ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবু আফিয়া আহমদ

বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের উত্থান ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

প্রকাশিত: ০৩:১৭, ২৭ মার্চ ২০১৭

বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের উত্থান ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

চট্টগ্রামে চার জঙ্গী নিহত হওয়ার পর রাজধানীতে পরপর তিনটি হামলার ঘটনাসহ সিলেটে জঙ্গী আস্তানার সন্ধানÑ জঙ্গীরা যে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠছে তারই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অথচ এদেশ শান্তিপূর্ণ দেশ, জঙ্গীবাদ এখানে আগেও জনসমর্থন পায়নি, এখনও পাবে না। তবে এদেশে জঙ্গী তৎপরতার জন্য একটি গ্রুপ সব সময়ই তৎপর ছিল আর আজও আছে। ১৯৭৫ সালের আগস্ট সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের এদেশীয় এজেন্টদের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুর নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার পর এদেশে আবার পাকিস্তানী স্টাইলের রাজনীতি প্রবর্তন করা হয়। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে সামরিক সরকার একটি অধ্যাদেশ ঘোষণা করে। ১৯৭২ সালের অধ্যাদেশের অধীন যেসব স্বাধীনতাবিরোধীর কারাদ- হয়েছিল কিংবা বিচার চলছিল, সামরিক সরকারের এই অধ্যাদেশে তার অবসান হয়। লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও হত্যাকা-ের অভিযুক্ত রাজাকার, আলবদর ও অন্য দালালরা বেরিয়ে আসে কারাগার থেকে। চল্লিশ বছর সাজাপ্রাপ্ত আলবদর কমান্ডার আমিনুল হক, যাবজ্জীবন কয়েদি রাজাকার চিকন আলী প্রমুখ হাজার হাজার রাজাকার আলবদর সগর্বে বিচরণ করতে থাকে স্বাধীন বাংলার শহর-বন্দর ও গ্রামে-গঞ্জে। এ সময় শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধাদের পিতা-মাতা, বিধাব স্ত্রী এবং সন্তানদের নিভৃতে অশ্রুপাত করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। কিন্তু এসব ঘটনার মূল নায়ক সে সময়ের সবচেয়ে শক্তিধর ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান তার সহযোদ্ধাদের রক্তদানের কথা একটিবারও স্মরণ করেননি। তিনি তখন দালালদের নিয়ে দল করে দেশের সর্বোচ্চ চেয়ারটি দখল করার ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত ছিলেন। যার জন্য শাহ আজিজ, আবদুল আলিমের মতো স্বাধীনতাবিরোধীদের স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় নিতেও তার এতটুকু বাধেনি। তিনি শাসনতন্ত্রের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে রাজাকার-আলবদরদের হত্যা, লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ প্রভৃতি অপরাধ শাসনতান্ত্রিকভাবে বৈধ করে নেন। দেশের বুদ্ধিজীবী মহলের তরফ থেকে মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার এই দালাল পুনর্বাসনের বিরুদ্ধে তেমন কোন প্রতিবাদ ওঠেনি। অথচ কোন কোন বুদ্ধিজীবী বর্তমানে উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে বলছেন, বঙ্গবন্ধু নাকি সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন করে গেছেন। ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা আর কাকে বলে। ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষিত হয়। এই সুযোগে স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলোও সামরিক সরকারের স্বীকৃতি নিয়ে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ লাভ করে। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতাসীন হন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার প্রথম কাজ ছিল সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিদায় দেয়া। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সে সময়ের রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ছিল মোট ২১টি। এদের মধ্যে মাত্র ৫টি দল জিয়াউর রহমানের নীতির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। এই দলগুলো হলো, মুসলিম লীগ, ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও খেলাফতে রব্বানী পার্টি। বলাবাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় গণবিরোধী ভূমিকার জন্য ১৯৭২ সালে এসব দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। কাজেই দেখা যায়, জিয়াউর রহমানের আমলেই এ দলগুলোর পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। তখন থেকে শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনরুত্থান। ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেমনভাবে জামায়াতীরা বিরোধিতা করেছে ঠিক একই কায়দায় এদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গী হামলা করার চেষ্টা করছে। বিগত কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে যে বোমা হামলা হয়েছে এবং বোমার আস্তানা পাওয়া যাচ্ছে তা মূলত একটি চক্রেরই কাজ। এছাড়া একের পর এক বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের ওপর হামলা করে দেশটিকে আবার পাকিস্তানে পরিণত করার স্বপ্ন দেখছে তারা। বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে পাকিস্তানী জঙ্গীদের কানেকশন বরাবরই ছিল অত্যন্ত গভীর। কারণ, পাকিস্তানী জঙ্গীদের কৌশলই বাংলাদেশী জামায়াতে ইসলামীর জঙ্গীরা অবলম্বন করে থাকে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় যে, পাকিস্তান থেকে জঙ্গী নেতাদের বাংলাদেশে এনে এদেশের জামায়াতে ইসলামীর জঙ্গীদের বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণও দেয়া হতো। যেমন ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে জোট সরকারের অন্যতম শরিক দল জামায়াতে ইসলামীর আমন্ত্রণে পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানী জামায়াতে ইসলামীর নেতৃস্থানীয় সদস্য বাংলাদেশ সফর করেন। ঢাকায় তারা ইসলামী ছাত্রশিবিরের বার্ষিক শুরায় অংশগ্রহণ ছাড়াও তৎকালীন সরকারের দুই মন্ত্রী আলী হাসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম উপদেষ্টা ও সদস্য শাহ আবদুল হান্নানের সঙ্গে তারা মিলিত হন। সে সময় তারা জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা ও মতবিনিময় করেন। এছাড়া পাকিস্তানী জামায়াতের প্রতিনিধিরা বগুড়ায় গিয়ে পাকিস্তান আমলে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের নিহত নেতা আবদুল মালেকের গ্রামের বাড়ি যান এবং তার পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। পাকিস্তানী এ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎপরতা, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখলের ভবিষ্যত কর্মপন্থা সম্পর্কে বিশদ আলোচনাও করেন। (সূত্র : মাসিক হাম কাদাম, অক্টোবর, ২০০৪, পাকিস্তান) বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানানোর প্রচেষ্টারত পাকিস্তানের কুখ্যাত জঙ্গী মৌলবাদী নেতা মঞ্জুর আহমদ চিনিউটি ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সফর করে ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দৈনিক ভোরের কাগজ, জনকণ্ঠ, সংবাদ ইত্যাদি পত্রিকা তার সাক্ষী হয়ে আছে। জামায়াতে ইসলামীর মৌলবাদীদের দ্বারা ড. হুমায়ুন আজাদ যখন আক্রমণের শিকার হন তার পরপরই মঞ্জুর আহমদ চিনিউটি আবার গোপনে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন মঞ্জুর আহমদ চিনিউটি ঢাকায় এসেই খতিব উবায়দুল হক, মুফতি আমিনীসহ জামায়াতে ইসলামী গংদের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে গোপনে বৈঠকও করেছেন। যদিও এই জঙ্গী নেতা মঞ্জুর আহমদ চিনিউটি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তারপরেও এদেশে এসে তার কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। তার সম্পর্কে সে সময় দেশের পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। মঞ্জুর আহমদ চিনিউটি যে একজন জঙ্গী নেতা ছিলেন তা খোদ পাকিস্তানেরই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা তার সাক্ষী। পাকিস্তানের একটি দৈনিকে