ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২৮ মার্চ ২০১৭

ঢাকার দিনরাত

ঢাকা কেমন ছিল বিগত সাতদিন? কখনও সে ছিল শোকবিহ্বল, কখনও বা উৎসবমুখর; কখনও উৎকণ্ঠিত, কখনও আবার উৎফুল্ল। আমাদের এক বন্ধু ঢাকার আবহাওয়া নিয়ে এক বাক্যে অনেক কথা বলেছেন, সত্যোচ্চারণ করেছেন। ঢাকায় সকালে বসন্ত, দুপুরে গ্রীষ্মকাল, সন্ধ্যায় বর্ষা আর রাতে শীতকাল। এই পরিবেশবৈচিত্র্য আগে কখনও অনুভব করিনি। ঢাকায় আছি প্রায় চার দশক। যারা আরও বেশি বছর ধরে আছেন, তারা কি এমন আশ্চর্য আবহাওয়ার আবহ অনুভব করেছেন কোনো বছর? মনে হয় না। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে মাঝেমধ্যে আমাদের বিমূঢ় করে দিচ্ছে যে অন্ধকার তার নাম জঙ্গী আক্রমণ; বলা ভালো সিঙ্গেল হেডেড অ্যাকশন। নিজ জীবনের পরোয়াহীন একজন শরীরে বিস্ফোরক বেঁধে লোকালয়ে এসে মুহূর্তের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিচ্ছেন। বড় কোনো সমাবেশে গিয়ে এমন অ্যাকশন করলে কী হবে ভাবতেই শিউরে উঠছি। এজন্যে সবারই সতর্কতা জরুরি। সিলেটে জঙ্গি আতঙ্ক সময়ের অস্বস্তিকর সীমা অতিক্রম করেছে বহু আগেই। সিলেট ঢাকাবাসীর মনের সেøটেই বিদ্যমান রয়েছে, গোটা দেশের মানুষই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, উৎকণ্ঠিত। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের টাইগারদের লড়াইয়ের আনন্দ ছাপিয়ে কখনও কখনও বড় হয়ে উঠেছিল সিলেট। আবার এরই মধ্যে ঢাকায় পর পর দুই শুক্রবার নিজেরই বহনকারী বোমায় নিহত হলো দুই জঙ্গী। এর নেতিবাচক প্রভাব ঢাকাবাসীর মধ্যে কতটুকু পড়েছে সেটা এখনই নিশ্চিত হয়ে বলা যাচ্ছে না। স্বাধীনতা দিবসে ফাঁকা ঢাকা স্বাধীনতা দিবস রবিবার পড়ায় সরকারী-বেসরকারী চাকরিজীবীরা শুক্র-শনি মিলিয়ে টানা তিন দিনের ছুটি পেয়েছেন। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বহু লোকই আবার চলে গেছেন ঢাকার বাইরে। সে জন্য ঢাকা কিছুটা ফাঁকা হয়ে উঠেছে দৃশ্যমানভাবে, এটা অস্বীকার করার নয়। স্বাধীনতা দিবসে সে জন্যই কি খুব কম লোক দেখা গেল পথে আর উদ্যানে? এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়ও ছিল কম উপস্থিতি। সিলেটের জঙ্গীরা সফল হয়েছে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টিতে, এমনটা ভাবতে রাজি নই। আমাদের ভেতর, মানে ঢাকাবাসীর ভেতর একটা প্রবণতা লক্ষ্য করে আসছি বরাবর। একমাত্র পয়লা বৈশাখেই জনজোয়ার দেখা যায় রাজধানীর সড়কে। অন্যান্য দিবসে মানুষ ছুটি পালন করে, ঘরেই সময় কাটাতে পছন্দ করে। সেই সঙ্গে এটাও অনস্বীকার্য যে বহু মানুষ কর্মসূত্রে এসব দিনে ঘরের বাইরে বের হন। স্বাধীনতা দিবসে গণমাধ্যমকর্মীদের ছুটি নেই। এই যেমন ‘ঢাকার দিনরাত’ কলামটি লিখছি নির্ধারিত দিন রবিবারেই। অফিসে আসতে আসতে এফএম ব্যান্ড শুনছিলাম। বলাবাহুল্য ঢাকামহা নগরীতে