ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কামরুল আলম খান খসরু

স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলো

প্রকাশিত: ০৪:১২, ২৮ মার্চ ২০১৭

স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলো

(গতকালের পর) শিকগুলো বাঁকিয়ে জানালা দিয়ে পালানো যায়। তবে জানালা দিয়ে পালাতে গেলে বাহির থেকে সব দেখা যায়। ল্যাট্রিনের নিচের দিকে রয়েছে মলত্যাগ করার মান্ধাতা আমলের ব্যবস্থা। বসার জায়গার কিছুটা নিচে রয়েছে একটি চাড়ি। চাড়ি ভরে গেলে মেথর পেছন দিক দিয়ে এসে মল নিয়ে যায়। মলত্যাগের প্যানের মতো জায়গাটি (যেখানে দু’পা ফাঁক করে বসে) ভেঙ্গে একটু বড় হয়ে গিয়েছিল। আমি দু’হাত উঁচু করে ভাঙ্গা ফাঁক দিয়ে পা দুটোকে নিচে নামিয়ে পা দিয়েই আলতো করে চাড়িটি সেখান থেকে সরাই। তারপর আমার শরীরটা কোমর থেকে একটু বেঁকে প্যানের ভাঙ্গা অংশের ফাঁক দিয়ে পুরো শরীর গলিয়ে মাথা নিচু করে সে পথেই কচুগাছ, কলাগাছ, মাটির গর্ত ও জঙ্গল পেরিয়ে খুব দ্রুত দৌড়ে এসে মুস্তাফিজের সাইকেলের পেছনে ক্যারিয়ারে চড়ে বসে তাকে বলি বিকল্প পথে আশাশুনি লঞ্চঘাটের দিকে যেতে। মুস্তাফিজ গ্রামীণ পথ ধরে উল্কাগতিতে উর্ধশ্বাসে ছুটতে থাকে। এদিকে পুলিশের ঘন ঘন বাঁশির আওয়াজ আর চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পাই। বাঁশি বাজানোর পাশাপাশি পুলিশ ‘বন্দী পালিয়েছে, বন্দী পালিয়েছে’ বলে চিৎকার করতে থাকে। কিছু সময় পর বাঁশির আওয়াজ ও চেঁচামেচির শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসে। সাইকেলে চড়া অবস্থাতেই শরীরে লেগে থাকা মলের দুর্গন্ধে আমার দু’বার বমি হয়। এভাবে প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পর মুস্তাফিজকে নিরিবিলি কোন পুকুর পাড়ে সাইকেলটি থামাতে বলি। সে একটি পুকুর পাড়ে এসে সাইকেলটি থামায়। আমি তাকে একটু বিশ্রাম করতে বলে প্যান্ট ও গেঞ্জি পরেই পুকুরের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ল্যাট্রিনের ফাঁকা দিয়ে নামার সময় আমার গায়ে মল লেগে গিয়েছিল। তাই শরীর থেকে প্রচুর দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। শরীর পরিষ্কার করে, গোসল করে আবার আশাশুনি লঞ্চঘাটের দিকে রওনা হই। কোর্ট থেকে আশাশুনি লঞ্চঘাটের দূরত্ব প্রায় ২০ কিমি। বিকল্প পথে ঘণ্টা দুই চলার পর অবশেষে লঞ্চঘাটে এসে পৌঁছি। আমরা লঞ্চঘাট থেকে একটু দূরে এসে থামি। আমি মুস্তাফিজকে বলি গায়ে মাখার একটি সাবান নিয়ে আসতে নিকটস্থ কোনো বাড়ি থেকে। কারণ তখনও আমার শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। মুস্তাফিজ একটি কাপড় কাচার সাবান নিয়ে আসলে আমি আড়ালে গিয়ে নদীতে নেমে প্যান্ট ও শার্ট খুলে আবার পরিষ্কার করে ধুয়ে নেই এবং সাবান মেখে গোসল করি। কিছুক্ষণ পরে পাড়ে উঠে ভেজা প্যান্ট ও গেঞ্জি ভাল করে চিপে পানি ঝরিয়ে পরি। তারপর লঞ্চের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এ ঘাট থেকে লঞ্চে করে খুলনা যাওয়া যায়। আমার পরিকল্পনা ছিল লঞ্চযোগে প্রথমে খুলনা যাব। সেখানে আমার মেজ বোনের (ফেরদৌস আরা) বাড়িতে দুয়েকদিন থেকে একটু সুস্থ হয়ে রকেটযোগে ঢাকা যাব। লঞ্চে বা স্টিমারে করে যাওয়ার কারণ হলো পাকিস্তানীদের কাছে ধরা না পড়া। ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকলে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মরক্ষা করা আমার জন্য সহজ ছিল। ট্রেনে আর বাসে আত্মরক্ষা করা কঠিন। তবে তাও আমি করেছি বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে। যাক সে কথা। সকালবেলা একটি লঞ্চ খুলনা থেকে ছেড়ে আসে। তা আবার দুপুর বেলা পৌঁছে সাতক্ষীরার আশাশুনিতে। ঘণ্টাখানেক পর তা আবার ছেড়ে যায় খুলনার উদ্দেশে। প্রতিবার আসা-যাওয়ায় সময় লাগে চার ঘণ্টা। তখন প্রতিদিন খুলনা থেকে আশাশুনি দুটি লঞ্চ চলাচল করত। সেদিন সকালে খুলনা থেকে আসা লঞ্চটি পুনরায় খুলনার উদ্দেশ্যে ছাড়বে ছাড়বে করছে। মুস্তাফিজ লঞ্চে উঠে সারেংসহ সব স্টাফকে বলে আসে তার এক বিশেষ অতিথি খুলনা যাচ্ছে। তারা যেন অতিথির ভালমতো দেখভাল করে। এখানে সবাই মুস্তাফিজকে সমীহ করত। আমি লঞ্চে উঠে বসলে স্টাফরা এসে আমার কুশল জিজ্ঞেস করে ও আমাকে অভয় দেয়। আমি পেট ভরে খেয়ে একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য লঞ্চের পেছনে একটা নিরাপদ স্থান বেছে নিই। তারপর আরাম করে বসে বিশ্রাম নেয়ার চেষ্টা করি। গত দু’দিন ধরে আমার শরীরের ওপর দিয়ে তো কম ধকল যায়নি। আমি চোখ বুজে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এ সময় রাজ্যের সমস্ত চিন্তা এসে মাথার ওপর ভর করে। মন উতাল-পাথাল করতে থাকে। আমি সাধারণত আমার কাজের জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করি না। তাই বলে নিজের মনকে তো আর এড়িয়ে চলতে পারি না। আমি কী করছি, কেন করছি, এসব করে কী হবে, আমার ভবিষ্যত কী ইত্যাদি নানা প্রশ্ন আমাকে তখন তাড়া করতে থাকে। আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুরা যখন ভোগের জোয়ারে ভেসে বেড়াচ্ছে আমি তখন সংগ্রামের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছি। আমি ভাল পরিবারের সন্তান। দেখতে-শুনতেও ভাল। পড়ালেখা শিখেছি। শৈশবে আমি ছিলাম ভিকারুননিসা নূন (তৎকালীন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল) স্কুলের ছাত্র। সে সময়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে ছিল কো-এ্যাডুকেশন সিস্টেম। তবে আমাদের ব্যাচই ছিল কো-এ্যাডুকেশন সিস্টেমের লাস্ট ব্যাচ। ওই স্কুলে প্রথমে আমাদের হেডমিস্ট্রেস ছিলেন মিসেস কোট্স (গৎং. ছঁড়ঃবং/চবৎরড়ফ: ১৯৫৩-১৯৫৫), তারপরে ছিলেন মিস ব্রাডলি (গরংং ইৎধফষবু / চবৎরড়ফ: ১৯৫৬-১৯৫৮) এবং সর্বশেষ ছিলেন লুল আপা অর্থাৎ মিসেস লুল বিলকিস বানু (গৎং. খড়ষ ইরষয়ঁরং ইধহড়/ চবৎরড়ফ: ১৯৫৮-১৯৬৪)। আমার বাবা সরকারী চাকরি করতেন। তিনি রংপুরে বদলি হয়ে যান এবং আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যান। পরবর্তীতে আমি রংপুর থেকেই আমার গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রী সম্পন্ন করি। তাই আমার জন্য চাকরি বা ব্যবসা করাটাই ছিল শোভনীয়। এ বয়সে ঘর-সংসার করে স্যাটেল হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমি সে পথ মাড়াইনি। শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির কারণে, যে আমাকে দেশকে ভালবাসার নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল। চলবে...
×