ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাণ গোপাল দত্ত

নটোরিয়াস এবং ট্রিমেন্ডাস

প্রকাশিত: ০৪:১১, ২৮ মার্চ ২০১৭

নটোরিয়াস এবং ট্রিমেন্ডাস

কিছুদিন আগে বাংলাদেশ পাবলিক এ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং সেন্টার (BPATC) সাভারে আমি একটি ক্লাস নিতে যাই। সেখানে ওই গ্রুপের কোর্স পরিচালক বললেন স্যার, আমি একটা মজার কথা শুনেছি আপনাকে নিয়ে, যা আপনাকে শোনাতে চাই। আমি বললাম, বলেন। তিনি বললেন যেই লোক আমাকে বলেছেন তার নাম বলব না। কিন্তু কথাটা আপনাকে শোনাতে চাই, যেহেতু কথাটা আমাকে প্রচ- আকর্ষণ করেছে। আমি বললাম, বলুন। তখন তিনি বললেন যে, একজন লোক হয়তবা রাজনৈতিকভাবে আপনার প্রতিপক্ষ, যিনি এ কথাটা বলেছেন। আমাদের একটা আলোচনা সভায় তিনি বললেন যে, Dr. Pran Gopal is very notorious and tremendous। আমি বললাম যে, notorious শব্দটার সঙ্গেtremendous শব্দটা মেলে না। শব্দচয়নে Intelligent বা brilliant বা courageous শব্দগুলো notorious শব্দের সঙ্গে মেলে। যেহেতু আমি intelligent বা brilliant নই; কিন্তু আমি দুঃসাহসী জোর গলায় বলতে পারি। তবে এর প্রতি ভদ্রলোকের আগ্রহ ছিল না। তখন সে বোঝাল, সে নাকি হড়ঃড়ৎরড়ঁং বলতে বুঝিয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দায়িত্ব নেয়ার পরে আমি অত্যন্ত Slowly, Tactfully, Intellectually এবং Notoriously এটাকে চড়ষরঃরপরুব করেছি। আর ঃৎবসবহফড়ঁং বলতে বোঝাতে চেয়েছে একই সঙ্গে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এত উন্নতি করেছি যেটা অতীতের বারো বছরেও হয়নি এবং আগামী ২০ বছরেও তা হবে না। তারপর আমি জবাবে বললাম যে, দেখেন প্রথমটার ব্যাপারে আমি বলি যে, আমি এটাকে চড়ষরঃরপরুব করিনি। আমি নিরপেক্ষভাবে চালাইনি। আমি চালিয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিনেন্স অনুযায়ী এবং বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু সরকারী অনুদানে চলে এবং যেহেতু এটা পাবলিক ভার্সিটি, তাই আমরা সরকারী নিয়মকানুনেরও চূড়ান্ত প্রতিফলন এখানে চেয়েছি। সেটা চেয়েছি বলেই আমি যা পেরেছি সেটা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়টাকে একটা লাইনচ্যুত ট্রেনের মতো অবস্থা থেকে লাইনের ওপরে এনে দাঁড় করাতে পেরেছি। আমি আপনাকে একটা উদাহরণ দেই। আমার পূর্ববর্তী ভাইস চ্যান্সেলরের সময় অর্থাৎ প্রফেসর এম হাদী স্যারের আমলে কিছু নিয়োগ হয়েছিল। সেই নিয়োগগুলো সরকারী নিয়মের মধ্যেও পড়েনি, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঙৎফরহধহপব-এ যে জবপৎঁরঃসবহঃ জঁষব আছে তাতেও পড়েনি। উদাহরণস্বরূপ এগারোজন সরকারী মেডিক্যাল কলেজের জবঃরৎবফ ঢ়ৎড়ভবংংড়ৎ-কে চাকরি দেয়া হয়েছিল বিভিন্ন বিভাগে নিয়মিতভাবে। তাদের অনেকেই যোগ্যতাসম্পন্ন। কিন্তু ১৯৭৪ সালের ‘গণকর্মচারী অবসর আইনে’ একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ছাড়া কেউ কোথাও নিয়মিতভাবে চাকরি পেতে পারে না অবসর নেয়ার পরে। আমি যখন দেখলাম যে, এর আগেই একটা অডিট অবজেকশন হয়েছে তাদের নিয়মিত বেতন দেয়া নিয়ে, আমি তখন এগারোজনকে ডাকলাম। সমষ্টিগতভাবেও ডাকলাম, আলাদা আলাদা করেও যে যে ডিপার্টমেন্টে আছেন, সে বিভাগের চেয়ারম্যান বা বিভাগীয় সম্মানীয় শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে আলাপ করলাম। আলাপ করে বললাম যে, আপনাদের