ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আরেক সোনালি অধ্যায়

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৯ এপ্রিল ২০১৭

আরেক সোনালি অধ্যায়

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরে তিস্তা চুক্তি না হলেও বাংলাদেশের কাক্সিক্ষত চুক্তিটির বিষয়ে নতুন আশা দেখিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দুই দেশের বিদ্যমান সরকারই এ জট খুলতে পারবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেছেন। এদিকে ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভারত আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করছে। এছাড়া দুই দেশের শীর্ষ বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় বাংলাদেশকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে ভারত। অপরদিকে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে সমর্থন দিয়েছে ভারত। শনিবার দিল্লীতে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের পর এসব জানানো হয়। শনিবার দিল্লীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দফতরে শীর্ষ বৈঠকে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি দুই দেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। বৈঠকে ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই ছাড়াও তিস্তা চুক্তি নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয়। এছাড়া দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে চারটি চুক্তিপত্র বিনিময় হয়। দুই দেশের মধ্যে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছেÑ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, সাইবার নিরাপত্তা, পরমাণু বিদ্যুত, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট ও মহাকাশ গবেষণা, ঋণ সহযোগিতা, বর্ডার হাট স্থাপন, কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন এবং বিদ্যুত ও জ্বালানি ক্ষেত্রে সহযোগিতা। চুক্তির আওতায় তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় বাংলাদেশকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে ভারত। গত ছয় বছরে তা আট বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হলো। সামরিক কেনাকাটায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে ভারত। ৩৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনে চুক্তি। আরও সীমান্ত হাট চালু করতে সমঝোতা স্মারক। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে সমঝোতা স্মারক। কলকাতা-খুলনা-ঢাকা বাস চলাচল এবং খুলনা-কলকাতা ট্রেন চলাচল, রাধিকারপুর-বিরল রেললাইন উদ্বোধন। এছাড়া আরও ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুত বাংলাদেশকে দেবে ভারত। দিল্লী সফরের ব্যস্ততম দিন শনিবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে একান্ত বৈঠকের পর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন শেখ হাসিনা। শীর্ষ বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী উল্লেখ করে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ভারত আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করছে। তারা অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। সঙ্গে আমরাও। হাসিনা বলেন, নরেন্দ্র মোদি ও আমি একটি কার্যকর বৈঠক করেছি। নতুন উচ্চতার বৈঠক হয়েছে। বাস ও খুলনা-কলকাতা ট্রেন সার্ভিস চালু ছাড়াও বৃহত্তর যোগাযোগের জন্য দু’দেশ কাজ করছে। হিন্দী ভাষায় অনূদিত বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর জন্য কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা পাট রফতানির বিষয়ে কথা বলেছি। দু’দেশের বিদ্যুত ও জ্বালানি নিয়ে কথা হয়েছে। যৌথ নদী ও এগুলোর পানিবণ্টন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। এ সময় মোদির বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনার জন্য ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা। এরপর বাংলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ১৪ এপ্রিল আমাদের বাংলা বছরের প্রথম দিন। আমি বাংলায় বলতে চাই, আগাম শুভেচ্ছা। আমাদের দু’দেশের যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, তা শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সহযোগিতা করেছে। এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, সব সময় ভারতবাসীর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় শহীদদের সম্মান জানাতে পারছি, এটা শুধু তাদের নয়, আমাদের জন্যও সম্মানের। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দীর্ঘজীবী হোক। সংবাদ সম্মেলনে তিস্তা চুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, দুই দেশের বিদ্যমান সরকারই এ জট খুলতে পারবে বলে তিনি আশাবাদী। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দফতর হায়দরাবাদ হাউসে মোদির এ ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেনÑ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও, যার কারণে দুই দেশের এ চুক্তি ঝুলে আছে ছয় বছর ধরে। তিস্তার জট কাটাতে নরেন্দ্র মোদির উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে শীর্ষ বৈঠকের এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত করা হয়। খুলনা-কলকাতা বাস ও ট্রেন উদ্বোধনে তাকেও সঙ্গে রাখেন মোদি। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিশ্রুতি এবং অব্যাহত প্রচেষ্টা সম্পর্কে আমি আপনাকে (শেখ হাসিনা) এবং বাংলাদেশের জনগণকে আশ্বস্ত করতে চাই। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আমার ও আপনার সরকারই তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধানে পৌঁছতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফর দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেবে উল্লেখ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, এ সফরের মাধ্যমে আমরা আরেকটি সোনালি অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে গেলাম, যা আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, অর্জন, অংশীদারিত্বকে আরও এগিয়ে নেবে। মোদি বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভারতীয় সেনাদের শ্রদ্ধা জানাতে আপনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা আমাদের গভীরভাবে ছুঁয়ে গেছে। আপনার দেশের পক্ষ থেকে দেয়া এ শ্রদ্ধা শহীদ পরিবারের সদস্যরা মনে রাখবে। মোদি বলেন, তিনি নিজের দেশকে যেমন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তেমনি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককেও। ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে ভারতের সমর্থন পাওয়ার কথাও জানান শেখ হাসিনা। দুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি যৌথভাবে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর হিন্দী সংস্করণ উন্মোচন করেন। অনুষ্ঠানে নয়াদিল্লীর পার্ক স্ট্রিট ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রোড’ উদ্বোধন করেন তারা। উচ্চপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে যৌথভাবে বিশেষ ক্ষেত্র তৈরি করতে তরুণ প্রজন্মকে যুক্ত করতে আলোচনা হয়েছে বলে জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, যৌথভাবে আমরা নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে চেয়েছি, বিশেষ করে হাইটেকনোলজির ক্ষেত্রে দু’দেশের তরুণ প্রজন্মকে যুক্ত করে। এছাড়া ইলেক্ট্রনিক্স, সাইবার সিকিউরিটি, সিভিল নিউক্লিয়ার এনার্জি ও অন্য খাত নিয়ে কথা হয়েছে। দু’দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে নতুন দিক উন্মোচন ও নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টির ব্যাপারে আলোচনায় একমত হয়েছেন বলে জানান মোদি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নতির ক্ষেত্রে ভারত সব সময় শুভাকাক্সক্ষী। উন্নয়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল ধরেই আমরা একে অপরের বিশ্বাসী বন্ধু। বাংলাদেশের মানুষকে বাংলায় নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রথমেই তিনি শেখ হাসিনাকে ভারত সফরের জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান। মোদি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আপনি এমন একটি সময় ভারত সফর করছেন, যে সময়টি পহেলা বৈশাখের ঠিক আগে। আমি বাংলাদেশের মানুষকে শুভেচ্ছা জানানোর এ সুযোগটি নিতে চাই। আমি তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, শুভ নববর্ষ। শনিবার সকালে রাষ্ট্রপতি ভবনে মোদির উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা নেয়ার পর রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিসৌধে ফুল দিয়ে হায়াদরাবাদ হাউসে যান শেখ হাসিনা। এরপর দুই প্রধানমন্ত্রীর একান্ত বৈঠকের পরপরই শীর্ষ বৈঠক হয়। বিকেল সাড়ে তিনটায় মানেকশ সেন্টারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর শহীদদের সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন তিনি। সন্ধ্যায় ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি মুহম্মদ হামিদ আনসারীর সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। রবিবারের সফরসূচী ॥ দিল্লী সফরের তৃতীয় দিন আজ রবিবার সকালে আজমির শরীফের উদ্দেশে যাত্রা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে মাজার জিয়ারত শেষে দুপুরে দিল্লী ফিরবেন প্রধানমন্ত্রী। সন্ধ্যা ৬টায় রাষ্ট্রপতি ভবনে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করবেন শেখ হাসিনা। সন্ধ্যা ৭টায় রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে রাষ্ট্রপতির দেয়া নৈশভোজে অংশ নেবেন তিনি। ভারতের রাষ্ট্রপতির দেয়া নৈশভোজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শুক্রবার দিল্লী গেছেন। চার দিনের সফর শেষে তিনি আগামীকাল সোমবার ঢাকায় ফিরবেন।
×