ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতা দিবসে উপচেপড়া ভিড় ভূগর্ভস্থ জাদুঘরে

১৪৪ গ্লাসপ্যানেলে ৩০০ আলোকচিত্র, ধারাবাহিক ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৭ মার্চ ২০১৭

১৪৪ গ্লাসপ্যানেলে ৩০০ আলোকচিত্র, ধারাবাহিক ইতিহাস

মোরসালিন মিজান ॥ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তবে তারও আগে ৭ মার্চ দেয়া ভাষণ বিপুল জাগরণের সৃষ্টি করেছিল। ঐতিহাসিক সেই ভাষণে মহান নেতা স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। মহান নেতার সেই ঘোষণার স্মৃতিবিজড়িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এখন গড়ে তোলা হয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভ। ওপরে সুউচ্চ গ্লাস টাওয়ার। আর মাটির নিচে গড়ে তোলা হয়েছে স্বাধীনতা জাদুঘর। স্বাধীনতা দিবসে রবিবার এ জাদুঘরে ছিল উপচেপড়া ভিড়। বিকেলে জাদুঘরে গিয়ে দেখা যায়, লোকে লোকারণ্য। বিভিন্ন বয়সী মানুষ জাদুঘর ঘুরে দেখছেন। ভূÑগর্ভস্থ জাদুঘরে বাঙালীর দীর্ঘ সংগ্রাম ও স্বাধীনতার ধারাবাহিক ইতিহাস। অসংখ্য আলোকচিত্র, স্মারক ইত্যাদির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতায় জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ একইসঙ্গে স্বাধীনতা জাদুঘরটি পরিচালনা করছে। এখানে ৩০০ আলোকচিত্র ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ১৪৪টি গ্লাস প্যানেলে সরাসরি ডিজিটাল প্রিন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। যতটা সম্ভব ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বর্ণনা করা হয়েছে স্বাধীনতার পূর্বাপর। শুরুতে জাতি-গোষ্ঠী হিসেবে বাঙালীর পরিচিতি তুলে ধরার প্রয়াস। বাঙালীর ইতিহাস কত প্রাচীন, সেটি স্মরণ করিয়ে দেয় পুন্ড্রবর্ধন ও ওয়ারি বটেশ্বরের আলোকচিত্র। পুন্ড্রবর্ধনের লিপি ও চর্যাপদের উপস্থাপনা বাঙালীর শেকড়ের সন্ধান দেয়। বাঙালী যে গোড়া থেকেই আসাম্প্রদায়িক, সে কথা বলে প্রাচীন কিছু উপাসনালয়ের আলোকচিত্র। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ ও খ্রীস্টান ধর্মের উল্লেখযোগ্য, উপাসনালয়ের আলোকচিত্র রাখা হয়েছে জাদুঘরে। এরপর বলা বেশকিছু দুর্লভ ছবি ব্যবহার করে বলা হয়েছে উদ্যানের ইতিহাস। সে অনুযায়ী, আজকের সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের সূচনা মোগল আমলে। তখন এটি ছিল চমৎকার একটি বাগান। নামÑ বাগে বাদশাহ। ব্রিটিশ আমলে এখানে সৈন্যদের থাকার ব্যারেক করা হয়। সেই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হত ঘোড়দৌড়। ব্রিটিশ সৈন্যদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হত কুচকাওয়াজ। তেমন একটি ছবিতে দেখা যায় লর্ড কার্জনকে। উদ্যানে গাড়িতে চড়ে সালাম গ্রহণ করছিলেন তিনি। নওয়াবদের আমলে এটি আবার বাগানের চেহারা পায়। এরপর ১৯৪৮ সালের রেসকোর্স। একটি ছবিতে দেখা যায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে। অবিভক্ত পাকিস্তানের এই নেতা এখানে নাগরিক সংবর্ধনা নিতে এসে বলছেনÑ একমাত্র উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা! এমন ভয়ঙ্কর দূরভিসন্ধির প্রতিবাদও এখান থেকেই শুরু। এ সূত্রে আসে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসটি। বেশকিছু ছবিতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়। একে একে আসে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন। আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আসে সেই উজ্জ্বলতম দিন ৭ মার্চ, ১৯৭১। বিশাল একটি আলোকচিত্রে দৃশ্যমান হন বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আলোকচিত্রটি প্রস্থে ৩০ ফুট। ২০ ফুট উচ্চতা। ফলে অনেক দূরে থেকে দেখা যায়। খুব চেনা এই ছবি। ইতিহাসটি কাউকে বলে দিতে হয় না। হ্যাঁ, স্বাধীনতার ডাক দিচ্ছেন জাতির মহান নেতা। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দিচ্ছেন। একটি দেয়ালে বিশেষভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে একাত্তরের গণহত্যার চিত্র। এ জন্য আলাদা করে তৈরি করা হয়েছে ব্ল্যাকজোন। দেয়ালটি অন্ধকার। কালোয় ঢাকা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যে নিরীহ বাঙালীর ওপর পাকিস্তানী বর্বররা যে আক্রমণ চালিয়েছিল, সেই কালরাতের কথা বলতেই এমন ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের গণহত্যার নানা চিত্র। পাশের গোলাকার একটি কক্ষ নজরকাড়ে খুব। এখানে ৩০ লাখ সন্তান হারানোর শোকে কাঁদছে যেন বাংলা মা। তেমন একটি উপস্থাপনা দেয়া হয়েছে। স্বাধীনতা জাদুঘর যেহেতু, স্বাধীনতা ঘোষণার ইতিহাসটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। বহুকাল পরও স্বাধীনতার ঘোষক প্রশ্নে যারা বিভ্রান্তি ছড়ান তাদের মুখে ছাই দেয়ার পক্ষে যথেষ্ট দলিল রাখা হয়েছে। টাইমস, নিউজউক, ফারইস্টসহ বিশ্বের বেশকিছু সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ বলছে, ২৬ মার্চ স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা দিয়েছিলেন শেখ মুজিব। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাজউদ্দীন আহমেদসহ জাতীয় চার নেতার ভূমিকাও দেখানো হয়েছে আলোকচিত্রে। পাকিস্তানী হায়েনাদের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়ে যাওয়া সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি আছে। আছে সেক্টর কমান্ডারদের সবার ছবি। সব শেষে কাক্সিক্ষত বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর। এদিনের ইতিহাসটিকেও বিশাল দুটি আলোকচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে। ছবিতে দেখা যায়, আত্মসমর্পণের দলিলে নিজের নাম লিখছেন নিয়াজী। তবে জাদুঘরটির বড় দুর্বলতা হচ্ছে, এখানে বস্তু নিদর্শন বলতে কিছু নেই। গ্লাস শোকেসের ভেতরে রাখা হয়েছে একটি টেবিল। এটিও রেপ্লিকা। ২৬ মার্চ পাকিস্তান বাহিনী যে টেবিলে আত্মসমর্পণের দলির সই করেছিল সেটির আদলে গড়ে নেয়া হয়েছে। এ অবস্থায়ও স্বাধীনতা দিবসে কৌতূহল নিয়ে জাদুঘর ঘুরে দেখেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। সেগুনবাগিচা থেকে স্ত্রী দুই সন্তানসহ এসেছিলেন আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, একটু বেড়ানো হলো। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা বাচ্চাদের জানাতে পারলাম। ওরা ছবি দেখে অনেক প্রশ্ন করেছে। আমি উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছি। এভাবে ভাল সময় কেটেছে বলে জানান তিনি। কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় বেড়াতে আসা কলেজ শিক্ষক সুলতান আহমেদ অবশ্য তেমন খুশি হতে পারেননি। বলেন, পত্রিকায় পড়েছিলাম জাদুঘরটি আরও সমৃদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হবে। তেমন কিছুই তো পেলাম না। এসবের বাইরে, জাদুঘর পরিদর্শনে আসা মানুষের ভোগান্তির কথা না বললেই নয়। প্রায় প্রত্যেকেই অভিযোগ করেন, উদ্যানে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পুলিশ এদিন হয়রানির চূড়ান্ত করেছে। নিরাপত্তা দেয়ার মানে সব বন্ধ করে দেয়া নয়। দুর্ভোগ বাড়ানো নয়। অথচ তা-ই করেছে পুলিশ। এই গেট দিয়ে ঢোকা যাবে না, ওই গেটে বের হওয়া যাবে না ইত্যাদি বলেই তারা দায়িত্ব শেষ করছিলেন। চারুকলা অনুষদের উল্টো দিকে যে প্রবেশ পথটি জাদুঘরে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযোগী, সেটিতেও তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন তারা। এসব অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের ফলে দর্শনার্থীদের গোটা উদ্যান ঘুরে ক্লান্ত হতে হয়েছে। প্রবেশদ্বারে দায়িত্ব পালন করা পুলিশ সদস্যদের দেখে মনে হয়েছে, তারা দর্শনার্থীদের ভোগান্তি বাড়াতে পেরে খুশি! সাধারণ দিনগুলোতেও এ ধরনের পুলিশী বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এ বিড়ম্বনা থেকে দর্শনার্থীদের মুক্তি দিতে না পারলে স্বাধীনতা জাদুঘর এবং স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণের মূল উদ্দেশ্যটি ব্যর্থ হবে।
×