ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পদে পদে মৃত্যুফাঁদ বাস

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৮ মার্চ ২০১৭

পদে পদে মৃত্যুফাঁদ বাস

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজধানীর মতিঝিল থেকে মোহাম্মদপুর রুটে চলাচল করে ‘মৈত্রী পরিবহন’। বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই গাড়িটি চলাচল করছিল বছরের পর বছর। চালকেরও কোন বৈধতা নেই। নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স। অবশেষে মোবাইল কোর্টের কব্জায় এল ঢাকা মেট্রো-ব-১১-২০১৬ নম্বর বাসটি। শেষ পর্যন্ত গাড়িটি ডাম্পিংয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। বাসের পেছনের ভাঙাচোরা অংশ দেখে সহজেই বোঝা যায় সাধারণ টিন দিয়ে নামেমাত্র জোড়াতালির ছাউনি দেয়া হয়েছে। তাই খসে খসে পড়ছে। বডির পেছনের অংশ ভাঙতে ভাঙতে দূর থেকে বাসের ভেতরের আসন দেখা যায়। বেরিয়ে এসেছে গ্যাসের সিলিন্ডারও। এমন ভয়াবহ অবস্থার মধ্যেই চলছে সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাস। ঢাকা মেট্রো-জ-১১-১৪৮৫ নম্বরের গাড়িটি প্রায়ই দেখা যায় নগরীর বিভিন্ন এলাকায়। ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৯১৪৫ সিরিয়ালের রাইদা পরিবহনের গাড়িটির দশা একই। ঢাকা মেট্রো-জ-১৪-১১৯৩ সিরিয়ালের তুরাগ পরিবহনের দশা আরও বেহাল। পেছনের অংশ থেকে শুরু করে গাড়িটির সর্বাঙ্গেই যেন ব্যথা। ভাঙাচোরা মুড়ির টিন বললেই চলে এটিকে। ভেতরের পরিবেশ আরও নাজুক। তবুও রাস্তার রাজাই যেন তুরাগ। চলাচলে কারও কোন তোয়াক্কা নেই। পাল্লা দিয়ে বেপরোয়া চলে এই কোম্পানির বাসগুলো। যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় বাসে-বাসে ধাক্কাধাক্কি, সংঘর্ষ যেন নিয়মিত অংশ। মজার বিষয় হলোÑ এই কোম্পানির বাসগুলোর বডির বাইরের দু’পাশেই ভাঙাচোরা, দাগ, ক্ষতবিক্ষত অবস্থা। জানালা ভাঙা। এর মূল কারণ হলো, ইচ্ছা করেই একটি বাসের গা ঘেষে আরেকটি বাসের আগে চলার প্রতিযোগিতা। ফলে একটির সঙ্গে অপরটির ঘর্ষণে এ রকম অবস্থা। সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, অনাবিল, ছালছাবিল, তুরাগ, সুপ্রভাত, ২৭ নম্বর, আট নম্বর, ছয় নম্বর, মিডওয়ে, বাহন, তরঙ্গপ্লাস, উইনার, ফাল্গুন পরিবহন, আজমেরী, স্বকল্প, বলাকা, তিন নম্বর, ১৩ নম্বরসহ বেশকিছু পরিবহনের অবস্থা একেবারেই বেহাল। সদরঘাট রুটে চলার অনেক বাসের দশা একই। কোনটির বডি ভেঙে বেরিয়ে আছে। কোনটি ভাঙাচোরা অবস্থায় চলছে। স্টিয়ারিংও ভাঙাচোরা। লুকিং গ্লাস, জানালা, দরজা প্রয়োজনীয় কোন কিছুই ঠিকঠাক নেই। যে কোন মুহূর্তে ঘটতে পারে বড় রকমের দুর্ঘটনা। মৃত্যুফাঁদ হয়ে চলা লক্কড়-ঝক্কড় বাসগুলোর বেশিরভাগই অভিযান শুরুর পর থেকেই লাপাত্তা। এর কারণ হিসেবে পরিবহন নেতারা জানিয়েছেন, অভিযান শিথিল হলেই ফের রাস্তায় নামবে মৃত্যুদূত বাসগুলো। সাধারণত প্রভাবশালী রাজনীতিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মালিকানা পরিচয়ে এসব গাড়ি চলাচল করে। রাজধানীতে ৩০২ রুটের অনুমোদন ॥ বিআরটিএ জানিয়েছে, বর্তমানে ঢাকা নগরীতে নিয়মিত ও অনিয়মিত ৩২০টি রুট রয়েছে। নিত্যনতুন রুটে প্রতিদিনই মিনিবাসের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলেন, বর্তমানে রাজধানীতে শতাধিক কোম্পানি ও ব্যক্তিগত মালিকানায় প্রায় সাড়ে ৯ হাজার বাস ও মিনিবাস চলে। চার বছর আগেও এ সংখ্যা ছিল সাত হাজার। তারা বলেন, বর্তমানে ৩২০টি রুট থাকলেও সব নিয়মিত বাস চলছে না। বিআরটিএর সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালে ১ হাজার ২৩১টি, ২০১১ সালে ১ হাজার ৫০১টি, ২০১২ সালে ১ হাজার ২১৮টি, ২০১৩ সালে ৯৭১টি, ২০১৪ সালে ১ হাজার ১৫০টি, ২০১৫ সালে ৭০৫টি এবং ২০১৬ সালে ৬৫০টি বাসের নিবন্ধন নথিভুক্ত করা হয়। তবে পুরনো লক্কড়-ঝক্কড় বাসগুলো মৃত্যুফাঁদ হয়ে চলাচল করলেও এগুলো পরিবর্তনের কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ৪৯টি বাস ডাম্পিং ॥ এক মার্চ থেকে চলমান অভিযানে অর্ধশত বাস ও মিনিবাস ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নেতৃত্বে জেলা প্রশাসন ও বিআরটিএ যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করছে। সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন অপরাধে এ পর্যন্ত মোট ৬৭৯টি মামলা হয়েছে। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়েছে ৪৭ জন চালককে। জরিমানা আদায় হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ টাকা। ডাম্পিং করা হয়েছে ৪৯টি বাস ও ১টি লেগুনা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ডাম্পিং হওয়া বাসগুলোর বেশিরভাগই মেয়াদোত্তীর্ণ। কিছু বাস রয়েছে একেবারেই ফিটনেস নেই। অর্থাৎ চলাচলের অযোগ্য হওয়ায় ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে। পাঁচ মার্চে অভিযানে বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ, মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ অনুসারে ১০০ গাড়ি ডাম্পিং-এ পাঠান। গাড়িতে ভাড়ার তালিকা না থাকায় একই আইনে ১৫২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অতিরিক্ত সিটের জন্য ২টি গাড়িকে তিন হাজার টাকা করে জরিমানা করেন। ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় বিহঙ্গ পরিবহনের (ঢাকা-মেট্রো জ-১১-৩১৮১) খলিল (১৮), বয়স না হওয়া ও লাইসেন্স না থাকায় আজিমপুর-গুলিস্তান রুটের মোঃ কামালকে (১৭) একমাসের কারাদ- দেন। ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য মোঃ শুক্কুর মিয়াকে (৪৫) একমাসের জেল ও ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়। বিআরটিএ পরিচালক এ্যানফোর্সমেন্ট নাজমুল আহসান মজুমদার জনকণ্ঠকে জানান, অভিযানের সকল তথ্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন সরবরাহ করছে। তবে পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আমরা চলমান অভিযান অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছি। পুরনো বাসের রুট পারমিট বন্ধ ॥ বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে চলাচলকারী সিএনজিচালিত বাস ও মিনিবাসের আয়ুষ্কাল ২০ বছর নির্ধারণ করে সার্কুলার জারি করে সরকার। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে সিএনজিচালিত বাস-মিনিবাস চলাচল করার বিধান রয়েছে। আরও জানা গেছে, ঢাকায় ২০ বছরের বেশি পুরনো বাস-মিনিবাসের ফিটনেস ও রুট পারমিট দেয়া বন্ধ রেখেছে বিআরটিএ। এসব কারণে ঢাকায় চলাচলকারী ২০ বছরের বেশি পুরনো সব বাস-মিনিবাস মেয়াদোত্তীর্ণ। এগুলোর রাস্তায় চলাচলের কোন সুযোগ নেই। বিআরটিএর কর্মকর্তা ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ঢাকায় নিবন্ধিত বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ৩৮ হাজার ৫০৩টি। এর মধ্যে বাসের সংখ্যা ২৮ হাজার ২৬৪টি ও মিনিবাসের সংখ্যা ১০ হাজার ২৩৯টি। এগুলো মূলত কাগজ কলমের হিসাব। বাস্তবে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় চলাচলকারী বাস-মিনিবাসের সংখ্যা প্রায় নয় হাজার। এর মধ্যে অন্তত ৩শ’ থেকে ৪শ’ গাড়ি রয়েছে ২০ বছরের পুরনো অর্থাৎ ফিটনেসবিহীন। এসব গাড়ির রেজিস্ট্রেশন থাকলেও নেই ফিটনেস সার্টিফিকেট। তবে প্রভাবশালীদের আশ্রয়ে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বিভিন্ন কোম্পানির নামে এসব গাড়ি চলাচল করছে। বিআরটিএর সূত্রে জানা গেছে, চারটি আদালত জানুয়ারিতে অভিযান চালিয়ে ১ হাজার ৬০১টি মামলা ও ৯৮টি গাড়ি ডাম্পিং করেছে। ফেব্রুয়ারিতে ডাম্পিং গাড়ির সংখ্যা ৪৮টি। এর মধ্যে কয়েকটি গাড়ি মেয়াদোত্তীর্ণ ও আনফিট ছিল। কর্মকর্তারা জানান, মোবাইল কোর্টের অভিযান পরিচালনার খবর পেলে আনফিট গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেন মালিক ও শ্রমিকরা। কখনও কখনও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের চাপে এসব গাড়ি আটক করাও সম্ভব হয় না। এছাড়া নিয়মিত রাতে চলাচল করে এসব গাড়ি। কারণ রাতে বিআরটিএর মোবাইল কোর্ট রাস্তায় থাকেন না। এ সুযোগ নেয় পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। জানা যায়, ১৫ ফেব্রুয়ারি নগর ভবনে বিআরটিএ, ঢাকা জেলা প্রশাসন ও ডিএমপি কর্মকর্তাদের নিয়ে সমন্বয় সভা করেন মেয়র সাঈদ খোকন। সভায় মেয়র ঘোষণা করেন, ১ মার্চ থেকে নগরীতে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে চলাচলকারী বাস রাজধানীতে চলতে দেয়া হবে না। মেয়রের ঘোষণার পর একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তী সময়ে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় মেয়াদোত্তীর্ণ বাসের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। ত্রুটির অভাব নেই ॥ ২০ বছরের পুরনো বাসের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান। অভিযানে এমন বাসের সংখ্যা খুব একটা নয়। অভিযানে বেশিরভাগ গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে ভাঙাচোরা। অর্থাৎ ফিটনেস নেই। অথচ ফিটনেস সনদ রয়েছে। ফিটনেস সার্টিফিকেট না পাওয়ারও নজির আছে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালকের সংখ্যা যথেষ্ট। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চালকের লাইসেন্স নেই এমন অভিযোগও বিস্তর। আবার যত্রতত্র বাস থামানো, বেপরোয়া গতিতে চলার প্রবণতা তো আছেই। বাসের দরজা, জানালা ভাঙা, বডি ভাঙা, ভেতরের পরিবেশ নোংরা এরকম চিত্রও লক্ষ্য করা গেছে। সব মিলিয়ে কমবেশি প্রতিটি বাসেই রয়েছে মৃত্যুফাঁদ। চালক অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিংবা লাইসেন্সধারী না হওয়ার অর্থই হলোÑ মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে চলতে হয় যাত্রীদের। রাজধানীতে প্রায় ১১ লাখ যানবাহনের বিপরীতে রয়েছে মাত্র চারটি বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর মধ্যে তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। সাত মার্চের অভিযানে ১০৬টি মামলা করা হয়েছে। বিভিন্ন অপরাধে ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এছাড়াও লাইসেন্স না থাকায় আটজন চালককে বিভিন্ন মেয়াদে দ- দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। ছয় মার্চ তিনটি ভ্রাম্যমাণ আদালতে মামলার সংখ্যা ৬৭টি। জরিমানা আদায় হয়েছে ৯৮ হাজার ৭০০ টাকা। লাইসেন্স না থাকায় পাঁচজন চালককে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। এর আগে দুই মার্চ ৬৬টি মামলায় ৯৯ হাজার ৭০০ টাকা জরিমানা আদায় হয়েছে। লাইসেন্স না থাকায় ১৪ জন চালককে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। সারাদেশে ২০ বছরেরর পুরনো গাড়ির সংখ্যা এক লাখ ৬০ হাজার ॥ বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি বিআরটিএর কাছে রাজধানীতে চলা ২০ বছরের পুরনো গণপরিবহনের সংখ্যা কত এর সঠিক কোন হিসাব নেই। সরকারী এই পরিবহন নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, সর্বশেষ ২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী সারাদেশে ১০ বছরের পুরনো বাস ও মিনিবাসের সংখ্যা এক লাখ ৬০ হাজার ৫৯০টি। রেজিস্ট্রেশনভুক্ত বাস-মিনিবাসের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ। এর মধ্যে দুই লাখের বেশি বাস ও মিনিবাসের ফিটনেস নেই। বর্তমানে সারাদেশে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত পরিবহনের সংখ্যা ২৯ লাখ ৪৮ হাজার ৯০৬টি। এর মধ্যে ১৮ লাখের বেশি রয়েছে মোটরসাইকেল। বিআরটিএ সচিব শওকত আলী জনকণ্ঠকে বলেন, রাজধানীতে ২০ বছরের পুরনো গাড়ি খুব একটা নেই। এমন গাড়ির সংখ্যা কত এরকম পরিসংখ্যানও আমাদের হাতে নেই।
×