ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

লাইসেন্স বাতিল করা হবে ॥ ডিজি

খোলা বাজারে প্যারাকুয়েট বিক্রি

প্রকাশিত: ০৪:২০, ৩১ মার্চ ২০১৭

খোলা বাজারে প্যারাকুয়েট বিক্রি

এমদাদুল হক তুহিন, খাগড়াছড়ি থেকে ফিরে ॥ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে খোলাবাজারে আগাছানাশক প্যারাকুয়েট বিক্রি থেমে নেই। আইন অমান্য করে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ২০০ লিটারের ড্রামে করে খুচরা বিক্রিতাদের কাছে প্যারাকুয়েট সরবরাহ করছেন। তারপর তা তেলের মতো মেপে মেপে বিক্রি হচ্ছে লিটারে! শুধু তাই নয়, বিভিন্ন কোম্পানির সরবরাহ করা এসব ড্রামে কোরেসিন মিশিয়ে দোকানে দোকানে পৌঁছে দিচ্ছেন দুর্নীতিগ্রস্ত ডিলাররা। এতে প্যারাকুয়েটের কার্যকরী মাত্রা কমে যাওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়ছেন কৃষক। অথচ ড্রাম থেকে মেপে মেপে প্যারাকুয়েট বিক্রি হওয়া দোকানেই খোশগল্পে মেতে উঠছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা! তাদের চোখের সামনে আইন অমান্য করে খোলাবাজারে প্যারাকুয়েট বিক্রি হচ্ছে। এতে হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য, একই সঙ্গে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে। কৃষক, ডিলার ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জুম চাষের আগে পাহাড়ের আগাছা পোড়াতে প্যারাকুয়েট ব্যবহৃত হয়। প্রতি ২ লিটার প্যারাকুয়েটে ১ একর জমির আগাছা পরিষ্কার হয়। আর লিটার প্রতি প্যারাকুয়েটের দাম ৩০০ টাকা। সে হিসেবে ২ একর জমির আগাছা পরিষ্কারে ৬০০ টাকা খরচ হয়। অথচ শ্রমিক ব্যবহার করে একই জমির আগাছা পরিষ্কারে খরচ পড়ে প্রায় ২ হাজার টাকা। মূলত এ কারণেই পাহাড়ী এলাকায় প্যারাকুয়েটের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরাও এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তারা ড্রামে করে সরবরাহ করা প্যারাকুয়েট বিক্রি করছেন। জানা গেছে, বোতলজাত প্যারাকুয়েটের তুলনায় ড্রামে করে সরবরাহ করা প্যারাকুয়েটের দাম লিটার প্রতি মাত্র ১০ টাকা কম পড়ছে। অল্প সাশ্রয়ের আশায় কৃষক ড্রামে করে সরবরাহ করা প্যারাকুয়েট ক্রয় করছেন। কৃষকের অসচেতনতা ও অসাধু ব্যবসায়ীদের অধিক লাভের আশায় জনস্বাস্থ্যকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে হুমকির মুখে। খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি, মাটিরাঙ্গা, মহালছড়ি, পানছড়ি উপজেলায় ঘুরে দেখা গেছে, কীটনাশকের প্রতিটি দোকানে ঢুঁ দিলেই বের হয়ে আসছে খোলাবাজারে বিক্রি হওয়া প্যারাকুয়েটের উৎকট গন্ধ। অঞ্চলটির অধিকাংশ দোকানেই ড্রামে করে প্যারাকুয়েট বিক্রি হচ্ছে। ২০ মার্চ জেলার পানছড়ি উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার মেসার্স এ বি ট্রেডার্সে প্রকাশ্যেই ড্রামে করে প্যারাকুয়েট বিক্রি হচ্ছে। দোকানের ঠিক সামনেই রাখা ছিল প্যারাকুয়েটের ২০০ লিটারের ড্রাম। এ সময় কথা হয় দোকান মালিক উল্লাস কান্তি দের সঙ্গে। তিনি বলেন, খোলাবাজারে প্যারাকুয়েট বিক্রি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। অন্যরা বিক্রি করছে, তাই আমিও বিক্রি করছি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তার দোকানে কৃষি কর্মকর্তারা প্রায়শই আসেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলাউদ্দিন শেখ সন্ধ্যার পর এই দোকানে খোশগল্পে মেতে উঠেন। অথচ এই দোকানে দিনদুপুরে খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে প্যারাকুয়েট! একইভাবে এই জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার প্রায় সবকটি দোকানে খোলাবাজারে প্যারাকুয়েট বিক্রি হচ্ছে। মাটিরাঙ্গা বাজারের খালেক স্টোরের কবির হোসেন জানান, বাজারের ১১টি দোকানের প্রায় সবকটিতেই ড্রামে করে সরবরাহ করা প্যারাকুয়েট বিক্রি হচ্ছে। মের্সাস আব্দুল হাকিম স্টোরে কর্মরত মোঃ ইয়াসিন জানান, মাটিরাঙ্গার মতো পানছড়ি, দীঘিনালা ও মারিশ্যায় খোলা বাজারে প্যারাকুয়েট বিক্রি হয়। একই বাজারে ৮ বছর ধরে কীটনাশকের ব্যবসা করেন আক্তার হোসেন (৩৫)। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এক সময় বাধ্য হয়ে খোলাবাজারে প্যারাকুয়েট বিক্রি করেছি। নিষিদ্ধ থাকায় এখন খোলাবাজারে প্যারাকুয়েট বিক্রি করি না। তবে কয়েকজন দোকানির ভাষ্য, তার দোকানে বাদে সব দোকানেই খোলাবাজারে প্যারাকুয়েট বিক্রি হচ্ছে। কয়েকজন বিক্রেতার তথ্যমতে, খাগড়াছড়ির আবুল কালাম আজাদ এই জেলার সবচেয়ে বড় ডিলার। বিভিন্ন উপজেলার বাজারগুলোতে তিনিই ড্রামে করে প্যারাকুয়েট সরবরাহ করেন। মাটিরাঙ্গার মতো একাধিক উপজেলার খুচরা ব্যবসায়ীও একই ধরনের অভিযোগ করেন। তবে অভিযোগের সত্যতা অস্বীকার আলিফ ট্রেডাসের প্রোপ্রাইটার মোঃ আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে আমি যদি অপরাধী হই, তাহলে যে শাস্তি হবে তাই মাথা পেতে নেব। খাগড়াছড়ি সদরের ভাইবোন ছড়া বাজারের মের্সাস কাজল ট্রেডার্সের প্রোপ্রাইটার কাজল বড়ুয়া (৩৬) বলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা ড্রামে করে যখন প্যারাকুয়েট সরবরাহ করে তখন এর সঙ্গে কেরোসিন মিশিয়ে দেয়। মাইসছড়ি উপজেলার মাইসছড়ি বাজারের সাঈদ স্টোরের সাইদুর রহমান বলেন, পূর্বে খোলাবাজারে প্যারাকুয়েট বিক্রি হতো, গত বছর আমিই ২০০ লিটারের ২০ ড্রামের মতো প্যারাকুয়েট বিক্রি করেছি। তবে এ বছর এখনও বিক্রি শুরু হয়নি। এ প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক তরুণ ভট্টাচার্য জনকণ্ঠকে বলেন, খোলাবাজারে প্যারাকুয়েট বিক্রি বন্ধে আমরা সার্বক্ষণিক মনিটরিং ও তদারকি করছি। কোনক্রমেই যাতে খোলাবাজারে প্যারাকুয়েট বিক্রি না হয় সে ব্যাপারে ডিলারদের নির্দেশ দিয়েছি। কারণ যে কোন কীটনাশকই খোলাবাজারে বিক্রি নিষিদ্ধ। অথচ জেলার সর্বত্রই খোলাবাজারে প্যারাকুয়েট বিক্রি হচ্ছে এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা বলেন, আমি তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখব। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্লান্ট প্রোটেকশন উইংয়ের পরিচালক মোঃ গোলাম মারুফ জনকণ্ঠকে বলেন, যে কোন আগাছানাশক ও কীটনাশক খোলা অবস্থায় বিক্রি করা আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আইন অমান্য করে খোলাবাজারে প্যারাকুয়েট বিক্রি বন্ধে উদ্যোগ নিচ্ছি। প্রতিটি জেলা-উপজেলা অফিসের কর্মকর্তাদের সতর্ক করে দিয়েছি, তা বন্ধে নির্দেশ দিয়েছি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অভিযোগের ভিত্তিতে যখন যে এলাকায় যাচ্ছি সে এলাকায় গিয়ে দেখা যাচ্ছে খোলাবাজারে প্যারাকুয়েট বিক্রি বন্ধ রয়েছে। আমরা যাওয়ার আগেই তারা খবর পেয়ে যাচ্ছে, সেজন্য কাউকে হাতে নাতে ধরা যাচ্ছে না। সামগ্রিক প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোঃ মনজুরুল হান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, কোন অবস্থাতেই খোলাবাজারে প্যারাকুয়েট বিক্রি হওয়ার কথা নয়। কোন কোম্পানিই আইনের বাইরে যেতে পারে না। তারপরও যারা ড্রামে করে প্যারাকুয়েট সরবরাহ করছে তাদের লাইসেন্স বাতিলের উদ্যোগ নেয়া হবে।
×