ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কামরুল আলম খান খসরু

স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলো

প্রকাশিত: ০৩:১৭, ২৭ মার্চ ২০১৭

স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলো

(গতকালের পর) কীভাবে স্যালুট দিয়েছি, তা করে দেখাই। তারপর আমি পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’-এর পুরোটা গেয়ে শোনাই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমি আন্ডার গ্রাউন্ডে থাকাকালীন সময়েই দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত ভালোভাবে মুখস্থ করে নিয়েছিলাম, যেন কোন বিপদের সম্মুখীন হলে প্রয়োজনে তাৎক্ষণিকভাবে এ কৌশল অবলম্বন করে আমি আত্মরক্ষা করতে পারি। ভারত ও পাকিস্তানী জাতীয় সঙ্গীত মুখস্থ করার এটাই ছিল মূল কারণ। যেন আমি দুই দেশেই যেকোন প্রতিকূল অবস্থায় বিপদমুক্ত থাকতে পারি। আমি অফিসারকে বলি, ‘কলেজ জীবনে আমি কুস্তি করতাম। ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় কুস্তি প্রতিযোগিতায় আমরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে একদল প্রতিযোগী হিসেবে অংশগ্রহণ করি এবং আমি লাইট ওয়েটে ১ম স্থান অধিকার করি।’ তারপর গেঞ্জি খুলে তাঁকে আমার পিঠ দেখাই এবং বলি, ‘আপনার সিপাহীরা আমাকে কীভাবে প্রহার করেছে দেখুন।’ মনে হলো এসবেও তার মন গলেনি। কাগজের ওপর কলম দিয়ে সে কী জানি লিখল। তারপর বিকেলে সেখান থেকে আমাদের তিন কি.মি. দূরে সাতক্ষীরার জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়া হলো। আমাদের জেলে আনতে আনতে বিকেল হয়ে যায়। জেলে প্রবেশের পূর্বে দেখতে পাই কয়েকজন উকিল দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত তাঁরা মক্কেল ধরার জন্য এভাবে জেল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। সেখানে আমি এ্যাডভোকেট এন্তাজ ভাইকে দেখতে পাই। তিনি আমাকে চিনতেন। তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। পরে এমপি হয়েছিলেন। তিনি আমাকে দড়ি বাঁধা অবস্থায় দেখে বিস্মিত হন এবং আমার নাম ধরেই ডাকতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সে মুহূর্তে আমি আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে ও চোখ টিপে তাঁকে নিষেধ করি এবং সব খুলে বলি। এ সময় সেখানে মুস্তাফিজসহ ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিল। তাঁরা সবসময় খেয়াল রাখত ছাত্রলীগের কোন কর্মী ধরা পড়েছে কিনা। কেউ ধরা পড়লে তাঁরা তাঁদের সাহায্য করত। সেদিন এন্তাজ ভাই এবং ছাত্রলীগের কর্মীরা আমাকে দোকান থেকে কলা, রুটি আর পানি কিনে খেতে দেয়। সারাদিন পর তা-ই ছিল আমার প্রথম আহার। ইপিআর সদস্যদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এন্তাজ ভাই আমার রিপোর্ট খুলে দেখে একটু চিন্তিত হয়। বলে তোমার নামে গুপ্তচরের কেস দিয়েছে। যা হোক, কালকে কোর্টে তোমার জামিনের চেষ্টা করব। দেখা যাক কী হয়! একটু পর আমাদের জেলের ভেতরে ঢোকানো হয়। এ সুযোগে আমি জেলে থাকা দাগি আসামিদের সঙ্গে কথা বলি। উদ্দেশ্য কিভাবে এখান থেকে পালানো যায়। জেল পুলিশ (মিঞা সাহেব) আমাদের হাবভাব লক্ষ্য করে আমাকে এবং অন্য আসামিদের ডা-াবেড়ি (ডা-াবেড়ি হলো এক ধরনের লোহার শেকল, যা কোমড় থেকে পায়ের কব্জি পর্যন্ত বাঁধা থাকে। ডা-াবেড়ি পরিহিত অবস্থায় কেউ দৌড়াতে পারে না।) পড়িয়ে লক-আপে ঢুকিয়ে দেয়। সকালে আবার সেই ডা-াবেড়ি খুলে দেয়। আমি পরদিন কোর্ট থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেই। পরদিন সকালে একইভাবে হাঁটিয়ে সাতক্ষীরা কোর্ট প্রাঙ্গণে আনা হয়। আমরা কোর্ট এলাকায় পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় উকিলরা ধৃতদের কাছে এসে আইনজীবী হিসেবে তাঁদের নিয়োগ দেয়ার জন্য অনুনয় বিনয় করতে থাকে। আর চোরাকারবারিরা তাঁদের পরিচিত উকিলদের ডাকাডাকি শুরু করে। কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট ছিল অবাঙালী। আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। ম্যাজিস্ট্রেট এজলাসে এসে বসলে, কিছুক্ষণ পর কেউ একজন এসে তাঁকে একটি চিঠি দিয়ে যায়। তিনি চিঠিটা পড়ে কাছে রাখেন। পরে আমার দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবতে লাগলেন। এন্তাজ ভাই আমার ফাইল মুভ করতে চাইলে তিনি একটু পরে বলে রেখে দেন। আমি বিষয়টি বুঝতে পারি, ভাবি আমার বিষয়ে ঢাকায় যে তারবার্তা পাঠানো হয়েছে তার জন্যই ম্যাজিস্ট্রেট অপেক্ষা করছেন। তারবার্তা এলেই তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। আমি বিষয়টি এন্তাজ ভাইকে জানাই। তাঁকে বলি একটি সাহসী ছেলেকে সাইকেল নিয়ে ল্যাট্রিনের পেছনে কিছু দূরে অপেক্ষা করতে। এন্তাজ ভাইকে আমি পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানাই। এ কথা শুনে এন্তাজ ভাই আঁৎকে উঠেন। তিনি বলেন, জামিন আজকে না হোক কালকে হবে। আমি তাঁকে বলি আমার জামিন হবে না। কারণ আর্মি অফিসারকে আমার ঢাকার নাম এবং ঠিকানা মিথ্যা বলেছি। আমি তাঁদের যে তথ্য দিয়েছি, ঢাকা থেকে তারবার্তা এলে আমার সম্পর্কে দেয়া সে তথ্যের সঙ্গে যখন কোন মিল খুঁজে পাবে না তখন তাঁরা আমাকে চিরদিনের জন্য জেলে পুরে রাখবে, না হয় মেরে ফেলবে। কারণ আপনারা তো জানেন যে, ১৯৬৯ সালে ঢাকার নিউমার্কেটের ভেতর চার (৪) পাকিস্তানী সৈন্যকে ঘায়েল করার অভিযোগে সামরিক ট্রাইব্যুনাল আমাদের তিনজনকে (খসরু, মন্টু ও সেলিম) চৗদ্দ (১৪) বছর কারাদ- দিয়েছে। আসলে তখন আমার অনুপস্থিতিতেই মার্শাল কোর্ট এ দ- নির্ধারণ করেছে। সব শুনে এন্তাজ ভাই বলেন, তাহলে আমাদের কি হবে? তুমি পালিয়ে গেলে ওরা তো আমাদের গ্রেফতার করবে। আমি বলি আপনারাও এখনই ঢাকা যাওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে নিন। ঢাকায় এসে ইকবাল হলে (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) উঠবেন। ইকবাল হলে সবার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আশা করি দেশের জন্য এটুকু ত্যাগ স্বীকার করবেন। মুস্তাফিজ একটি সাইকেল জোগাড় করে আমার জন্য কোর্টের ল্যাট্রিনের পেছনে অপেক্ষা করতে থাকে। ওই সময় সাতক্ষীরা অঞ্চলে এক ধরনের সাইকেল পাওয়া যেত যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘হেলিকপ্টার’। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক সময়ের জনপ্রিয় পরিবহন ছিল এ সাইকেল হেলিকপ্টার। এসব সাইকেলের সামনে হ্যান্ডেলের ওপর একটি এবং পেছনে একটি কাঠ বাধা থাকে বসার সুবিধার জন্য। পেছনের ক্যারিয়ারে গদি বা নরম কিছু স্থাপন করে একজন মানুষ বহনের ব্যবস্থাই মূলত সাইকেল হেলিকপ্টারের কাজ। সামনের কাঠে বিশেষ ব্যবস্থায় আরও একজন যাত্রী বহন করা হয়। স্থানীয় যুবকগণ এভাবে যাত্রী বহন করে অর্থ উপার্জন করত। সে সময়ে দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়ার একমাত্র সহজলভ্য ও জনপ্রিয় পরিবহন ছিল সাইকেল হেলিকপ্টার। এছাড়াও প্রশস্ত, সরু ও মেঠো পথেও চমৎকার সার্ভিস দেয় সাইকেল হেলিকপ্টার। ’৬৮ বা ’৬৯ সালের দিকেই এ পরিবহনের সূত্রপাত হয়। যা হোক, সেদিন এমনই এক সাইকেল হেলিকপ্টার সংগ্রহ করে চমৎকার সার্ভিস দিয়ে মুস্তাফিজ আমাকে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ করে রাখে। এন্তাজ ভাই কোর্টের বারান্দায় এসে আমাকে কলা রুটি কিনে খেতে দিয়ে যান। ছাত্রলীগের কর্মীরা ১০-২০ টাকা করে দিয়ে আমাকে সাহায্য করে। তারপর তাঁরা কোর্ট প্রাঙ্গণ ত্যাগ করে। আমি পাশে দাঁড়ানো বিহারি পুলিশকে প্রস্রাব করব বলে ল্যাট্রিনে নিয়ে যেতে বলি। কোমর বাঁধা অবস্থায় পুলিশ আমাকে ল্যাট্রিনে নিয়ে আসে। আমি ইচ্ছে করে ল্যাট্রিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব শুরু করি। ফলে পুলিশের গায়ে প্রস্রাবের ছিটা লাগে। সে তখন বিরক্ত হয়ে বলল, ‘শালা তুম কেয়া কারতা হ্যায়! মেরা পাতলুন খারাব কার দিয়া! (শালা তুম কি করছ! দিলে তো আমার পাজামা নষ্ট করে!) আন্দার যাও আওর আপনা কাম খাতাম কার (ভেতরে যাও এবং নিজের কাজ শেষ কর)’। আমাকে সে ল্যাট্রিনের ভেতর গিয়ে দরজা সামান্য ভিড়িয়ে প্রস্রাব করার জন্য বলে। আর আমিও এ সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলাম। আমি ব্রিটিশ আমলের উঁচু পুরাতন ল্যাট্রিনের ভেতর প্রবেশ করে কোমরের দড়ি খুলে তা দরজার আংটার সঙ্গে বেঁধে রাখি। দরজা ভিড়িয়ে প্রস্রাব করার সময় দেখি জানালার শিকগুলো বেশ ফাঁক ফাঁক। চলবে...
×