এখন এফএম রেডিওর ছড়াছড়ি। যানজটে মাঝেমধ্যে সময় কাটানোর মাধ্যম হয়ে ওঠে বৈকি এসব রেডিও। স্বাধীনতা দিবসের সকালে এক মহিলা আরজে তার শ্রোতাদের অনুরোধ করছেন ইংরেজি নয়, বাংলা গানের অনুরোধ করতে। এমন অনুরোধের পর পরই এক শ্রোতার যে ক্ষুদে বার্তা পড়লেন তিনি তা সত্যি বেমানান। শ্রোতা শুনতে চেয়েছেন মাইকেল জ্যাকসনের গান। মহিলা রেডিও জকি পুনরায় অনুনয়ের মতো করে বললেন, অন্তত আজকের দিনে দেশের গান শোনানোর অনুরোধ করুন। ভাবছিলাম বছরের ৩৬২ দিন (স্বাধীনতা দিবস, শহীদ দিবস আর বিজয় দিবস ছাড়া) যদি তার শোয়ে ইংরেজী/ হিন্দী গানের আধিপত্য থাকে, তাহলে ওই শ্র্রোতাকে আর দোষ দিয়ে কী হবে। তবু এর ইতিবাচক একটি দিকও রয়েছে, সেটি হলো চক্ষু লজ্জা, কিংবা বিবেচনাবোধ। স্বাধীনতা দিবসের কারণে বাংলা দেশাত্মবোধক গানের প্রচার হচ্ছে বাংলিশ রেডওতে। আবার এই দিবসটিকে অনেকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও ব্যবহার করতে চাইছেন। সেটি নিন্দাযোগ্য। অভিজাত এলাকার একটি সিøমিং সেন্টার ইংরেজি দৈনিকে বিজ্ঞাপন দিয়েছে যে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ফেসিয়ালসহ বিউটি প্যাকেজের জন্য ছাড়কৃত মূল্য হিসেবে গ্রাহকদের দিতে হবে ১৯৭১ টাকা। এটাকে আমি ধৃষ্টতাই বলব। প্রাণের দামে কেনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বছরটিকে তারা বাণিজ্যিক সেবার বিনিময়মূল্য হিসেবে প্রদর্শনের মানসিকতা লালন করছে! এমন বিজ্ঞাপন কি কোন দায়িত্বশীল সংবাদপত্র প্রকাশ করতে পারে? পঁচিশে মার্চ গণহত্যা দিবস জাতীয়ভাবে এবার পঁচিশে মার্চ গণহত্যা দিবস পালিত হলেও স্বাধীনতার পর থেকেই কাল রাত পঁচিশে মার্চ স্মরণে ঢাকায় প্রদীপ প্রজ্বলনসহ নানা আয়োজন হয়ে থাকে। বেশ ক’বছর ধরে শহীদ মিনারে ব্যাপক কর্মসূচী পালিত হয়। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানী বর্বর সৈনিকেরা ঢাকায় বাঙালীর ওপর মারণাস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই গণহত্যার বিষয়টি বাঙালীর নিত্য স্মরণে থাকলেও এটি এখনও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেনি। এবার জাতীয়ভাবে দিবসটি পালিত হওয়ার পর এখন আন্তর্জাতিক স্বকৃতি লাভের দাবিটি জোরালো হলো। পঁচিশে মার্চ রাতে সিলেটে জঙ্গীরা আক্রমণ শানাচ্ছিল। নিঃসন্দেহে তারা পাকিস্তানী সেই সেনাদের মতোই বর্বর, নৃশংস এবং বাংলাদেশ-বিরোধী। গণহত্যা দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে বেশ ক’টি তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ নেয়া হয়। এর ভেতরে ছিল মধ্যরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে মোমবাতি প্রজ্বলন ও নীরবতা পালন, সন্ধ্যায় শহীদ মিনার থেকে মশাল মিছিল বের করা, প্রাচ্যনাটের ‘কালরাতে লালযাত্রা’ শীর্ষক সাংগীতিক ও নাটকীয়তায় পূর্ণ ব্যতিক্রমী