ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

দেশের কোন অঞ্চলের লোকই অলস নয় ॥ দরকার সুযোগ সৃষ্টি

প্রকাশিত: ০৪:১০, ৩১ মার্চ ২০১৭

দেশের কোন অঞ্চলের লোকই অলস নয় ॥ দরকার সুযোগ সৃষ্টি

প্রশ্ন তোলা হয়েছে রাজশাহীর মানুষ কী অলস, না তাদের কর্মসুযোগ কম (একটি কাগজের শিরোনাম : ৩. ৩. ১৭) প্রশ্নটিকে আরেকটু বড় করা যায়। রাজশাহী অর্থে কী উত্তরাঞ্চলের মানুষই অলস, কর্মবিমুখ? তারা কী কৃষিকে নিয়েই থাকতে চায়? এই প্রশ্নটি বিবেচনা করার আগে পাকিস্তানের (১৯৪৭-৭১) অভিজ্ঞতার কথা বলি। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশ অঞ্চলের লোকদের সম্পর্কে বেশ ভাল একটা প্রচার ছিল। বলা হতো এই অঞ্চলের লোকেরা অলস, কর্মবিমুখ। এই অঞ্চলের লোক মানে আজকের বাংলাদেশ অঞ্চলের লোক। বলা হতো এরা কৃষিজীবী, কৃষি নিয়েই থাকতে চায়। এদের কর্মক্ষমতাও কম। এদের লেখাপড়া কম। এরা গল্পপ্রিয়, আড্ডাবাজ। এদের পুঁজি নেই, শিল্পের অভিজ্ঞতা নেই। অফিস চালানোর ক্ষমতা নেই। আরও কত সব অভিযোগ! বলাই বাহুল্য, ধারণার সৃষ্টি করা হয় বাঙালীদের দিয়ে কিছু হবে না, এরা শাসিত থাকতে চায়। এসব অভিযোগের প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালের বাংলাদেশকে বিচার করলে কী মনে হয়? মনে হয় কী বাঙালী কাজ জানে না, কর্মবিমুখ? আজ বাংলাদেশের অর্থনীতি পাকিস্তানের অর্থনীতি থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। পাকিস্তানের ‘জিডিপি’ ১৫-১৬ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৭ শতাংশ হারে। সেইস্থলে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের ওপরে। তাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ সর্বশেষ হিসাবে ২২ বিলিয়ন ডলার। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ বর্তমানে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। আমাদের বাংলাদেশী ‘টাকা’ পাকিস্তানের ‘রুপির’ তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। খুবই বড় কথা, বাংলাদেশ এখন চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ। পাকিস্তান আমলের খরা, দুর্ভিক্ষাবস্থা, মঙ্গা ইত্যাদি থেকে বাংলাদেশ আজ সম্পূর্ণ মুক্ত। সামাজিক সূচকগুলোতেও বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। শিক্ষার হার, শিশুমৃত্যুর হার, মাতৃমৃত্যুর হার, সুপেয় জল, পয়ঃনিষ্কাশনের সুবিধা, গড় আয়ু থেকে শুরু করে যাবতীয় সূচকে আমরা পাকিস্তান থেকে অগ্রগামী। এমনকি অনেক সূচকে আমরা ভারত থেকেও অগ্রগামী, যার কথা ভারতীয় নেতারাই উল্লেখ করেন। আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি পাকিস্তান থেকে। বাংলাদেশের নেতৃত্ব, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব সারা বিশ্বে প্রশংসিত। এই যে অবস্থা এর থেকে কী মনে হয়? মনে হয় কী একটি কর্মবিমুখ, অলস জাতি এই অগ্রগতি সাধন করেছে? মনে হয় কী বিনা গুণে বাঙালী জাতির এই অর্জন? পাকিস্তানীরা যে অপপ্রচার চালাত তার কী কোন ভিত্তি ছিল বলে