ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিরঞ্জন রায়

হিন্দু নারীর উত্তরাধিকার

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ২৮ মার্চ ২০১৭

হিন্দু নারীর উত্তরাধিকার

প্রতিবছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস বেশ ঘটা করে পালিত হয় সারাবিশ্বে। নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করে নারী-পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে বছরের বিশেষ একটি দিন আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি প্রথমে আমেরিকায় ১৯০৯ সালে জাতীয়ভাবে এবং ১৯১১ সালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড এবং জার্মানিতে আন্তর্জাতিকভাবে পালন করা হয়। বর্তমানে এসব উন্নত দেশে এই দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হলেও এর গুরুত্ব এখন আর আগের মতো নেই। কেননা এই দিবস পালনের যে লক্ষ্য তা উন্নত বিশ্বে অর্জিত হয়ে গেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। এখানে নারীর প্রতি বৈষম্য দেখা যায় না বললেই চলে। এখানকার সমাজ ব্যবস্থায় নারী-পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত হয়েছে বলেই ধরে নেয়া যায়। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনও এ সমস্যা প্রকট আকারেই রয়ে গেছে। এখানে নারী-পুরুষের সমঅধিকার তো দূরের কথা, নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য বেশ ভালভাবেই চোখে পড়ে। নারীর সামাজিক নিরাপত্তা তো নিশ্চিত হয়ইনি, উল্টো নারীকে প্রতিনিয়ত পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে নিগৃহীত হতে হচ্ছে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। এই সামাজিক ব্যাধি থেকে আমাদের দেশও যে বের হয়ে আসতে পেরেছে তা বলা যাবে না। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, নারীর ক্ষমতায়নে এবং সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণে আমাদের দেশ ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করেছে। বিগত পঁচিশ বছরে আমাদের দেশে নারীরা অনেক এগিয়েছে এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় নারীর উন্নতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এতদসত্ত্বেও নারীর প্রতি বৈষম্য এবং নারী-পুরুষে ভেদাভেদ এখনও সমাজে বিদ্যমান। এক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের সামাজিক ব্যবস্থা এবং অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধিবিধান অনেকাংশে দায়ী। বাংলাদেশের হিন্দু মেয়েরা বলতে গেলে ধর্মীয় বিধিবিধানের কারণেই সবচেয়ে বেশি বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার। কেননা অনেক হিন্দু আইনই ধর্মীয় বিধিবিধানের ওপর ভিত্তি করে প্রণীত, যার মধ্যে হিন্দু বিবাহ এবং উত্তরাধিকারের বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। হিন্দু আইনগুলো এমনভাবে প্রণীত হয়েছে যেখানে মেয়েদের সমঅধিকারের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকেছে। যেমন, হিন্দু আইনে বিবাহ নিবন্ধনের বিধান ছিল না। বছরতিনেক আগে পৃথক ও স্বতন্ত্র হিন্দু বিবাহ আইন প্রণীত হলেও সেখানে বিবাহ নিবন্ধনকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি। ফলে হিন্দু বিবাহের যে মূল আইনগত সমস্যা তা থেকেই গেছে। বিবাহ নিবন্ধনের অভাবে কোন সমস্যা হলে আইনের চোখে এই বিবাহ প্রমাণ করা যে কতটা দুঃসাধ্য কাজ, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। হিন্দু