বলা হয়, মঞ্জুর চিনিউটি নিজ এলাকায় ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক হিংসার বিষ তৈরি করে পরিবেশকে দূষিত করেছে। (দৈনিক মসাওয়াত, ২৩ ডিসেম্বর, ১৯৮৮) এছাড়া বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে উল্লেখ ছিল, ‘মাওলানা মঞ্জুর আহমদ চিনিউটি ধর্মের নামে মানুষকে প্রতারণা করেছে, সে একজন ফতোয়াবাজ হিসেবে চিহ্নিত’। (দৈনিক দিনকাল, ১ এপ্রিল ১৯৯৪) পাকিস্তান থেকে যেভাবে নিয়মিত জঙ্গী মৌলবাদী নেতারা এদেশে এসে তথাকথিত জিহাদী বক্তৃতায় মাঠ গরম করত, ঠিক তেমনি এদেশের জামায়াতে ইসলামীর নেতারা পাকিস্তানে গিয়ে জঙ্গী প্রশিক্ষণ নিয়ে আসত। যেমন ৫ ডিসেম্বর ১৯৯৩ সালের দি ডেইলি পাকিস্তান, লাহোর পত্রিকার একটি খবর ছিল- মজলিসে তাহাফুজে খতমে নবুওয়াত বাংলাদেশের আমির মাওলানা উবায়দুল হক করাচী পৌঁছে গেছেন। তিনি বাংলাদেশে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক খতমে নবওয়ত সম্মেলনের প্রস্তুতি বিষয়ে নেতৃবর্গের সঙ্গে পরামর্শ করেন। এছাড়া মাওলানা সুবহানের তালেবান কানেকশন প্রসঙ্গে দৈনিক সংবাদে ২৩ জুন, ২০০৭ প্রকাশিত সংবাদটির শিরোনাম ছিল ‘মাওলানা সুবহানের তালেবান কানেকশন ছিল প্রকাশ্য’। সংবাদটিতে উল্লেখ করা হয়, ‘ত্রাণের টিন আত্মসাতের দায়ে আটক ‘সৎ লোকের দল’ জামায়াতে ইসলামী নেতা এবং সাবেক এমপি মাওলানা আবদুস সুবহানের তালেবান কানেকশন ছিল প্রকাশ্য। তিনি নিজেই পুস্তিকা ছাপিয়ে তা প্রচার করেছেন। জামায়াতে ইসলামীর,-ইসলামী জঙ্গী কানেকশন ব্যাপক প্রচারিত হলেও তারা সব সময় নিরাপদ অবস্থানে ছিলেন। জোট সরকারের সময় এক জামায়াতী মন্ত্রী পাকিস্তানে সরকারী সফরে গিয়ে সেই সফর শেষ হওয়ার পর ব্যক্তিগত কাজে দু’দিন অবস্থান করেন পাকিস্তানে। জানা যায়, সে সময় তিনি বৈঠক করেন পাকিস্তানে তালেবানপন্থী জঙ্গীদের সঙ্গে। তার এই তৎপরতা প্রকাশ্য না হলেও জামায়াতের তালেবান নেতা মাওলানা সুবহান তালেবানের সঙ্গে তার প্রকাশ্য সম্পর্কের কথা ঘোষণা করেছেন। ২০০১ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি যে পুস্তিকা প্রকাশ করেন তাতে তার নানা কৃতিত্বের সচিত্র বিবরণ দেয়া হয়। এতে একটি ছবিতে দেখা যায় পাকিস্তানের পেশোয়ারে তালেবান নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের সঙ্গে বৈঠক করছেন তিনি। এ সময় তার সঙ্গে আরও কিছু জামায়াতী নেতাকেও দেখা যায়। এ সূত্রগুলো জানায়, সুবহান তার এ তালেবান কানেকশনের কথা কখনও গোপন করেননি, বরং জামায়াতকে সেই তালেবানি ধারায় পরিচালনার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল খুবই সক্রিয়’ (সংবাদ ২৩/৬/২০০৭)। বাংলাদেশে এই জামায়াতে ইসলামীরা একের পর এক জঙ্গী কার্যক্রম পূর্বেও চালিয়েছে আর এখনও যে হামলা হচ্ছে এর মূলে আসলে তারাই। পূর্বে যেমন এদেশের জঙ্গীদের সঙ্গে পাকিস্তানী জঙ্গীদের কানেকশন ছিল গভীর, এখনও একই রয়েছে। এরা চায় শান্তিপূর্ণ এ দেশটাকে পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে। জামায়াতে ইসলামী ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে রাজনীতি করলেও এদের মাঝে ইসলামের সার বা মূল শিক্ষা নেই। জামায়াতে ইসলামী ধর্মের নামে বল প্রয়োগ ও অস্ত্র প্রয়োগে বিশ্বাসী। এরা মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ করায় বিশ্বাসী। জামায়াতীরা যেমন ক্ষমতা দখল ও বল প্রয়োগের ইসলামে বিশ্বাসী ঠিক তেমনি আফগানিস্তানের তালেবানরাও একই পথ অবলম্বন করেছিল। সমগ্র বিশ্বে ধিকৃত ও নিন্দিত এই তালেবানদের সখ্যতা ছিল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে। আমাদের সবার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসা। কোথায় জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ হয়, কারা অস্ত্র দেয়, অর্থ দেয়, মদদ দেয় এ সবের হদিস বের করতে হবে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সদাসতর্ক থাকতে হবে। জঙ্গীবাদ নির্মূলে জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। ধনঁ.ধভরধ২০১৬@মসধরষ.পড়স
×