আজ মনে হয়? বলা বাহুল্য, আমরা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছি বাঙালীরা কর্মবিমুখ জাতি নয়, বরং কঠোর পরিশ্রমী জাতি। ওপরের উদারহরণটি দিলাম রাজশাহী বা উত্তরাঞ্চলকে বোঝার জন্য। ভুল বললাম, আসলে বোঝার জন্য সমগ্র বাংলাদেশের অনুন্নত অঞ্চলকে। বাঙালীর অর্জন কথাটা গৌরবার্থে। সবাই মিলে আমরা অর্জন করেছি বর্তমান অগ্রগতি। কারও কম, কারও বেশি। বর্তমান অর্জন ও অগ্রগতির মধ্যেও বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল পিছিয়ে। পিছিয়ে থাকার দিক থেকে যেমন ঢাকার পাশেই অর্থাৎ রাজধানী লাগুয়া কিশোরগঞ্জ জেলা, নেত্রকোনা জেলা, জামালপুর জেলা, শেরপুর জেলার লোকেরা ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লার চেয়ে পিছিয়ে। এমন যে সিলেট যার কথা মুখে মুখে। যেমন সিলেটি মানেই ‘লন্ডনী’ তার মানেই ধনী। সিলেটের মাটির নিচে তেল-গ্যাস, মাটির ওপরে চা বাগান এবং কয়েক লাখ সিলেটি লন্ডন-আমেরিকা প্রবাসী ও সবাই ডলার-পাউন্ড রোজগার করে বেশ ভাল পরিমাণেই। এতদসত্ত্বেও সিলেটের ভাটি অঞ্চলের অনেক মানুষের সংসার চলে না, লেখাপড়া নেই। ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রামের পাশের লোকেরই যখন এই অবস্থা, তা হলে দূরের লোকের কী অবস্থা? রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের অসুবিধা আরও বেশি। এরা আমাদের ভাত জোগায় সত্যি; কিন্তু অন্য কিছুতে নেই। এদের কয়জন বিদেশি চাকরি করে দেশে ডলার পাঠায়? এদের কয়জন দেশের বড় চাকরিতে আছে? এদের কয়জন বড় ডাক্তার, বড় উকিল, বড় ব্যবসায়ী, বড় ব্যাংকার, বড় অর্থনীতিবিদ, বড় এ্যাকাউন্ট্যাট? এসবের হিসাব আমার কাছে নেই। কারও কাছে আছে বলে আমার জানা নেই। যাওয়া যাক আরও দক্ষিণে কুষ্টিয়া বা যশোর, যশোর অথবা খুলনা, খুলনা অথবা বরিশাল বলা যায় পদ্মার ওই পারের সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কুমিল্লার বড়ই পার্থক্য তৈরি হচ্ছে। ‘জিডিপি’ বাড়ছে। এতে কার অবদান কত? কারও কাছে কী হিসাব আছে? মনে হয় না। আমদানি-রফতানিতে বিভাগওয়ারি অবদানের হিসাব কোথায় পাওয়া যায়? চাকরিতে কোন্্ অঞ্চলের লোকের অংশগ্রহণ কত, কার কাছে এর হিসাব আছে? বাংলাদেশের যত সম্পদÑ শিল্পসম্পদ, ফিন্যান্সিয়াল এ্যাসেট, হাউজিং সম্পদ এর ভাগ কোন্্ অঞ্চলের লোকের কত? এসবের হিসাব কোথাও হয় না। হিসাব হলে স্পষ্টতই বোঝা যেত দেশে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। লোকে লোকে যেমন বৈষম্য হচ্ছে, ধনী-দরিদ্রে যেমন বৈষম্য হচ্ছে, তেমনি অঞ্চলে অঞ্চলেও বৈষম্য হচ্ছে। তাই নয় কী? দেশের শ্রেষ্ঠ ধনীদের বিভাগওয়ারি একটা বণ্টন করলে কী চিত্র পাওয়া যাবে? চিত্র সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু দৃশ্যত তো বোঝাই যাচ্ছে শ্রেষ্ঠ ধনীদের মধ্যে কোন কোন অঞ্চলের প্রাধান্য বড়ই দৃষ্টিকটু। কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদধারী রাজশাহী-রংপুরে কয়জন? এর একটা হিসাব তো সরকার বের করতেই পারে। করাই উচিত। উচিত, কারণ আমরা ‘স্বাধীনতা অর্জনে যুদ্ধ করেছি বৈষম্য দূর করতে। ‘ছয় দফা’ বৈষম্যের বিরুদ্ধে দলিল ছিল না কী? যদি তাই হয় তাহলে অঞ্চলে অঞ্চলে বৈষম্য তৈরি কেন হবে? আর বৈষম্য তৈরি হওয়ার পর যদি আমরা বলি রাজশাহী-রংপুর অঞ্চলের লোকেরা কর্মবিমুখ, অলস- তাই তাদের উন্নতি হচ্ছে না, তাহলে কী এই অবস্থানটা সঠিক হলো? কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুর, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের দরিয়া অঞ্চলের লোকেরা কী কর্মবিমুখ? বরিশালের গলাচিপার লোকেরা কী কর্মবিমুখ ও অলস? খুলনার লোকেরা কী অলস, না ‘পার্টিশনের’ পববর্তী ঘটনার শিকার? প্রকৃত বিচারে কোন অঞ্চলের লোককে কর্মবিমুখ, অলস বলাটা একটা অবিচার ছাড়া কিছুই হবে না। আসলে প্রশ্নটি সুযোগের সঙ্গে জড়িত। সমান সুযোগই সমাজে সমতা আনতে পারে। একজন মন্ত্রী যদি তার ক্ষমতা ব্যবহার করে শুধু তার অঞ্চলেই উন্নয়নমূলক কাজ করেন তাহলে তা তো সমান সুযোগের অবস্থা হয় না। রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের কয়টা লোক বিদেশে চাকরি করে? কেন এটা হলো? অথচ আমরা জানি বিদেশে চাকরিরতদের ‘রেমিটেন্স’ কত বড় সম্পদ। এই রেমিটেন্স গ্রামের চেহারা বদলে দিচ্ছে। মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করছে, শিক্ষার আলো দেখাচ্ছে। তার সাংস্কৃতিক অবস্থানে পরিবর্তন আনছে। যদি তাই হয় তাহলে ওই অঞ্চলের লোকও যাতে বিদেশে চাকরি পায় তার একটা ন্যায্য ব্যবস্থা করতে রাষ্ট্র অকৃতকার্য হবে কেন? ব্যাংক ঋণের কথাই ধরা যাক। আমরা জানি সুষ্ঠুভাবে বণ্টনকৃত ঋণ কার্যক্রম মানুষের জীবনে কত বড় পরিবর্তন আনতে পারে। ব্যাংক সারাদেশে কত বড় বড় ধনীলোক সৃষ্টি করেছে, কত লোককে ‘ক্যাপিটেল’ গঠনে সহায়তা করেছে তার কোন হিসাব নেই। রাস্তা থেকে তুলে এনে অনেক লোককে ব্যাংক শত কোটি টাকার মালিক বানিয়েছে। ব্যাংক কত লোককে আমদানিকারক ও রাফতানিকারক বানিয়েছে তার হিসাব নেই। এটাই ব্যাংক ঋণের গুণ। কই উত্তরাঞ্চলের, পদ্মার ওই পারের লোকের ভাগ্যে এই ‘প্রসাদ’ পড়ল না কেন? এখানেই অসমতা, অসাম্য, বৈষম্যের অভিযোগ। এখানেই সমান সুযোগের কথা ওঠে। ‘লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ড’ দরকার। কোন অঞ্চলের মানুষই অলস নয়, সবাই কর্মঠ। ভাবা যায়, গাইবান্ধার একজন রিক্সাওয়ালা কী কঠোর পরিশ্রম করে ঢাকায় রিক্সা চালায়? সবাই শ্রম দিতে চায়। সবারই যার যার লাইনে মেধা আছে। শুধু দরকার সুযোগ দিয়ে ওই মেধাকে কাজে লাগানো। ক্ষমতার ধারেকাছে থাকাই যদি মেধা হয় এবং সেই মেধাই যদি ভাগ্যকে খুলে দেয় তাহলে আনুকূল্যের ঝুড়িতে সকল অঞ্চলের লোককে যুক্ত করতে হবে। এছাড়া উপায় নেই। সুযোগ মরা মানুষকে পর্যন্ত জীবন্ত করে ফেলে। শুনেছি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি নাকি ছিলেন হাসপাতালে- অসুস্থ। যেই খবর এলো দেশের এক নম্বর ব্যক্তি হতে হবে, তখন তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ শপথ নেয়ার জন্য। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×