ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী

জঙ্গীর পথ থেকে ফিরে এসো ॥ পুনর্বাসনের সব ব্যবস্থা করা হবে

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২৭ মার্চ ২০১৭

জঙ্গীর পথ  থেকে  ফিরে এসো ॥ পুনর্বাসনের সব ব্যবস্থা করা হবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধর্মের নামে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িতদের সৎ পথে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে ও চলবে। কঠোর হাতে আমরা এসব দমন করব। ইসলাম শান্তি, সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম। ইসলামে কখনও মানুষ হত্যা করার কথা বলা হয় নাই। বরং ইসলাম ধর্ম বলেছে আত্মঘাতী হওয়া বা আত্মহনন মহাপাপ; এটা গোনার কাজ। যারা আত্মহনন করে, তারা কখনও জান্নাতে যায় না, জাহান্নামে যায়। তারা কখনও বেহেশতে যেতে পারে না। তাই আত্মহনন ও জঙ্গীবাদের পথ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলে তাদের জীবন-জীবিকার জন্য সরকার সবকিছু করবে। পুনর্বাসনসহ যা যা প্রয়োজন সবই করা হবে। কিন্তু এভাবে আত্মহননের পথ তারা যেন বেছে না নেয়, জঙ্গীবাদ বা সন্ত্রাসের পথ যেন বেছে না নেয়। রবিবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ঢাকা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ‘মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস‘ উপলক্ষে আয়োজিত জাতীয় শিশু-কিশোর সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীরা যাতে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসের পথে সম্পৃক্ত না হয়, সেদিকে আরও বেশি নজর দেয়ার তাগিদ দিয়ে বলেন, আমরা চাই, আমাদের ছেলেমেয়েরা মন দিয়ে লেখাপড়া শিখবে এবং অভিভাবক ও শিক্ষকের কথা শুনে তাদের মান্য করে চলবে এবং কখনও কোন মাদক বা সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে না। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে তোমরা বিভিন্ন স্কুল ও প্রতিষ্ঠান থেকে সমবেত হয়েছো। সেই সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক ও অভিভাবকবৃন্দ আপনারাও এখানে আছেন। আমি সবাইকে এইটুকু বলবÑ সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের ছেলেমেয়েরা যেন উন্নত জীবন পায়, সৎ চরিত্রবান হয় এবং লেখাপড়ার পাশাপাশি মানুষের মতো মানুষ হয় এবং আগামী দিনের বাংলাদেশকে গড়ার জন্য যেন এখান থেকেই নিজেদের দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তোলে। জাতীয় শিশু-কিশোর সমাবেশে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেনÑ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। ঢাকার জেলা প্রশাসক মোঃ সালাহউদ্দিন অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। প্রধানমন্ত্রী মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করেন এবং শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণে মনোজ্ঞ ডিসপ্লে উপভোগ করেন। এর আগে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আসেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর অভিবাদন মঞ্চ থেকে নেমে প্যারেড স্কয়ার ঘুরে দেখে শেখ হাসিনা। এ সময় মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং ঢাকা জেলার প্রশাসক তার সঙ্গে ছিলেন। পরে স্কুল-কলেজের নানা বয়সী শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণে মনোজ্ঞ ডিসপ্লে অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ আমি প্রধানমন্ত্রী হয়েছি এবং আজকের যারা শিশু, আমি মনে করি তাদের মধ্য থেকেই আগামী দিনে কেউ না কেউ প্রধানমন্ত্রী হবেন। মন্ত্রী হবেন, অফিসার হবেন, বিভিন্ন সেনা-নৌ ও বিমানবাহিনী থেকে শুরু করে পুলিশ বাহিনী, বিজিবি’র কর্মকর্তা হবেন। তারা দেশকে গড়ে তুলবেন। দেশকে উন্নত সমৃদ্ধশালী করে তুলবেন। অভিভাবক এবং শিক্ষকদের ঐক্যবদ্ধভাবে উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের নৈতিক ও আদর্শগত শিক্ষা দিয়ে আগামীর নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম ভবিষ্যত প্রজš§ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আজকের যে প্রজš§ তারাই একদিন শিক্ষা-দীক্ষায় পরিপূর্ণ হয়ে উন্নত মানবসম্পদে পরিণত হবেন। এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সোনার বাংলাদেশ গড়ার সোনার ছেলেমেয়ে হিসেবে নিজেরা তৈরি হবে। সেটাই আমি আশা করি। সকল ছেলেমেয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবন লাভ করবে এবং ভালভাবে চলবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থনৈতিক মুক্তির কর্মসূচীকে এবার আন্দোলনে রূপ দিতে হবে। তবেই আমরা গড়ে তুলতে পারব ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’। আমরা স্বাধীনতার সুফল বাংলার প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দিতে চাই। এই প্রসঙ্গে ১৯৭৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অংশ বিশেষ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা সংগ্রামের সমাপ্তি এবং অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধের শুরু। এই যুদ্ধে এক মরণপণ সংগ্রাম আমরা শুরু করেছি। এই সংগ্রাম অনেক বেশি সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য। তবে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থেকে কঠোর পরিশ্রম করি এবং সৎ পথে থাকি তবে, ইনশাল্লাহ জয় আমাদের অনিবার্য।’ প্রধানমন্ত্রী মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট স্মরণ করে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ জাতির পিতার নেতৃত্বে শুরু হয়। ২৫ মার্চ কালরাতে যখন পাকিস্তানী সামরিক জান্তা নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা শুরু করে তখন বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চের শেষ এবং ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এর আগে ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে ঘোষণা দেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এর মাধ্যমে তিনি একটি সম্পূর্ণ গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার দিকনির্দেশনা দিয়ে যান। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। জাতির পিতা যে ঘোষণা দিতেন বাঙালী জাতি তা মেনে চলত। তার নির্দেশনায় তখন যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে বাঙালী জাতি প্রতিরোধ শুরু করল এবং সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা মহান বিজয় অর্জন করি। শেখ হাসিনা বলেন, আজ আমরা স্বাধীন জাতি। জাতির পিতা স্বাধীনতা ঘোষণার পর তাকে পাকিস্তানী বাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তিনি কারাবন্দী থাকেন। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর ষড়যন্ত্র করা হয়। কিন্তু ততদিনে আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধ বিজয় অর্জন করি এবং আন্তর্জাতিক চাপে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন। ফিরে এসেই এই রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ কিভাবে চলবে তার দিকনির্দেশনা দিয়ে বক্তব্য দেন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলা শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু শিশুদের জন্য শিশু অধিকার আইন করে যান, প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক করে যান। মেয়েদের শিক্ষা মাধ্যমিক পর্যন্ত অবৈতনিক করে দেন। তিনি আমাদের একটি সংবিধান দেন যেখানে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিতের দায়িত্ব নিয়েছেন সরকার। তিনি ক্রমেই একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলছিলেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের উন্নয়ন-অগ্রগতির চাকাকে স্তব্ধ করে দিয়ে পরিবার-পরিজনসহ জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়। সে সময় বিদেশে থাকায় প্রধানমন্ত্রী ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে গেলেও পরবর্তী সরকার তাদের আর দেশে ফিরতে না দেয়ায় তারা ৬ বছর রিফিউজি জীবনযাপনে বাধ্য হন বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে আর্থসামাজিকভাবে উন্নত করা এবং জাতির পিতার অসম্পূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণ করার জন্য ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাকে সভাপতি নির্বাচন করলে তিনি দেশে ফিরে আসেন । শেখ হাসিনা বলেন, আমরা চাই বাংলাদেশ এগিয়ে যাক। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। যার কথা জাতির পিতাই তার ৭ মার্চের ভাষণে বলে গেছেন ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ তিনি বলেন, ২১টি বছর ধরে এ দেশের মানুষকে দাবায়ে রাখতে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু আমরা ’৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই যে কাজ শুরু করেছি আজও দেশের মানুষ তার সুফল পাচ্ছে। তিনি বলেন, তার সরকার কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে ঋণ দিচ্ছে, ন্যায়্যমূল্যে কৃষি উপকরণÑ সার দিচ্ছে, শিক্ষার্থীদের বৃত্তি-উপবৃত্তির পাশাপাশি প্রি-প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত প্রতিবছর ১ জানয়ারি বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করছে। স্বাস্থ্যসেবাকে দোরগোড়ায় আনতে কমিউনিটি ক্লিনিক করে দিয়ে সেখান থেকে ৩০ প্রকারের ওষুধ বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে। ডিজিটাল কনটেন্টসমৃদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলে স্কুলে স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, ডিজিটাল ক্লাসরুম গড়ে তোলা হচ্ছে। সকলের নাগালের মধ্যে ইন্টারনেট সেবাকে নিয়ে এসে ঘরে বসেই অর্থ উপার্জনের জন্য আউটসোর্সিং এবং লার্নিং এ্যান্ড আর্নিং কোর্স চালু করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধানমন্ত্রীর উপহার ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪৭তম স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে দেশের সকল মুক্তিযোদ্ধাদের শুছেচ্ছা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তার শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে পূর্ববর্তী বছরের মতো এবারও স্বাধীনতা দিবসে মোহাম্মদপুরের গজনভী রোডে শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ফুল, ফল ও মিষ্টি পাঠিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব-২ এ্যাডভোকেট সাইফুজ্জামান শিখর, ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল আলম খোকন ও প্রটোকল অফিসার খুরশিদ-উল-আলম সকালে শুভেচ্ছাসামগ্রী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হস্তান্তর করেন। মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ঈদ ও পহেলা বৈশাখের মতো প্রত্যেক জাতীয় দিবস ও উৎসবে তাদের স্মরণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ জীবন কামনা করেন।
×