নিয়োগটা অবৈধ হয়েছে। অডিট এ্যাকাউন্টসের আপত্তি আছে। সুতরাং আমি চাই আপনারা সবাই এখানে থাকেন। কিন্তু আপনাদের ওই নিয়মিত চাকরি বাতিল করে আমি আপনাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেব। তখন তার মধ্য থেকে চারজন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আসলেন। সাতজন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে রাজি হলেন না। না হওয়ার জন্য আমি যখন তাদের চাকরি বাতিল করে দিলাম, তারা আইনের আশ্রয় নিলেন। আইনের আশ্রয়ে গিয়ে তারা হেরে গেলেন এবং সর্বোচ্চ আদালতে হেরে যাওয়ার পরে এবং আগে তারা সবাই এমন কথাও বলতে দ্বিধাবোধ করেননি যে, আমি মামলার আগে, মামলার সুনির্দিষ্ট তারিখের আগে, বিচারপতিদের সঙ্গে দেখা করেছি। আসলে কখনও আমি কোন বিচারপতির বাসায় বা কোন বিচারপতির দফতরে গিয়ে দেখা করিনি এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন আদালতের বিচারকদের সততা, কর্তব্যপরায়ণতা, ওহঃবমৎরঃু অন্য কোন দেশের বিচারকদের চেয়ে কম নয়, এটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের খবমধষ অফারংবৎ ব্যারিস্টার তানজিবকে নিয়ে এ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে আমি দেখা করেছি, সেটা আমার কর্তব্য। বলেছি, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মামলাটা আছে। এটা সরকারের মামলা, সরকারের সম্পদ। সুতরাং এটা রক্ষা করার জন্য আপনি আপনার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন, সেই অনুরোধ আমি করেছি। এটা আমার দায়িত্ববোধ থেকে করেছি। আমার চেয়ার আমাকে করতে শিখিয়েছে এবং আমার বিবেক বাধ্য করেছে। তারপরে যে ছয় শ’ ডাক্তারকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল সেই নিয়োগের সময় অর্থাৎ হাদী স্যার যখন নিয়োগ দিয়েছেন, তখনই স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল আর্সলান একটা মামলা করেছিলেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে এবং জনস্বার্থে তিনি কেসটা করেছিলেন এই নিয়োগের বিরুদ্ধে। সেখান থেকে একটা রুল জারি হয়েছিল। পরবর্তীতে সরকার পরিবর্তনের পরে যখন প্রফেসর তাহির সাহেব দায়িত্ব পান তিনি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন যে, অনিয়ম কিছু হয়েছে কিনা সেটা দেখার জন্য। তিনি কিন্তু ওই প্রশাসনের উপ-উপাচার্য ছিলেন। তার গঠিত কমিটিতে তার বন্ধু প্রফেসর নজরুল ইসলাম স্যার, সজল ব্যানার্জী এবং অন্যদের নিয়ে তদন্ত অর্থাৎ অনিয়ম নিরূপণের জন্য কমিটি গঠিত করা হলো। তারা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করে প্রত্যেকটা নিয়োগের পেছনে অনিয়ম হয়ে থাকলে, অনিয়ম, নিয়মিত হয়ে থাকলে, নিয়মিত এবং অনিয়ম হয়ে থাকলে কি কি অনিয়ম হয়েছে প্রত্যেকটা ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। যখন তাদের রিপোর্টটা তাহির সাহেবের হাতে গেল তিনি তখন আরেকটা রিভিউ কমিটি করলেন, যে কমিটিতে ডিজি হেলথ ও প্রফেসর ফয়েজ ছিলেন। সে কমিটি আবার সেগুলো এন্ডোর্স করেছে এবং বলেছে এগুলো ক্ষমা করা যায়। এগুলো নিয়ে এমন কোন অসুবিধা হয় না। এরকম ভুল হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সে কেস চলতেই থাকে। পরবর্তীতে আমি যখন উপাচার্যের দায়িত্ব থেকে চলে আসি সেই কেসের চূড়ান্ত মামলার রায়ে তাদেরও চাকরি চলে যায়। সেখানে হয়ত দেড় শ’ ডাক্তার আছেন। কিন্তু সেটাও আমার থাকা অবস্থায় হয়নি। সুতরাং আমি যে ারহফরপঃরাব হয়ে বা ঘড়ঃড়ৎরড়ঁংষু তাদের চাকরি খেয়েছি সেটা বলার অধিকার কারও নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, পৃথিবীতে যদি আমরা হিসাব করে দেখি আমরা দেখব, যে কোন পেশায় একজন প্রফেসনাল পার্সন আরেকজন প্রফেসনাল পার্সনের শত্রু হন। সেটা অনেকটা কম, উকিলদের বা এ্যাডভোকেটদের মধ্যে। অতীতে মোটেও ছিল না প্রশাসনিক ক্যাডার অর্থাৎ সিএসপিদের মধ্যে। