ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভালুকায় ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর’ চান আফসার বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৩১ মার্চ ২০১৭

ভালুকায় ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর’ চান আফসার বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ মুক্তিযুদ্ধ চলছে। ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চ পেরিয়ে এপ্রিলের মাঝামাঝি। হঠাৎই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি। মাত্র একটি অস্ত্র নিয়ে ‘আফসার বাহিনী’র পথচলা। প্রতিরোধের শপথ। দেশ মাতৃকার টানে একের পর এক দলে যোগ দিতে থাকেন মুক্তিকামী মানুষ। অল্প সময়ের মধ্যেই সাড়ে চার হাজার অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধার এক বিরাট বাহিনী গড়ে ওঠে। মূলত ২৫০ কোম্পানির সমন্বয়ে বাহিনী গঠন হয়। প্রতিটি কোম্পানিতে ছিল তিনটি প্লাটুন ও তিনটি সেকশন। আর প্রতি সেকশনে ছিল ১৫ মুক্তিযোদ্ধা। একে একে ১৫০ যুদ্ধে অংশ নেয় এই বাহিনী। এছাড়াও এ বাহিনীর সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা ছিল অন্তত ছয় হাজার। বাহিনীপ্রধান আফসার ৭৫ যুদ্ধে অংশ নেন। এ বাহিনীর সবচেয়ে বড় যুদ্ধ ছিল একাত্তরের ২৫ জুন। সেদিন ভাওয়ালিয়াবাজু সম্মুখযুদ্ধে ৯৫ পাক সেনাকে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে ‘আফসার বাহিনী’র ৪৭ সদস্য শহীদ হন। ময়মনসিংহ সদর দক্ষিণ ও ঢাকা সদর উত্তর রণাঙ্গনের ১১ নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর আফসার উদ্দিন। তিনিই বিশাল এই বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা। ৭৬৫ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে ছিল এ বাহিনীর আধিপত্য। মুক্তিযুদ্ধের ৪৬ বছর চললেও এ বাহিনীর কথা এখনও ভালুকার মানুষের মুখে মুখে। যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাদের অনেকেই এখনও বেঁচে আছেন। ভালুকায় বাহিনীপ্রধান আফসার উদ্দিনের নামে একটি ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর’ নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধারা জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের আট ডিসেম্বর ভালুকা মুক্ত হয়। এ দিন মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে কমান্ডার রিয়াজের নেতৃত্বে রাজাকার ধরপাকড় শুরু করে। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় ৩১ রাজাকারের কান কেটে দেয়া হয়েছিল সেদিন। কান কাটা রাজাকারদের অনেকেই এখনও বেঁচে আছে। কমান্ডার রিয়াজ জানান, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এখনও চোখে ভেসে ওঠে। ভালুকা মুক্ত হওয়ার আগে থেকেই আমরা স্থানীয় রাজাকারদের ভূমিকা মেনে নিতে পারিনি। তাই ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের ধরে ধরে কান কেটে দেয়া হয়েছিল। আফসার বাহিনীর সদস্য শাহজাহান মিয়া বলেন, রাজাকারদের যেন এলাকাবাসী চিনতে পারে এই চিন্তা থেকেই তাদের কান কেটে দেয়া হয়। রাজাকারদের যেন সারাজীবন মানুষের ঘৃণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকতে হয় তাই এমন শাস্তি দেয়া হয়েছিল। তিনি জানান, অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও বাহিনীর অন্তত ছয় হাজার সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তারা বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন। ভালুকা এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে ১৬ জন করে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা কাজ করতেন বলে জানান তিনি। আফসার উদ্দিনের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। যুদ্ধ শেষে ১৯৪৮ সালে বাড়ি চলে আসেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বিভিন্ন এলাকার মতো ভালুকায়ও প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ওই প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েন আফসার উদ্দিন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তিনি প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মাত্র সাতজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মল্লিকবাড়ী গ্রামে আফসার উদ্দিন একটি ‘ব্যাটালিয়ন’ গঠন করেন। