয়া মহলের নব্য জেএমবির জঙ্গী ঘাঁটিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের সহায়তায় সেনা বাহিনীর প্যারা কমান্ডো বাহিনীও অংশ নিয়েছে।
×