ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাহিদ রহমান

তেজস্বী ফুটবলার অলোকের কথা মনে আছে?

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ২৯ মার্চ ২০১৭

তেজস্বী ফুটবলার অলোকের কথা মনে আছে?

সত্তর আর আশির দশক ছিল ঢাকার ফুটবলের সবচেয়ে স্বর্ণালী সময়। সেই স্বর্ণালী যুগে মোহামেডান আর আবাহনীর হয়ে যারা খেলতেন তাঁদের নাম যেন নিমিষেই দারুণ মুগ্ধতায় ছড়িয়ে পড়ত টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত। তাঁদের ঘিরে ফুটবলমোদী আর ক্লাব সমর্থকদের বিস্তৃর্ণ স্বপ্ন রচিত হতো। সেই স্বর্ণালী সময়ের এক তেজস্বী ফুটবলারের নাম অলোক। মোহামেডান আর আবাহনী দু’ ক্লাবেই যারা সমান দাপটে খেলেছেন অলোক তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন। ঝাঁকড়া চুল আর সুঠাম দেহের এই ফুটবলার আশির দশকে নিজ ক্লাবের সমর্থকদের কাছে ভীষণ রকম নন্দিত ছিলেন রাফ এ্যান্ড টাফ ফুটবলের কারণে। অলোক রাইট ব্যাক আর হাফ পজিশনে খেলেছেন সারাজীবন। অনেকেরই হয়ত মনে থাকার কথা অলোক মাঠে থাকলে যে কোন বাঘা স্ট্রাইকারেরই বল নিয়ে তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে মারিয়ে যাওয়াটা একটু কঠিনই ছিল। কারও কারও মাঝে অলোক ভীতিও কাজ করত। শুধু ঘরোয়া লীগে আবাহনী আর মোহামেডান নয়, বেশ বড় এক সময় জুড়ে জাতীয় দলের জার্সি গায়েও খেলেছেন। তবে ফুটবলে মূল সূচনাটা ছিল তার রহমতগঞ্জ ক্লাবের হয়ে। মাঠে যতদিন ছিলেন ততদিন অলোক আলোই ছড়িয়েছেন। ফুটবলে তাঁর নামটাও তাই স্বর্ণাক্ষরেই লেখা আছে। ঢাকার মাঠের সেই তেজদীপ্ত ফুটবলার অলোকের কথা ফুটবলমোদীদের হৃদয়জমিন থেকে মুছে যাওয়ার কথা নয়। এখনও ফুটবলে সৌরভ ছড়ায় তার নাম। কিন্তু ফুটবলের পুরো দৃশ্যপট থেকেই বহু দূরে চলে গেছেন অলোক। ফুটবলের সঙ্গে সামান্যও সংশ্লিষ্ট না থাকার কারণে অনেক আগেই তিনি যেন চোখের আড়ালে চলে গেছেন। অথচ ফুটবল মাঠের তাঁর বন্ধু, সতীর্থরা মাঠ থেকে অবসর নিয়ে অফিসিয়াল বা কোচ, ম্যানেজার হয়ে ফুটবলের মাঝে জীবন্ত থাকলেই অলোক সে পথে হাঁটেননি। আর এ কারণে ফুটবলের কোন উৎসবেই কখনই তাঁকে পাওয়াও যায় না, দেখাও যায় না। অথচ এ দেশের ফুটবল ইতিহাসে তিনিও অনন্য একজন। ফুটবলের সোনালী অধ্যায়ের তিনিও এক কুশীলব। অলোকের পুরো নাম নাজির আহমেদ। তাঁর পৈত্রিক ভিটা বরিশালের বাকেরগঞ্জে হলেও জন্ম ঢাকাতেই। শৈশব কৈশর কেটেছে তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়াতে। স্কুলে পড়াকালীন সময়ে এ্যাথলেটিক্সের প্রতিই বেশি ঝোঁক ছিল তার। শারীরিক গড়নটাও ছিল সেরকম। আর তাই তেজগাঁওয়ের ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল স্কুল এ্যান্ড কলেজে পড়ার সময় ক্যান্টমেন্টের শাহীন স্কুলে যান এ্যাথলেটিক্সে অংশ নিতে। সে সময় ফুটবল কোচ বজলুর রহমানের নজরে পড়েন তিনি। কোচ বজলুর রহমানই তার শারীরিক গঠন দেখে প্রথম তাকে ফুটবল খেলতে উৎসাহিত করেন। সেই উৎসাহ পেয়ে এবং কোচ বজলুর রহমানের সহায়তায় ৭৪ সালের দিকে দ্বিতীয় বিভাগের ফুটবল দল কামাল স্পোটিং ক্লাবে নাম লেখান। কোচের পরামর্শে ওই ক্লাবের হয়ে বুয়েট মাঠে নিয়মিত অনুশীলন শুরু করেন। কামাল স্পোটিং ক্লাব তখন দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগের দল। পরের বছরই দ্বিতীয় বিভা ফুটবল রীগে খেলা শুরু করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এসে ভর করে। ৭৭ সালে পা ভেঙ্গে ইনজুরিতে পড়েন। অবশ্য পরের বছর ভাগ্যকপাটটা খুলে