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার ও কৃষিবিদ এদের মধ্যে এটা প্রচ- আকারে আছে এবং এটা থাকাও স্বাভাবিক। কেননা আমরা তো সবাই জীব, জড়বস্তু নই। আর জীবের শত্রু কিন্তু জীব। অর্থাৎ আমার এত বড় একটা শরীরে একটা মাইক্রোসকপিক মাইক্রো অর্থাৎ জীবাণু আক্রমণ করে আমাকে শুধু পঙ্গু নয়, অসুস্থ নয়, মৃত্যুমুখেও ধাবিত করে দিতে পারে। সুতরাং জীবের শত্রুও জীব। সেইদিক দিয়ে তুলনা করলে আমি বলব, তিনি যদি এটা বলে থাকেন, বিবেচনায় তিনি ঠিক। কিন্তু আমি যা করেছি আমার বিবেক যা বলে ‘উনি ভুল বলেছেন।’ আমাদের মেডিক্যাল প্রফেসনে একজন ডাক্তার আরেকজন ডাক্তারের বদনাম করতে ভালবাসে। একটা রোগী আসল, আমার জুনিয়র কেউ আমাকে রেফার করল, আমার উচিত সেই জুনিয়রকে ধন্যবাদ জানানো। অথবা বলা ও তো ভালই করেছে রেফার করে দিয়ে। কিন্তু আমরা উল্টোটা বলি। আমরা বলি আপনাকে তো শেষ করে দিয়েছে। এই মুহূর্তে আমার কাছে পাঠিয়েছে, এখন সব শেষ, আমি কি করব? এটা বলার আগে বিবেককে জিজ্ঞাসা করা উচিত, একজন এমবিবিএস পাস করা জিপি জেনারেল প্রাকটিস করে তার জীবিকা নির্বাহ করছে। হয়তবা চাকরিতে আছে বা চাকরিতে নেই। তাকে কি বিভিন্ন দেশে যেভাবে জিপি হিসেবে ট্রেনিং দেয়া হয় সেটা দিয়েছি? আমরা দেইনি। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সেই সুযোগটাও নেই সরকারী পক্ষ থেকে। কিন্তু বেসরকারী উদ্যোগে হলেও যদি আমরা প্রত্যেকটা বেসরকারী ডাক্তারকে বছরে দু’মাস অথবা চার মাস, ভেঙ্গে ভেঙ্গে ছয় মাস পর পর দু’মাস, দু’মাস করে প্রশিক্ষণ দেই সাধারণ অসুখ-বিসুখের উপরে, তাঁদের ডায়াগনস্টিক ক্রাইটেরিয়ার উপরে, লেটেস্ট ট্রিটমেন্টের উপরে, তাহলে কিন্তু তারাও একজন ভাল জিপি স্পেশালিস্ট হবে। জেনারেল প্রাকটিশনার শুধু নয়, তারা জেনারেল স্পেশালিস্ট হবেন। তখন কিন্তু আমাদের ওপর চাপটাও কমে যাবে। পৃথিবীর সব দেশে এই ধরনের ফাউন্ডেশন কোর্স একটা প্রচলিত ব্যাপার এবং এটা চলমান শিক্ষা পদ্ধতি। যেটাকে আমরা অনেক সময় বলি ঈড়হঃরহঁবফ গবফরপধষ ঊফঁপধঃরড়হ। সুতরাং এই জিনিসগুলো আমাদের মনে রাখতে হবে। আমরা তো জানি যে, আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে বড় বড় শহরগুলোতে এমন অনেক জিপি ছিলেন যারা কিন্তু বিশেষজ্ঞদের থেকে অনেক বেশি রোগী দেখতেন। এমনকি তাদের রেফারেলের ওপর মেডিক্যাল কলেজের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের প্রাকটিস নির্ভর করত। উদাহরণস্বরূপ আমি বলতে পারি যে, ঢাকা শহরে ডাক্তার নন্দী নামে একজন ডাক্তার ছিলেন। এরকম আরও কিছু ডাক্তার ছিলেন পুরান ঢাকায়। যারা মেডিক্যাল কলেজ বা মিটফোর্ডের বা পিজির বিভিন্ন জায়গার ডাক্তারদের তুলনায় অনেক অনেক বেশি মেধাবী ছিলেন অর্থাৎ চিকিৎসার ব্যাপারে। তারা অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ছিলেন। রোগীর রোগটাকে আপন করে নিতেন। একটা সুন্দর এবং অসাধারণ গুণাবলী