আয়োজন। দিনভর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা জাদুঘরের সামনে খোলা জায়গায় ছিল আলোকচিত্র প্রদর্শনী। এতে প্রদর্শিত হয় ২৫ মার্চ কাল রাতের ভয়াবহতা, ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের নানা ঘটনাপ্রবাহ, একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতাসহ বহু আলোকচিত্র। পাশাপাশি প্রদর্শিত হয় গণহত্যার তথ্যাবলী। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে বড় বড় ভবনে আলোকসজ্জা করা হয়। এটি উৎসবের আবহ তৈরি করে। পঁচিশে মার্চ রাতটি শোকের, এই রাতে আলোকসজ্জামালা সমীচীন না হলেও অজ্ঞতাবশত বেশ কিছু ভবনে আলোকসজ্জা করতে দেখা যায়। ঢাকার একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বছর ২৫ মার্চ সূর্য ডোবার পর থেকে রাতভর সংসদ ভবনের সামনে শিল্পীদের ছবি আঁকার আয়োজন করে থাকে। বহু শিল্পী সেখানে ছবি আঁকতে যান বুকের ক্ষরণ থেকে! এবার প্রশাসন থেকে মধ্যরাতের পর সব আয়োজন বন্ধ করতে বলা হয়েছে নিরাপত্তার কারণে। জাতীয় প্রেসক্লাবের আলোচনা সভায় বক্তারা যথার্থ বললেন, শুধু ২৫ মার্চই নয়, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ধরে গণহত্যা হয়েছে। আর এ গণহত্যা কেবল ৩০ লাখে সীমাবদ্ধ নয়। এর চেয়ে বেশি মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা করা হয়েছে। শনিবার গণহত্যা দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবের আলোচনা সভায় এ মত দেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও বিশিষ্টজন। ‘২৫ মার্চ গণহত্যা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘গণহত্যার দায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দায়। পৃথিবীতে অনেক গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এত অল্প সময়ে এত বেশি মানুষ হত্যার ঘটনা ইতিহাসে নেই। এটি শুধু এখানেই হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে কেউ কেউ সিভিল ওয়ারও বলেন। যদি সিভিল ওয়ার হয়, তাহলে তো স্বাধীনতার বিষয়টি থাকে না। যদি গণহত্যা না হতো, তাহলে এত কম সময়ে এক কোটি লোকের পাশের দেশে চলে যাওয়া বা আবার ফিরে আসার ঘটনা ঘটত না।’ ইতিহাসের এসব সত্য গোপন করা হয়েছে অভিযোগ করে মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘কিন্তু হেজাবিদের (হেফাজত, জামায়াত, বিএনপি) কারণে দীর্ঘদিন এ বিষয়গুলো সামনে আসতে পারেনি।’ চির বসন্তের চিঠি শুক্রবার কবিকণ্ঠে প্রেমের কবিতা পাঠের আসর বসেছিল শাহবাগের জাদুঘরে ‘চির বসন্তের চিঠি‘ শিরোনামে। রাজধানীর একটি ইংরেজী-মাধ্যম স্কুলের বাংলার শিক্ষক ও তরুণ লেখক আসমা সুলতানা শাপলার পোস্ট থেকে তুলে অংশবিশেষ দিচ্ছি। তিনি লিখেছেন, ‘ল্যাবএইড ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাঃ এম শামীম ভাই কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের ছোট বেলার বন্ধু। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার পর ল্যাবএইড ফাউন্ডেশন শাহরিয়ার ভাইকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। সেই অনুষ্ঠানে কবি আবু হাসান শাহরিয়ার কবিদের পক্ষে একটা প্রস্তাব করেছিলেন। নিয়মিত যেন কবিতা আর কবিদের নিয়ে অনুষ্ঠান করে ফাউন্ডেশন। আশ্চর্য দ্রুততায় সেদিন সমস্ত দর্শক-শ্রোতার সামনে শামীম ভাই কথা দিয়েছিলেন যে প্রতি মাসে কবি আর কবিতা নিয়ে অনুষ্ঠান করবে ল্যাবএইড ফাউন্ডেশন। আর তারই প্রথম অনুষ্ঠান ছিল শুক্রবার। দেশের ১৪ জন স্বপ্রতিষ্ঠিত কবির অসাধারণ কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান ‘চির বসন্তের চিঠি।’ জাদুঘর মিলনায়তনে ১৪ কবিকে উত্তরীয় পরিয়ে সম্মানিত করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কবি কামাল চৌধুরী। তারপর একে একে ১৪ জন কবি পড়েন তাদের কবিতা। আর মুখ্য শ্রোতা হাসান আজিজুল হক (তাকে আর কেই বা না চেনেন) অসাধারণ কথায় বিমুগ্ধ করেন শ্রোতা-দর্শকদের। তার ভাষায়Ñ কবিতার কোন সারমর্ম হয় না। কবিতা হৃদয়তন্ত্রীতে কোন এক গভীর মুহূর্তে বাধা পড়তে হয়। তা না হলে কবিতা বুঝবার নয়। আর তাই কবিতা বুঝতে হলে ধ্যান চাই। চাই ওই হৃদয়তন্ত্রীতে বেজে উঠবার সময়। কবির হৃদয় ভরে তার ছিঁড়ে পড়ার হাহাকার যতক্ষণ না বেজে উঠবে ততক্ষণ তা কবিতা হয়ে উঠবে না। দিলেন রবীন্দ্রনাথের অমোঘ সেই সঙ্গীতের উদাহরণ ‘তার ছিঁড়ে গেছে কবে/একদিন হা হা রবে...’ কবি জীবনানন্দের কবিতা রবীন্দ্রনাথের কবিতায় গানে বলে যাওয়া কবিতারই ভেতরের কথা দিয়ে দারুণ মনোমুগ্ধকর তার কথা আপ্লুত করে রাখে হল উপচে পড়া মানুষকে। ১৪ কবির পাঠ করা কবিতার মধ্যে বেশ কিছু অকবিতাও রয়েছে বলে গেলেন অকাতরে। আর কবিতা হয়ে উঠবার জন্য এই সব অকবিতার কত দরকার সেটাও জানাতে ভুললেন না সমকালীন কবিদের। অসধারণ তার বাণী।...’ স্বাধীনতার বইমেলা স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ঢাকায় বইমেলার আয়োজন নিঃসন্দেহে একটি সুসংবাদ। নামী কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে মেলায়। কামাল আতাতুর্ক এ্যাভিনিউয়ের বনানী মাঠে হচ্ছে এই বইমেলা। এখানেই দুর্গা পুজোর সময়ে বিশাল আয়োজন হয়ে থাকে। বইমেলা ২০১৭ শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার থেকে। স্বাধীনতার মাস মার্চের শেষ দিন পর্যন্ত বইমেলা এটি চলবে প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। কাফরুল, ক্যান্টনমেন্ট, কাকলী, ডিওএইচএস, নিকুঞ্জ, বনানী, গুলশান, নিকেতন, বারিধারা, বারিধারা ডিওএইচএস ও এর আশপাশের বইপ্রেমীদের সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে এই বইমেলায় গিয়ে ছাড়কৃত মূল্যে বই কেনার। ২৬ মার্চ ২০১৭ [email protected]
×