ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বোচ্চ সতর্ক করে ৬৪ এসপিকে জরুরী বার্তা

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২৭ মার্চ ২০১৭

সর্বোচ্চ সতর্ক করে ৬৪ এসপিকে জরুরী বার্তা

শংকর কুমার দে ॥ দেশের ৬৪ জেলার পুলিশ সুপারকে (এসপি) সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থেকে নিজেদের ও জনগণের জানমাল রক্ষা করে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ জারি করেছে পুলিশ সদর দফতর। এছাড়া জঙ্গীরা যেন কোন ধরনের নাশকতা ও আত্মঘাতী হামলা করতে না পারে, সে বিষয়েও সতর্ক করে বার্তা পাঠানো হয়েছে। সিলেটের শিববাড়ির আতিয়া মহলের আস্তানায় জঙ্গীবিরোধী অভিযানকালে জঙ্গীদের আত্মঘাতী হয়ে পাল্টা হামলার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সকল হিসাব-নিকাশ ওলট-পালট হয়ে গেছে। জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর একই প্লাটফরমে আসা, জঙ্গী আস্তানা ও জঙ্গীদের সংখ্যা, উন্নত প্রযুক্তির অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুদ গড়ে তোলা, অস্ত্র, অর্থ ও মদদদাতা চিহ্নিতকরণের অভাব, বিশেষ করে নব্য জেএমবির আত্মঘাতী হওয়ার নতুন কৌশলে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ভাবিয়ে তুলেছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, শিববাড়ির আতিয়া মহলে বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে শুরু হওয়া জঙ্গীবিরোধী অভিযানে প্রথমে পুলিশ, পরে র‌্যাব, সোয়াট ও সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে তিন দিন ধরে অভিযান পরিচালনার ঘটনাটি জঙ্গী তৎপরতার বিষয়ে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। সিলেটের জঙ্গীবিরোধী অভিযানে দুজন পুলিশ সদস্যসহ মোট ছয়জন নিহত, অর্ধশতাধিক আহত, জঙ্গীদের আত্মঘাতী হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর পাল্টা আক্রমণের ঘটনার পর এই ধরনের সতর্কতার নির্দেশ জারি করেছে পুলিশ সদর দফতর। রাজধানী ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের সামনের রাস্তায় ও খিলগাঁওয়ে র‌্যাবের চেকপোস্টে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটানোর পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেকপোস্টগুলোতে যাতে জঙ্গীরা আত্মঘাতী হামলা চালাতে না পারে সেজন্য সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সিলেটের শিববাড়ির জঙ্গীবিরোধী অভিযান শেষে আবার নতুন করে জঙ্গী নিয়ন্ত্রণের কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হবে। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, প্রায় নয় মাস আগে গত পহেলা জুলাইয়ে রাজধানীর গুলশান হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার পর অব্যাহত জঙ্গীবিরোধী অভিযানের সাফল্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে একটি আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। কিন্তু সিলেটের আতিয়া মহলের আস্তানায় জঙ্গীবিরোধী অভিযানের দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ, হতাহতের রক্তক্ষয়, ভয়ভীতি আতঙ্ক ছড়ানো, জঙ্গীদের কাছে থাকা অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ভয়াবহ ও ব্যাপক মজুদ ভান্ডার ব্যবহারের কারণে জঙ্গীবিরোধী অভিযানে আবার নতুন করে হিসাব-নিকাশ করতে হবে। নব্য জেএমবির জঙ্গীর সংখ্যা, জঙ্গী আস্তানা, গ্রেনেড-বোমা, অস্ত্রে উন্নত প্রযুক্তির অত্যাধুনিক সোয়াট মজুদ, নেপথ্যের অস্ত্র, অর্থ ও জঙ্গী তৈরির মদদদাতারা চিহ্নিত হওয়ার বাইরে রয়ে গেছে। সিলেটের শিববাড়ির আতিয়া মহলের ঘটনা চলাকালেই ইরাক-সিরিয়াভিত্তিক ইসলামিক স্টেটস (আইএস) তার মুখপাত্র আমাক এর বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক জঙ্গী সংগঠনটির পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্সের দায় স্বীকারের ঘটনায় প্রমাণ করে দেশে ও বিদেশে একটি অদৃশ্য শক্তি আছে, যারা জঙ্গী গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করছে। দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য অদৃশ্য শক্তির মদদতে জঙ্গী হামলা ও আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চলেছে জঙ্গী গোষ্ঠী। জঙ্গী হামলার পরপরই আইএসের দায় স্বীকার সম্পর্কে সরকারের নীতি নির্ধারক মহল থেকে বলা হয়েছে, দেশে এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটলেই সাইট ইন্টেলিজেন্স দায় স্বীকারের বার্তা দেয়। এর পেছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, চলতি মার্চ মাসের কেবলমাত্র ২০ দিনেই রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেটে অন্তত ৮ ভয়াবহ আত্মঘাতী জঙ্গীর হামলা ও আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। এতে আত্মঘাতী জঙ্গী, পুলিশ ও জনসাধারণসহ ১৩ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন অর্ধ শতাধিক জন। গ্রেফতার হয়েছে ৬ আত্মঘাতী জঙ্গী, যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। চলতি মাসে গ্রেফতার হওয়া ৬ আত্মঘাতী জঙ্গীর মধ্যে কুমিল্লায় একজন ও চট্টগ্রামের সীতাকু-ের এক জঙ্গী দম্পতির দেয়া তথ্যানুয়ায়ী সিলেটের শিববাড়ির আতিয়া মহল জঙ্গী আস্তানাটির খোঁজ পাওয়া যায়। এই জঙ্গী আস্তানাটিতে নব্য জেএমবির দুই শীর্ষ জঙ্গী মুসা ও সাগর থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দারা। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পর থেকে গত ৯ মাসে অর্ধ শতাধিক জঙ্গী পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। ধরা পড়েছে অন্তত ১৫ জন দুর্ধর্ষ জঙ্গী, যারা ভয়ঙ্কর ও আত্মঘাতী। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, সিলেটের আতিয়া মহলে জঙ্গীবিরোধী অভিযান চলাকালেই পর পর দুই বার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা, র‌্যাব কর্মকর্তাসহ মানুষজন হতাহতের ঘটনা ঘটানোর মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে জঙ্গী গোষ্ঠী কত বড় শক্তিশালী। শুধু সিলেটের আতিয়া মহলেই যে জঙ্গী আস্তানা আছে তা নয়, সিলেটের অন্যত্রও জঙ্গী আস্তানা আছে এটা প্রায় নিশ্চিত। চট্টগ্রামের সীতাকু-ের সাধন কুটিরের জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পাওয়ার পর গ্রেফতারকৃত জঙ্গী দম্পতির দেয়া তথ্যানুযায়ী ওই জঙ্গী আস্তানা প্রায় দেড় মাইল দূরে ছায়া নীড় নামের আরেক জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পাওয়া যায়, যেখানে এক শিশুসহ চার জঙ্গী নিহত হয়েছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, সিলেটের আতিয়া মহলের জঙ্গীরা একটা নতুন কৌশল নিয়েছে যেটা অতীতে দেখা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গী আস্তানায় জঙ্গীবিরোধী অভিযান চালানোর পর তা প্রতিহত করতে বাইরের জঙ্গী আস্তানা থেকে এসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা করছে জঙ্গীরা। এ ধরনের কৌশলেই সিলেটে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৬ জন নিহত এবং র‌্যাবের দুই উর্ধতন কর্মকর্তাসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন।
×