তাদের মধ্যে থাকত। এটাও কিন্তু শেখার বিষয়। আমি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে পড়েছি। চট্টগ্রামের কিছু জিপি ছিলেন। যেমন : দেওয়ানহাটে বসতেন ডাঃ ফজল আমিন, কেসি দে রোডে বসতেন ডাঃ শচীন্দ্র বণিক, তারপরে পাথরঘাটাতে রবীন্দ্র বণিক, রসিক লাল বণিকÑ তারা জিপি হিসেবে এত সুনামের অধিকারী ছিলেন যে, কোন রোগী তাদের না দেখিয়ে বিশেষজ্ঞদের কাছে আসত না। অর্থাৎ তারা সেই যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। আমি যে কারণে এটা বলছি সেটা হলো যে, যত কথাই বলা হোক না কেন আমার বিবেক বার বার বলছে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দুই মেয়াদে ছয় বছর থাকাকালীন সময়ে রাজনৈতিকভাবে কাউকে ভিকটিমাইজ করিনি এবং পলিটিসাইজ করেছি, সেটাও আমি মেনে নিতে রাজি না। কেন বলেছেন, কি কারণে বলেছেন, সেই জবাব শুধু তিনিই দিতে পারবেন। এ কথা অবিসংবাদিত সত্য যে, আমাদের এই তিন পেশাÑ প্রকৌশলী, চিকিৎসা এবং কৃষিজীবী আমরা কিন্তু সামান্য পদের লোভে, সামান্য একটি ভাল পোস্টিংয়ের জন্য একে অপরের ক্ষতি করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করি না। আমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদ উপাচার্যের পদ অলঙ্কৃত করেছি। আমার কেন অন্যের ক্ষতি করার চিন্তা করতে হবে। ঞৎবসবহফড়ঁং কেন বলেছেন জানি না। তবে তার ব্যাখ্যা হলো, গত ৬ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ও কলেবর আমি যেভাবে বৃদ্ধি করতে পেরেছি, তার ভাষায় : এটা কারও পক্ষে আগামী ২০ বছরেও করা সম্ভব নয়। আসলে ১৯৭৫ সালে জাতির জনকের নৃশংস হত্যাকান্ডের পর তৎকালীন পিজি হাসপাতালের অ ব্লকের নিচের দোকানগুলো পিজি কর্তৃপক্ষের হাতছাড়া হয়ে যায় এবং তার ভাড়াও বাইরের লোকদের তহবিলে জমা হতে থাকে। আমার আগে অধ্যাপক এম এ হাদী স্যারের টিমও চেষ্টা করেছিল, আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল; কিন্তু ব্যর্থ হলো। কেন?... আমাদের প্রশাসনের ৬ বছরের মেয়াদে বিচার বিভাগের চারটি স্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে রায় এনে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে দিতে পেরেছি দোকানগুলোর। তাছাড়াও কেবিন ব্লকের উত্তর পাশের ১২ বিঘা জমি, যা কিনা ঢাকা শহরে একটি হীরকখ-, যা ছিল নবাবদের জায়গা এবং পরবর্তীতে আমেরিকান এ্যাম্বাসির, দখল নিতে পেরেছি। তাছাড়াও বর্তমান বেতার ভবনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে দলিলাদিসহ আনুষঙ্গিক সব কাজ করে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যোজনাভুক্ত করেছি এবং এগুলোই হলো ঞৎবসবহফড়ঁং শব্দ প্রয়োগের ব্যাপার। আসলে আমি আরও অনেক জটিল কাজ সমাধা করেছি, যা অনেকেই জানেন না। সবচেয়ে কঠিন কাজটি হলো রেসিডেন্সি প্রোগ্রামের জন্য দুর্নীতিমুক্ত একটি ভর্তি পরীক্ষা। তার চেয়েও বড় কথা হলো, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ সরকার যে টিম আমাকে দিয়েছিল সেই টিম ছিল নির্লোভ, সৎ, দূরদর্শী এবং চিকিৎসা বিদ্যায় স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত অধ্যাপকবৃন্দ। যেমন : ভিসি হিসেবে আমার সঙ্গে প্রোভিসিদ্বয় ছিলেন অধ্যাপক আনিসুল হক (নিউরোমেডিসিন), অধ্যাপক মোঃ শহীদুল্লাহ চান্দু (আমি যাকে লক্ষণ বলে ডাকতাম), ট্রেজারার ছিলেন অধ্যাপক মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন (শিশু কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ)। পরবর্তীতে আনিসুল হক চলে যাবার পরে আমি যাকে বাছাই করে প্রোভিসি শিক্ষা পদে নিয়োগের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাই, তিনি হলেন বেসিক সায়েন্সের অর্থাৎ মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক রুহুল আমিন মিঞা। যিনি ¯œাতকোত্তর কোর্সের সব ছেলেমেয়ের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অতি ভাল শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। অক্লান্ত পরিশ্রমী, ধীরস্থির। মেধা ও মননে যিনি সর্বোচ্চ। আমাকে কখনও পরীক্ষা অর্থাৎ ভর্তি পরীক্ষা, কোর্স পরীক্ষা, ইনডাকশান কোর্স কোন কিছু নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়নি। অধ্যাপক শহীদুল্লাহ ব্রি. জে. মজিদ ভূঁইয়াকে নিয়ে যেভাবে হাসপাতাল পরিচালনায় হাসপাতাল পরিচালক কমিটিকে নিয়ে কাজ করেছেন, তাও সুনিপুণ ও অতি দক্ষতার সঙ্গে। ট্রেজারার অধ্যাপক মোয়াজ্জেম ভাই, আর্থিক যে কোন লেনদেন পুরো টিম নিয়ে বসে সম্পন্ন করতেন। অবসরপ্রাপ্ত ২ জন অডিট ও এ্যাকাউন্টস কর্মকর্তা ছিলেন, যারা সার্বক্ষণিক তাকে সাহায্য করতেন। প্রশাসনিক বিভিন্ন বিভাগে যারা কর্ণধার ছিলেন, তাদের মধ্যে রেজিস্ট্রার গফুর সাহেবের পরে খ-কালীন বা অস্থায়ীভাবে অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম এবং অধ্যাপক সাইদুর রহমান খসরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহণযোগ্য দু’জন ব্যক্তি যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। যে কোন সমস্যা সমাধান অথবা নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে আমাদের প্রশাসন ছাড়া অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান ও অধ্যাপক শাহানা আখতার রহমানসহ বসে আমরা চুলচেড়া বিশ্লেষণ করে হোমওয়ার্ক করে নিতাম। অধ্যাপক শাহানা আখতার রহমান (সীতা) যে কত বুদ্ধিমতী এবং প্রজ্ঞাবতী, তার সঙ্গে কাজ না করলে আমি বুঝতে পারতাম না। একটু রাগীও বটে; কিন্তু তার মানবিক গুণাবলীর কাছে রাগ অবিবেচিত রয়ে গেছে আমাদের কাছে। প্রশাসনিক বিভাগগুলোর প্রত্যেক প্রধান যেমন পরিচালক পরিদর্শন অধ্যাপক আবু সুফি আহমেদ আমিন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণতম শিক্ষক এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। কোর্স কারিকুলামের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, নিষ্ঠাবান ব্যক্তি, যিনি প্রোভিসি শিক্ষাকে প্রচ-ভাবে সাহায্য করেছেন। প্রকল্প পরিচালক হিসেবে অধ্যাপক আবু নাসার রিজভী যথেষ্ট নিষ্ঠাবান এবং সিনিয়রদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও প্রকৌশল বিভাগে অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী শ্রীকান্ত, যাকে আমি রিক্রুট করে এনেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় ভবিষ্যতে এত সৎ ও নিষ্ঠাবান অভিজ্ঞ প্রকৌশলী খুঁজে পাবে কিনা সন্দেহ। এ বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে গিয়ে ৬ বছরে কর্মকর্তা-কর্মচারী-নার্স-ডাক্তার-অধ্যাপক কেউ একদিনের বা এক মিনিটের জন্যও ধর্মঘট দূরে থাক, কর্মবিরতিও ঘোষণা করেনি। অর্থাৎ পুরো টিমকে নেতৃত্ব দিয়ে কাজ করতে পেরেছি বলেই আজ বিশ্ববিদ্যালয় এ অবস্থায়। লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×