ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

মিয়ানমারের রত্নপাথরের নেশায়

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২৯ মার্চ ২০১৭

মিয়ানমারের রত্নপাথরের নেশায়

মিয়ানমারের জেড পাথর এক মূল্যবান সম্পদ এবং সে দেশের জিডিপির এক বড় উৎস। কিন্তু এ পাথরের সঙ্গে মিশে আছে শোষিত-বঞ্চিত মানুষের ঘাম ও শ্রম, রক্ত আর মৃত্যুর করুণ ইতিহাস। ভারত ও চীন ভূখ-ের মাঝখানে হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত মিয়ানমারের কাচিন রাজ্য হলো জেড পাথরের মূল্যবান আধার বা খনি। জেড পাথর এক ধরনের সবুজাভ পাথর। এটি আসলে সোডিয়াম এ্যালুমিনিয়াম সিলিকেটের স্বচ্ছ খ- যা জেডেইট নামে পরিচিত। এটি বিশ্বের অন্যতম আকাক্সিক্ষত রতœখনি। বিশেষ করে চীনাদের কাছে এর দারুণ কদর। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় এ পাথরেরও বিক্রি বেড়ে রেকর্ড ছাড়িয়েছে। অন্যদিকে আছে তিন লাখ জেড পাথর সংগ্রাহক যারা দেশান্তরী শ্রমিক। ভূমিধস, মাদক ও রোগব্যাধিতে তাদের জীবন হুমকির মুখে। এ মূল্যবান পাথরের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বর্মী সামরিক বাহিনীর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা কোম্পানি, চীনা কোম্পানি, জাতিগত বিদ্রোহী কমান্ডার ও মাদক চোরাচালানকারীদের একটি নেটওয়ার্ক। চীনে স্বর্গীয় পাথর নামে পরিচিত এ জেড পাথর বর্মী সামরিক বাহিনী ও জাতিগত কাচিন গেরিলাদের মধ্যকার গৃহযুদ্ধে ইন্ধন যুগিয়ে আসছে। চীনারা যত নামেই এ পাথরকে আখ্যায়িত করুক, মিয়ানমার জনগণের কাছে জেড পাথরের গায়ে রয়েছে রক্তের দাগ। খুব কম দেশের অর্থনীতি একটি মাত্র সম্পদের সঙ্গে এমনভাবে আবদ্ধ, যেমনটি রয়েছে মিয়ানমারের সঙ্গে জেড পাথরের। ২০১৪ সালে দেশটির এ পাথরের বাণিজ্য হয়েছে ৩১০০ কোটি ডলার, যা কিনা ওই বছরের জাতীয় জিডিপির প্রায় অর্ধেক। তথাপি এ শিল্পকে ঘিরে এক ধরনের রহস্যজাল জড়িয়ে আছে। কাচিন জনগোষ্ঠী জেড পাহাড় অঞ্চলের আদি অধিবাসী। অথচ তাদের নিয়ন্ত্রণে জেড খনির সংখ্যা হাতেগোনা। কাচিন রাজ্যে বেশকিছু সশস্ত্র কাচিন গোষ্ঠী স্বাধীনতার জন্য লড়ছে। তার একটি হচ্ছে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেস আর্মি (কেআইএ)। এদের জেড খনিসমৃদ্ধ বেশকিছু ভূখ- হাতছাড়া হয়ে গেছে। জেড খনির ক্ষেত্রে বড় ধরনের ছাড় বা সুবিধার আজ বেশিরভাগই পাচ্ছে বর্মী সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত কোম্পানি বা কৃপাপ্রার্থীরা। খনি থেকে আহরিত বেশিরভাগ জেড পাথর প্রতিবেশী চীনে পাচার হয়ে যায়। যৎসামান্য অংশের ওপরই কেবল ট্যাক্স বসে এবং সে অর্থ এশিয়ার দরিদ্রতম একটি দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়। এ ব্যবসায় ঘুষ-দুর্নীতি