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা, কর্মদক্ষতা ও সাফল্যের জন্য আফসার উদ্দিনকে মেজর পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সানথ সিং বাবাজী। আফসার বাহিনীকে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে মেজর আফসার বাহিনী হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়া হয়। আফসার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার প্রয়াত গাজী মোঃ খলিলুর রহমান জাগ্রত বাংলায় এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত হানাদার বাহিনী অনেক চেষ্টা করেও আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় প্রবেশ করতে পারেনি। কাশিগঞ্জ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর আফসার বাহিনীর ৭৬৫ বর্গমাইল এলাকার দখল প্রতিষ্ঠিত হয়।’ বাহিনীপ্রধানের গল্প ॥ আফসার উদ্দিনের জন্ম ১৯২৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। পৈত্রিক নিবাস ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার চাউলাদি গ্রামে। নানাবাড়ি ছিল ভালুকা উপজেলার ধামশুর গ্রামে। ১৯৯৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। আফসার উদ্দিনের ছেলে ভালুকার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কাজিম উদ্দিন আহমেদ ধনু বলেন, তাদের পরিবারে ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার এক ভাই শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধা আরও তিন ভাই জীবিত আছেন। তারা হলেন কোম্পানি কমান্ডার গাজী খলিলুর রহমান, প্লাটুন কমান্ডার গাজী খোরশেদ আলম ও শওকত আলী। বাহিনীর সদস্যদের অনেকই জানান, আফসার উদ্দিনের নামেই পরিচিত এ বাহিনী অস্ত্র সংগ্রহ, প্রশিক্ষণসহ সব কাজই সেরেছে দেশের ভেতর। শত্রুদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তা দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করেন তারা। এ বাহিনী ভালুকা, ত্রিশাল, ফুলবাড়িয়া, গফরগাঁও, শ্রীপুর, জয়দেবপুর, মীর্জাপুর, কালিয়াকৈরসহ আশপাশের বেশ কিছু এলাকায় মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য এলাকার মানুষের কাছে কিংবদন্তিতে পরিণত হন আফসার উদ্দিন। মুক্তিযুদ্ধে নিজ সন্তানকেও হারিয়েছেন তিনি। শুরুর কথা ॥ মুক্তিযোদ্ধারা জানিয়েছেন, শুরুর দিকে ভালুকা থানার রাজৈ গ্রামের আওয়ামী লীগের কর্মী মোঃ আবদুল হামিদ মিঞার কাছ থেকে একটি রাইফেল ও ৩১ রাউন্ড গুলি সংগ্রহ করেছিলেন আফসার উদ্দিন। বাহিনী গঠনে সাহায্য করেছিলেন মাওলানা আলী ফকির, ডাঃ হাফিজ উদ্দিন, মোঃ আবদুর রাজ্জাক মিয়া, আবদুল হাফিজ, মোঃ মোছলেম মিঞা ও প্রেমনাথ অধিকারী। একাত্তরের ২০ জুন চানপুর এলাকার ইপিআর সদস্যদের ফেলে যাওয়া সাতটি রাইফেল দখলে এলে আফসার বাহিনীর মনোবল আরও বেড়ে যায়। আফসার উদ্দিন আহমেদের ভাষায়, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণ শিবির গঠন করেছি এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর ইপিআর-আনসার-মোজাহিদদের ভেতর থেকে বাঙালিদের অনেকেই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসে আমার সংগঠিত বাহিনীতে যোগ দিতে থাকেন। কয়েক দিনের মধ্যেই ৫০০ মুক্তিযোদ্ধার এক বাহিনী গড়ে তুললাম। ধীরে ধীরে দেশের ভেতরই অবস্থান নিয়ে বন্ধু দেশ ভারতের কোন সাহায্য ছাড়াই চার হাজার ৫০০ অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধার এক বিরাট বাহিনী গড়ে তুলি। ’ জনতা ও ছাত্ররাই সংখ্যায় বেশি ছিলেন ॥ আফসার বাহিনীতে স্থানীয় জনতা ও ছাত্ররাই সংখ্যায় বেশি ছিলেন। তবে কিছু আনসার, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর লোকও ছিলেন। ওই বাহিনী পরিচালিত হয় সেনাবাহিনীর কায়দায়। তার বাহিনী ছিল ২৫ কোম্পানির সমন্বয়ে। প্রতিটি কোম্পানিতে ছিল তিনটি প্লাটুন ও তিনটি সেকশন। আর প্রতি সেকশনে ছিলেন ১৫ জন করে মুক্তিযোদ্ধা। আফসার ‘ব্যাটালিয়নে’র অধিনায়ক ছিলেন মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদ। সহকারী অধিনায়ক ছিলেন পাঁচজন। তাদের মধ্যে দুজন শহীদ হয়েছেন। এ ছাড়া এ্যাডজুট্যান্ট, সিকিউরিটি অফিসার, সহ-সিকিউরিটি অফিসার, কোয়ার্টার মাস্টার, অফিস ইনচার্জ প্রভৃতি দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়। পাশাপাশি ১০ সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা পরিষদ, বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ ছিল। জুন মাসের মাঝামাঝি নাগাদ ভালুকা সদর ও মল্লিকবাড়ী বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল এ বাহিনীর। দীর্ঘদিন প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু ছিল রাজৈ ইউনিয়নের খুর্দ্দ গ্রামে। বীরত্বগাথা ॥ একটি সেক্টরের মধ্যে যেন আরেকটি সেক্টর ছিল আফসার বাহিনীর। প্রতিটি যোদ্ধা ছিলেন অকুতোভয়। দেশপ্রেমিক। তারা একে একে ১৫০ যুদ্ধে অংশ নেন। ২১ মে ভালুকা থানা আক্রমণ করে ১৬ রাইফেল, ৩০ বেয়নেট ও এক হাজার ৬০০ রাউন্ড গুলি ছিনিয়ে আনে আফসার বাহিনী। ২৫ জুন ভাওয়ালিয়াবাজু সম্মুখযুদ্ধ সম্পর্কে জানা যায়, ১৫ শতাধিক পাকিস্তানী সেনার একটি দল তিন ভাগ হয়ে ভালুকা থানায় ঘাঁটি করার জন্য গফরগাঁও থেকে রওনা দেয়। তাদেরই একটি দলকে আফসার উদ্দিন ৪১ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সকাল ৮টার দিকে ভাওয়ালিয়াবাজু বাজারের ঘাটে প্রতিরোধ করেন। মুক্তিসেনারা মাত্র দুটি এলএমজি ও ৩৭টি রাইফেল দিয়ে যুদ্ধ শুরু করেন। অবিরাম ৪৮ ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। পাকিস্তানী সেনাদের সহায়তা করতে যুদ্ধ চলাকালে সেখানে হেলিকপ্টার থেকেও সেনা নামানো হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আঃ মান্নান শহীদ হন। স্মৃতিতে ভালুকা যুদ্ধ ॥ আফসার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার (ঝালপাজা ভালুকা) গাজী মোঃ চান মিয়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ১৯৭১ সালের সাত ডিসেম্বর আমাদের অধিনায়ক আফসার উদ্দিন আহমেদের নির্দেশনায় টু. আই. সি মজিবর রহমান ও প্লাটুন কমান্ডার আঃ গফুর মাস্টারের সহযোগিতায় ৩২জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ভোরে ভালুকার পূর্ব-দক্ষিণ থেকে ডিফেন্স নিয়ে পাকসেনাদের বৃহত্তর ঘাঁটি ভালুকা আক্রমণ করি। ত্রিমুখী আক্রমণের যুদ্ধ অধিনায়ক নিজেই পরিচালনা করেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উভয়পক্ষের মধ্যে গুলিবর্ষণ চলে। এ যুদ্ধে ২২ পাকসেনা ও ২৪ রাজাকার নিহত ও বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যায় অধিনায়কের নির্দেশে আমরা নিরাপদ স্থানে চলে যাই। ওই রাতেই হানাদার বাহিনী আলবদর, আলশামসের সহযোগিতায় ভালুকার আশা ত্যাগ করে গফরগাঁওয়ের উদ্দেশে হেঁটে রওনা দেয়। আট ডিসেম্বর ভালুকাবাসী হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ॥ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র এর নবম খ-ে আফসার বাহিনী সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা রয়েছে। ৪৬৪ পৃষ্ঠায় ‘আফসার ব্যাটালিয়ান’ শিরোনামে লেখার শুরুতে বলা হয়েছে- ‘ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা থানার নিভৃতপল্লী মল্লিকবাড়ি গ্রামে একটিমাত্র রাইফেল নিয়ে মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদ সাহেব পার্টি গঠন করেন। পাকবাহিনী ও দুষ্কৃতকারীগণের সঙ্গে লড়াই করে মেজর আফছার সাহেব শত্রুদের সমুচিত শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি তার পার্টি নিয়ে শত্রুপক্ষের নিকট থেকে আড়াই হাজারেরও অধিক রাইফেল ব্রেটাগান, রকেটলঞ্চার, স্টেনগান, এমএমজি ইত্যাদি উদ্ধার করেন। তার দ্বারা পরিচালিত বাহিনীতে সর্বমোট সাড়ে চার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল।’ দলিলপত্রে আরও বলা হয়, স্বাধীনতা সংগ্রামে গ্রাম্য রক্ষীবাহিনী এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, অকৃত্রিম সেবাযন্ত্র এবং অসীম ভালবাসার উপর ভিত্তি করেই আফসার ব্যাটালিয়ন সফলতার চরম শিখরে ওঠে। বিশেষ করে বাটাজুর, কচিন, ডাকাতিয়া, পাঁচগাঁও, কাওলামারী, রাজৈ, ফুলবাড়িয়া, আমিরাবাড়ী, নারাঙ্গী, বড়ইদ, দক্ষিণ ফুলবাড়িয়া ও কালিয়াকৈর এলাকায় রক্ষীবাহিনী স্বাধীনতা সংগ্রামে যে ভূমিকা পালন করেছে তা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ ‘...ওপার বাংলা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসার বেশ কিছুদিন আগেই পাকবাহিনীর নিকট থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিনিয়ে এনে মেজর আফসার উদ্দিন তার পরিচালিত মুক্তিদলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলেন। তিনি ১৯৭১ সালের জুন মাসে ভালুকা থানার ভাওয়ালিয়াবাজু এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে একটানা ৪৮ ঘণ্টা সম্মুখযুদ্ধ করে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। তিনি শপথ করেছিলেন- দেশকে শত্রুমুক্ত না করা পর্যন্ত অস্ত্র ত্যাগ করবেন না। আমার যদি মৃত্যু হয় তাহলে যেন মুক্ত এলাকাতেই হয়’। দলিলে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘বর্বর বাহিনী শত চেষ্টা করেও আফসার ব্যাটালিয়ন কর্তৃক মুক্ত এলাকায় প্রবেশ করতে পারেনি। আফসার সাহেব শপথ করেছিলেন, জীবিত থাকতে মুক্ত এলাকায় শত্রুদের প্রবেশ করতে দেব না।’ এ বাহিনীর যুদ্ধের ইতহাস থেকে আরও জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৮ জুন ভালুকা থানায় গ্রেনেড হামলা করে ১৭ হানাদারকে খতম করে এ বাহিনী। ১৯ জুলাই সিডস্টোর যুদ্ধে ২৩ পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। এ ছাড়া ডাকাতিয়া-আংগারগাড়া বাজার যুদ্ধ, ভায়াবহ ঘাটের যুদ্ধ, ভরাডোবা যুদ্ধ, ধামশুর গ্রামের যুদ্ধ, বাকশী নদীর ব্রিজের পাড় যুদ্ধ, বরাইদ যুদ্ধ, বান্দিয়া যুদ্ধ, তালার যুদ্ধ, চানপুর যুদ্ধসহ অনেক যুদ্ধে অংশ নিয়ে পাকিস্তানী সেনাদের খতম করে এ বাহিনী। ৬ ডিসেম্বর ভালুকা সদরে সেনা ক্যাম্প আক্রমণ করে ২০ পাকিস্তানী সেনা ও অনেক রাজাকারকে হত্যা করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর পাড়াগাঁও জঙ্গলে যুদ্ধে আফসার উদ্দিনের তৃতীয় ছেলে নাজিম উদ্দিন আহত হলে তাকে শেষ পর্যন্ত কলকাতা নিয়ে গিয়েও বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ভালুকা ছাড়াও গফরগাঁও এবং ত্রিশালের একাধিক স্থানে যুদ্ধ করে আফসার বাহিনী। ১৭ জুলাই গফরগাঁওয়ে দেউলপাড়া টহল ট্রেন আক্রমণ করে আফসার বাহিনী। এ ছাড়া মশাখালী রেলওয়ে ফরচঙ্গী পুলের পাড় যুদ্ধ, শীলা নদী আক্রমণ, প্রসাদপুর যুদ্ধে অংশ নেয় এ বাহিনী। গফরগাঁও পাকিস্তানী বাহিনীর ঘাঁটিতে ৯ ডিসেম্বর আক্রমণ করে তা দখলে নিয়ে নেয় আফসার বাহিনী। ত্রিশালের কানিহারী গ্রাম, সাকুয়া গ্রাম, ধানীখলা কাঁঠাল, কালীবাজার গ্রামেও আগস্ট মাসে অপারেশন চালায় আফসার বাহিনী। ১৩ সেপ্টেম্বর রায়ের গ্রামে সাত ঘণ্টা স্থায়ী ভয়াবহ সম্মুখযুদ্ধে ১৬ পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। খতম হয় পাঁচ রাজাকার। তবে ১০ মুক্তিযোদ্ধাও এতে শহীদ হন। ২৬ অক্টোবর কাশিগঞ্জ-আমিরাবাড়ী যুদ্ধে ৬৫ রাজাকারকে খতম করা হয়। আটক করা হয় ১৭ জনকে। ১০ ডিসেম্বর ত্রিশাল সেনা ক্যাম্প আক্রমণ করে তা দখল করা হয়। উদ্ধার হয় প্রচুর অস্ত্র। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতালও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আফসার। এ হাসপাতালে যুক্ত ছিলেন ১৩ চিকিৎসক ও তিন নার্স। মানুষের চেতনা শাণিত করে রাখার জন্য যুদ্ধকালে ‘জাগ্রত বাংলা’ নামের সাইক্লোস্টাইল করে একটি পত্রিকা বের করতেন আফসার। আফসার বাহিনীর উপদেষ্টা পরিষদের অফিস ইনচার্জ হাফিজুর রহমান বলেন, মুক্তিযুদ্ধে আফসার বাহিনীর ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি জানান, যুদ্ধ শেষে তাদের ২৫টি কোম্পানি ময়মনসিংহ শহরের তৎকালীন রাবেয়া মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুলে (বর্তমান গালর্স ক্যাডেট কলেজ) জমায়েত হয়। বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছে আফসার বাহিনী প্রায় চার হাজার অস্ত্র সমর্পণ করে। হাফিজুর আরও জানান, যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য খেতাব প্রদানের জন্য ৪০ জনের তালিকা দেয়া হয়েছিল সরকারের কাছে। কিন্তু আমলে নেয়া হয়নি। তবে যে তিনটি বাহিনীকে সরকার ও মিত্রবাহিনী স্বীকৃতি দিয়েছিল তার মধ্যে কাদেরিয়া বাহিনী ও হেমায়েত বাহিনীর পাশাপাশি মেজর আফসার বাহিনী ছিল। জাগ্রত বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত লেখায় আফসার উদ্দিনের স্ত্রী শহীদ মাতা বেগম খায়রুন নেছা আফসার বলেন, মাত্র একটি রাইফেল দিয়ে বাহিনীর যাত্রা শুরু হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দুই হাজার ৩০০ বেশি অস্ত্র আমরা সরকারের কাছে জমা দিয়েছিলাম। পাঁচটি ব্যাটালিয়ন ও ২৯টি কোম্পানির এই দলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল চার হাজারের বেশি। লেখাতে তিনি আরও উল্লেখ করেন, বাহিনীর আলোড়ন সৃষ্টিকারী অপারেশন ছিল ‘ভাওয়ালিয়াবাজু’ য্দ্ধু। যুদ্ধের শুরু থেকেই ব্যাপক এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসায় অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের নির্দেশনায় মুক্তি এলাকায় বিভিন্ন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। জাগ্রত বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত আবুল কালামের লেখার বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর দখলকৃত এলাকা থেকে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কোন প্রকার পত্র-পত্রিকা বের করা ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। সামরিক বিধিতে তখন ঘোষণা করা হয়েছিল, কেউ যদি কোন প্রকার প্রচারপত্র, দেয়াল লিখন, কিংবা পত্রিকায় পাক বাহিনীর বর্বরতার খবর কিংবা ইঙ্গিত পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কিছু ছাপে তবে তার শাস্তি সাত বছর সশ্রম কারাদ- অথবা মৃত্যুদ-। কাজেই এ ঝুঁকিটা নেয়া ছিল অত্যন্ত দুঃসাহসের কাজ। যুদ্ধের সময় নানা প্রতিকূলতার মধ্যে আফসার বাহিনীর মুখপাত্র ‘জাগ্রত বাংলা’ প্রকাশিত হতো। আফসার বাহিনীর সদস্য মোঃ শাহজাহান মিয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধে মেজর আফসার উদ্দিন আহমদের অবদানের কথা এলাকার মানুষ কোন দিনই ভুলতে পারবে না। এখন ভালুকা এলাকার মানুষের মুখে মুখে এই বাহিনীর নাম। তিনি বলেন, আমাদের স্বপ্ন হলো সকলে মিলে আফসার বাহিনীর নামে ভালুকায় একটি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা। যেখানে এই বাহিনীর পক্ষে অংশ নেয়া সদস্যদের নাম, বাহিনী গঠনের ইতিহাস, দলিলপত্র, অস্ত্র, পোশাক-পরিচ্ছদসহ সবকিছুই স্থান পাবে। এই স্বপ্ন পূরণের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যত প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বাহিনীর নাম স্বরণ রাখবে।
×