যায়। মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবের সেই সময়কার দুর্দান্ত ফুটবলার মঞ্জু তাকে মোহামেডানের স্পোটিং ক্লাবের সঙ্গে অনুশীলনের সুযোগ করে দেন। সময়টাকে ভালই কব্জা করেন তিনি। পরের বছর ৭৯ সালে মোহামেডানে দলভুক্ত হন। সে সময় এরকম মোহামেডানে দলভুক্ত হওয়া মানেইতো নাম ছড়িয়ে পড়া। সে বছর বদলি খেলোয়াড় হিসেবে ব্রাদাসের বিপক্ষে মাত্র একটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান। নিজেকে মেলে ধরতেও ব্যর্থ হন। মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবের কোচ আশারাফের মন ভরাতে না পারার কারণে নিজেই মোহামেডান স্পোটিং ক্লাব ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। যথারীতি প্রিয় অগ্রজ তুখোড় ফুটবলার মঞ্জুর সঙ্গে রহমতগঞ্জ ক্লাবে যোগ দেন। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ্যাপেনডিসাইটে আক্রান্ত হন। অবশ্য অপারেশন শেষে সুস্থ হয়ে ফিরে এসে বেশ ভালই খেলেন। রহমতগঞ্জে খেলা দিয়েই কোচ, ম্যানেজারের নজর কাড়তে সক্ষম হন। এবার মোহামেডান থেকে অফান আসে। ৮২ সালে ফের মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবে যোগ দেন। এরপর নাজির আহমেদ অলোককে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। কোচ গোলাম সারওয়ার টিপুর তত্ত্বাবধানে সতীর্থ হিসেবে আবুল, ইউসুফ, টিপু, সালামকে পান। দু’ মৌসুম মোহামেডানে কাটাতেই অলোক আবাহনীর নজরে পড়েন। ৮৪ সালে আবাহনীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে চলে আসেন। পরের মৌসুমও আবাহনীতে খেলেন। ৮৬ সালে ফের আবার ফিরে যান মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবে। আর ঘরোয়া ফুটবল জীবনের শেষ বছর ৮৭ সালটা কাটান অগ্রণী ব্যাংক ক্লাবে। সে বছর অধিনায়কত্বের দায়িত্বও নেন। জাতীয় দলের হয়ে এই ফুটবলার দিল্লী এশিয়ার্ড, সিউল এশিয়ার্ড, কায়দা আযম ট্রফি, প্রি-ওয়অর্ল্ড কাপ, মারদেকা কাপ এবং স্বদেশের প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে অংশ নেন। ৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমসে খেলতে গিয়ে ফের আহত হন। ফুটবল জীবনের সুখ আর দুঃখের স্মৃতি তার কম না। তবে বয়স থাকতেও অলোক ৮৭ সালে সিদ্ধান্ত নেন আর খেলবেন না। প্রিয় মাঠ থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেন। ঢুকে পড়েন চাকরি জীবনে। কাস্টমসে চাকরি নিয়ে ঢাকা ছেড়ে সোজা চলে যান চট্টগ্রামে। বলা যায়, এরপর থেকে ফুটবলার অলোককে আর মাঠে দেখা যায়নি। বর্তমানে শরীয়তপুরে কাস্টম অফিসে কর্মরত আছেন। চাকরি জীবনের প্রান্তবেলায়ও তিনি চলে এসেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে অলোক দুই সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম নাফিয়া নীযবত আহমেদ। দুই ছেলের নাম আলিফ আহমেদ এবং নাফিম আহমেদ। সবাই-ই আমেরিকা প্রবাসী। অনেক আগেই অলোকের পরিবার আমেরিকাতে স্থায়ী হয়েছেন। দুই ছেলে এখন বেশ বড় হয়েছে। ছেলেরা ফুটবল ভালবাসে, ফুটবল খেলে। সময় সুযোগ পেলেই তিনি পরিবারের কাছে যান। সম্প্রতি অলোক এই প্রতিবেদকের সঙ্গে তেজগাঁওয়ে নিজবাসায় মুখোমুখি হন। সেই সুঠামদেহী ঝাঁকড়া চুলের মারকুটে ফুটবলার অলোককে এখন আগের সময়ের সঙ্গে মেলানো একেবারেই কঠিন। অনেকে আলাপের ভিড়ে ফিুটবল থেকে এভাবে আড়াল করে রাখলেন প্রশ্ন করতেই অলোক বললেন, ‘আসলেই ফুটবল ছেড়ে অনেকেই কোচ, কর্তকর্তা হয়েছেন। আমি কিছুই আর হয়নি। হতে চাইওনি। কোন অভিমান থেকেও নয়, এমনিই। তবে সেই সোনালী জীবনের ফুটবলে কথা মনে পড়লে মনটা কেঁদে উঠে। সবই চোখে ভাসে। কত ঘটনা। ফুটবল নিয়ে কত যে উত্তেজনা। প্রতিটি ম্যাচেই ক্লাব সমর্থকদের বিরাট চাপ নিয়ে খেলতে হতো। একটু থেকে একটু হলেই কত না জবাবদিহি করতে হতো।’ নিজের খেলা সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গেলে বলেন, ‘আসলে মাঠে শুধু খেলেছি অন্য চিন্তা করিনি। মাঠে সব সময় নিজের সামর্থ্যটুকু দেয়ার চেষ্টা করেছি। আরেকটি কথা না বললেই নয়, আমি সব সময়ই প্রচারের আড়ালে থেকেছি। এখনও তাই। না কোন অভিমান থেকে নয়। তবে ফুটবলার হিসেবে ভাগ্যবান মনে করি এই কারণে যে ফুটবলেন উন্মাতাল সময়ে আমি দেশের দুটি সেরা টিম মোহামেডান এবং আবাহনীকে খেলেছি এবং সেরা একাদশে থেকেছি। আবার আমি থাকা অবস্থায় দু’দলই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এক সময় অলোককে নিয়ে ক্লাব সমর্থকদের মাঝে খানিকটা মিথও প্রচলিত ছিল এইরকম যে তাঁকে মারিয়ে গোল করা কঠিন। হয়ত এ কারণেই ৮৪ সালে আবাহনী তাঁকে টাগেট করেই দলে নিয়েছিল। অলোক বলেন, ৮৪ সালে মঞ্জুর কাদের আমাকে আবাহনীতে খেলতে যোগসূত্র তৈরি করে। এই খবর পাওয়ার পর তেজগাঁওয়ে আমার বাসায় বাদল, কোহিনুর আসে। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকি। ৮৫ সালে আবাহনী লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। আমি আবাহনীর সেরা একাদশে খেলি। ফুটবল জীবনের নানা স্মৃতি আউড়িয়ে বলেন, অনেক ম্যাচই মনে ভীষণ দাগ কেটে আছে। তবে ৮২ সালে লীগে মোহামেডান আর আবাহনীর যে ম্যাচকে কেন্দ্র করে সালাহউদ্দিন ভাইসহ চারজন তারকা ফুটবলারকে কারাবরণ করতে হয়- ওই ম্যাচটি বিশেষ স্মৃতি হয়ে আছে। সালাহউদ্দিন ভাই ওই ম্যাচে পেনাল্টি মিস করেন। ওই ম্যাচে মোহামেডান জয়লাভ করলেও আবাহনীর একটি গোলের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে সালাহউদ্দিন ভাইয়ের মতো জননন্দিত ফুটবলারকে জেল খাটতে হয়। বর্তমান সময়ে ফুটবলে যে অধঃপতন সেটা সাবেক ফুটবলার অলোককেও কাঁদায়। তাঁর মতে, ফুটবলের জনপ্রিয়তা কোথায় ছিল আর এখন কোথায়। তবে এ জন্য তিনি খুব একটা বেশি দোষারোপ করতে চান না খেলোয়াড়দের। যদিও খেলোয়াড়দের সুযোগ সুবিধা অনেকে বেড়েছে। বলেন, আগে নিজের টাকায় কেনা বুট পরে জাতীয় দলের হয়ে খেলত ফুটবলাররা। আর এখন কত সুযোগ-সুবিধা। তারপরও ফুটবলের অধঃপতনের জন্য ফুটবল ম্যানেজমেন্টাকেই দায়ী করে বলেন, ফুটবল নিয়ে ব্যক্তিগত বাণিজ্য হচ্ছে, কিন্তু ফুটবলের উন্নতি হচ্ছে না। তিনি বলেন, ফুটবল এখন যে জায়গাতে গিয়ে ঠেকেছে তাতে করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ জরুরী হয়ে পড়েছে। অলোক মনে করেন, বর্তমান সময়ে ফুটবলের জন্য কী করণীয় সেটা কেউই ঠিক করতে পারছেন না, ফলে কেবল ব্যর্থতার ষোলোকলাই পূর্ণ হচ্ছে। নিজ সময়ের ফুটবলারদের মধ্যে এনায়েত, কাজী সালাহউদ্দিন, মঞ্জুকেই তিনি সেরা মনে করেন। আর পরবর্তীতে মোনেম মুন্নার খেলাটা তার কাছে এখনও অন্যরকম মনে হয়। ক্লাব আর জাতীয় দলের কোচ হিসেবে পাওয়া জার্মানির গার্ড স্মিথ, আব্দুর রহিম, কাজী সালাহউদ্দিন এবং গোলাম সারওয়ার টিপুকে অলোক অন্যভাবে স্মরণ করেন। তাঁর মতে, এসব কোচদের অন্তর্দৃষ্টি ছিল। খেলোয়াড়দের তারা বুঝতো। খেলোয়াড়দের কাছ থেকে খেলাটাও তাই আদায় করে নিতে পারতেন। সবশেষে অলোক বলেন, দেশের ফুটবল সম্মানকে উচ্চতায় নিতে হলে কর্মকর্তাদের বিবেককে ভীষণ রকম জাগ্রত করতে হবে।
×