এত ব্যাপক যে, আধুনিক ইতিহাসে প্রাকৃতিক সম্পদের বৃহত্তম চোরাচালান বলা যেতে পারে। বৃহত্তম গোষ্ঠীর চাপে পড়ে মিয়ানমারের বর্তমান সরকার এ শিল্পে কিছু কঠোর বিধিনিষেধ বলবত করার উদ্যোগ নেয়ায় কাচিনের হাপাকান্ত এলাকার জেড পাথর দ্রুত আহরণের প্রতিযোগিতা জোরদার হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ আশঙ্কা করছে, জেড পাথর এত দ্রুত আহরিত হচ্ছে যে, এ সম্পদ ২০ বছর কী ১০ বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। সেটা গেল এক দিক। অন্য দিকটা হলো জেড খনি শিল্পে নিয়োজিত মানুষগুলোর অবর্ণনীয় দুর্দশা। খনিতে কায়িক শ্রমে নিয়োজিতারা মানবেতর পরিবেশে প্রচ- ঝুঁকির মধ্যে বাস করে। জেড খনিতে দুর্ঘটনা হামেশাই লেগে আছে। তাতে মৃত্যু ঘটছে। গত ১৫ নবেম্বর ভূমিধসে প্রায় ২শ’ খনি শ্রমিক প্রাণ হারায়। গত দেড় বছরে জেড খনিতে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় কয়েক শ’ শ্রমিক মারা যায় বলে সরকারী হিসাব থেকে জানা গেছে। তবে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা এর কয়েকগুণ হবে বলে ধারণা করা হয়। দুর্ঘটনা ছাড়াও আছে যুদ্ধ। বর্মী সেনা ও কাচিন বিদ্রোহীদের মধ্যে মাঝেমধ্যেই যুদ্ধ চলে। জেড পাথর না থাকলে কাচিনে কোন যুদ্ধ হতো না। বর্মা এক পুলিশী রাষ্ট্র। আবার একই সঙ্গে কিছু কিছু অঞ্চলে বিশেষত কাচিনের জেড খনি অঞ্চলগুলোতে অরাজকতার শেষ নেই। এমন হত্যাকা- নিয়মিত ঘটে যার কোন ব্যাখ্যা মেলে না। সেখানে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। এক ধরনের বুনো পশ্চিমের পরিবেশ সেখানে বিরাজমান। জেড খনির নিয়ন্ত্রণ দখল নিয়ে লড়াই চলে বর্মী সেনা ও কেআইএ’র মধ্যে। আর তার মধ্যে লাখ লাখ শ্রমিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আহরণ করে চলে এ পাথর। সেজন্য অবশ্য তাদের দু’পক্ষকেই করের নামে চাঁদা দিতে হয়। মৃত্যুঝুঁকি আছে, দুর্ঘটনার ঝুঁকি আছে। তারপরও তারা নেশার মতো এ কাজে লেগে থাকে। কারণ তাদের চোখে স্বপ্ন থাকে বড়লোক বনে যাওয়ার। হয়ত তারা কোন এক বন্ধুর কাহিনী শুনেছে যে, জেড পাহাড়ে কাজ করতে করতে রাতারাতি বিপুল বিত্তের মালিক বনে গেছে। শোনা এ কাহিনী জেড পাথর শ্রমিকদের কাছে স্বপ্নই থেকে যায়। বাস্তবে আর ধরা দেয় না। মাঝখান থেকে বৈরী ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে করতে তারা নানান রোগব্যাধির শিকার হয়, ড্রাগের নেশায় আসক্ত হয়। এক হিসাবে দেখা গেছে, ৭৫ থেকে ৯০ শতাংশ জেড পাথর শ্রমিক হেরোইনের নেশায় আসক্ত। অমানুষিক পরিশ্রমের পর এ ড্রাগ নিয়েই তারা স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকে যে, একদিন তাদের সব কষ্টের অবসান হবে। রাতারাতি হয়ে উঠবে বড়লোক। সূত্র : টাইম
×