বিবাহ নিবন্ধনই যেখানে এখনও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি, সেখানে এক উদ্ভট দাবি উঠেছে হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ আইন পাসের। সমাজে আরেক অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা আর কাকে বলে! হিন্দু আইনের সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো উত্তরাধিকার আইন, যেখানে মেয়েদের পুরোপুরিভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। হিন্দু আইনে একটি মেয়েকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তিতে তার ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা হয়নি। বর্তমানে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী কোন মেয়ে তার বাবার সম্পত্তির কোন রকম মালিকানা পাবে না। বাবার অবর্তমানে তার সমস্ত সম্পত্তির মালিকানা ভাগ হবে তার ছেলেদের মাঝে। এটা এতই দুর্ভাগ্যজনক যে, একই ব্যক্তির সন্তান হয়ে শুধু মেয়ে হয়ে জন্মানোর কারণে বাবার সম্পত্তির কোন অংশই সে পাবে না। এখানেই শেষ নয়। বর্তমান হিন্দু আইনের উত্তরাধিকার বিধান অনুযায়ী একজন মেয়ে তার স্বামীর সম্পত্তিরও কোন অংশ পায় না। স্বামী মারা গেলে সেই সম্পত্তির মালিকানা পাবে তার ছেলেরা (মেয়েরা নয়)। আর ছেলে না থাকলে সেই মালিকানা যাবে তার ভাইয়ের ছেলেদের কাছে। তবুও তার মেয়েরা বা স্ত্রী সেই সম্পত্তির কোন মালিকানা পাবে না। তাহলে অবস্থাটা কি দাঁড়াল? হিন্দু মেয়েদের পায়ের তলায় কোন মাটি নেই। কেননা তাদের না আছে বাবার বাড়ির সম্পত্তির মালিকানা, না অধিকার আছে তার স্বামীর সম্পত্তির মালিকানায়। এরূপ একটি নিষ্ঠুর আইনী ব্যবস্থা আজও প্রচলিত আছে, তা ভাবতেও অবাক লাগে। এখানে অবশ্য শুভঙ্করের ফাঁকির একটি দুষ্টচক্র আছে, যা শুনতে খুব সুন্দর কিন্তু ফলাফল শূন্য। হিন্দু আইন অনুযায়ী ছেলেরা তার মায়ের সম্পত্তির কোন মালিকানা পাবে না এবং এর সম্পূর্ণটাই পাবে মেয়েরা। কি সুন্দর প্রহসন! যেখানে মেয়েরা হিন্দু আইনের প্রচলিত উত্তরাধিকার বিধান অনুযায়ী না পাবে বাবার সম্পত্তির মালিকানা, না পাবে স্বামীর সম্পত্তির মালিকানা। এই বৈষম্যমূলক আইনের মারপ্যাঁচে মায়ের সম্পত্তির মালিক হওয়ার যেখানে কোন সুযোগই নেই, সেখানে তার মেয়েদের সম্পত্তি পাবার আইনগত অধিকার থাকলেই বা কি লাভ, আর না থাকলেই বা কি ক্ষতি। এ যেন শূন্যকে ভাগ করার শামিল। উল্লেখ্য, ভারতে বহু পূর্বেই হিন্দু আইন সংশোধন করে বাবার সম্পত্তিতে মেয়েদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইনে বাবার সম্পত্তিতে মেয়েদের মালিকানা ধর্মীয়ভাবেই নিশ্চিত করা আছে। একই দেশের আইন ও একই সংবিধানের অধীনে বসবাস করে শুধু ধর্মভেদে এমন বৈষম্যমূলক আইন থাকা উচিত নয় কোন অবস্থাতেই। এ প্রসঙ্গে আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। আমি তখন বাংলাদেশে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে কর্মরত। আমার ঘনিষ্ঠ পরিচিত হিন্দু পরিবারের এক ছেলে নাবালক সন্তান রেখে দুর্ভাগ্যজনকভাবে অকালে মৃত্যুবরণ করে। সদ্য বিধবা মেয়েটি, যার শরীর থেকে এখনও বিয়ের হলুদের গন্ধ মুছে যায়নি, সে একেবারে শোকে পাথর হয়ে যায়। মেয়েটির অসহায় আত্মীয়স্বজন তাদের মেয়েকে সান্ত¡না দিতেই ব্যস্ত। প্রয়াত ছেলেটি জীবিতকালে টাকা পয়সা জমানোর বিষয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করত এবং এক রকম আমার পরামর্শেই কিছু টাকা আমার কর্মরত ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে জমা রাখে। ছেলেটির পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে বুঝতে পেরেছিলাম যে, সদ্য প্রয়াত ছেলেটির ভাইয়েরা খুব সহসাই এই টাকা উঠিয়ে নিবে। মাত্র এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই সেই ভাইয়েরা ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের জন্য আমাদের ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকের কাছে আসে। এদিকে আমি স্বউদ্যোগে সদ্য বিধবা মেয়েটির আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বুঝতে পারি যে, তাদের এই অর্থ পাওয়ার ব্যাপারে কোন সঠিক ধারণাই নেই এবং এক ধরনের নিষ্ঠুর নিয়তিকে মেনে নিয়ে প্রয়াত স্বামীর বাড়ির কোন সম্পত্তির অংশ পাওয়ার আশা কখনই সে করেনি। যাই হোক আমার যেহেতু বাংলাদেশের ব্যাংকিং আইনকানুন সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছিল, তাই সেগুলোর ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে সদ্য বিধবাকে দিয়ে সেই টাকা উত্তোলন করে মেয়েটির নিজের নামে এবং নাবালক সন্তানদের নামে যৌথভাবে স্থায়ী আমানত এমন শর্তসাপেক্ষে করে দেই যে, নাবালক সন্তান সাবালক না হওয়া পর্যন্ত এই অর্থ উত্তোলন করা যাবে না। এই কাজটি সম্পন্ন করার বেশ কয়েকদিন পরেই সেই ভাইয়েরা উত্তরাধিকারের আইনী আদেশ এনে ব্যাংকে জমা দিয়ে সেই মোতাবেক অর্থ প্রদানের জন্য অনুরোধ জানায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, সেই আইনী আদেশে ভাইদের নাম থাকলেও সদ্য বিধবা স্ত্রীর নাম ছিল না। যেহেতু এই আদেশ এবং প্রমাণ সাপেক্ষে কোন আবেদন দাখিলের পূর্বেই অর্থ জমাকারীর স্ত্রী সেই অর্থ উত্তোলন করে নিয়েছিল, তাই এক্ষেত্রে ব্যাংকের আর কিছু করার ছিল না। হিন্দু আইনের উত্তরাধিকার বিধানে বাবার এবং স্বামীর সম্পত্তিতে মেয়ের বা স্ত্রীর অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা গেলে হিন্দু মেয়েদের স্বামী হারানোর পর এমন অসহায় অবস্থায় পরতে হয় না। বাংলাদেশে প্রচলিত অনেক আইনেরই বহু সংশোধনী হলেও হিন্দু আইনের তেমন কোন সংশোধনী হয়নি। ফলে এই আইনের অনেক ধারাই এখনও সেকেলে এবং বর্তমান বাস্তবতার আলোকে একেবারেই অচল। অনেক দেরিতে হলেও বাংলাদেশ সরকার এই আইনগুলো সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে এবং ইতোমধ্যে হিন্দু বিবাহ আইন প্রণীত হয়েছে। এখন সময় এসেছে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনটিকে যুগোপযোগী করে তোলা, যেখানে হিন্দু মেয়েদের বাবার এবং স্বামীর সম্পত্তির অংশীদারিত্ব নিশ্চিত হবে। কেননা সময়ের আবর্তে মানুষের চিন্তা-চেতনা এবং মানসিকতায় যথেষ্ট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এখন আর অনেকের কাছেই ছেলেমেয়েতে কোন ভেদাভেদ নেই। তারা উভয়কে সমান দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছেন। এমনকি অনেকে এখন ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ভবিষ্যত, সুখস্বাচ্ছন্দ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। তাই এখনই উপযুক্ত সময় হিন্দু আইনগুলো সংশোধন করা এবং সেক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন হিন্দু আইনের উত্তরাধিকার বিধান সংশোধন করা। বাংলাদেশে এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আহ্বান হোক হিন্দু মেয়েদের উত্তরাধিকার নিশ্চিত করা। লেখক : ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা [email protected]
×