ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বোমায় নিহত জঙ্গীকে ‘আত্মঘাতী’ বলেই মনে হয়

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ২৬ মার্চ ২০১৭

বোমায় নিহত জঙ্গীকে ‘আত্মঘাতী’ বলেই মনে হয়

আজাদ সোলায়মান ॥ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর গোলচত্বর পুলিশ বক্সের পাশে বোমা বিস্ফোরণে নিহত জঙ্গীর পরিচয় সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত হতে পারছে না গোয়েন্দারা। আত্মঘাতী বোমায় নিহত হওয়ার কারণেই তাকে জঙ্গী হিসেবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। সে মাদকাসক্ত ছিল কিনা তা ময়নাতদন্তের পর নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন বিমানবন্দর থানার পুলিশ। শনিবার তার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্তকারী দলের প্রধান ও ঢাকা মেডিক্যালের ফরেনসিক মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান সোহেল মাহমুদ জানিয়েছেন, নিহত জঙ্গীর পিঠে একটা বোমা বাঁধা ছিল। আরেকটা ছিল তার হাতে। সাধারণত বোমা রাখার এই কৌশলে তাকে আত্মঘাতী বলেই প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়। এ ধরনের ভেস্টেড বোমার তারে টান দিলেই (সুইচ অন) বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। নিহতের পিঠের পেছন থেকে কোমরের নিচের অংশ পর্যন্ত বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। পেটের ভুঁড়ি বের হয়ে গেছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে জানা যায়- শনিবার বেলা সোয়া বারোটার দিকে লাশের ময়নাতদন্ত শুরু করে তিন সদস্যের তদন্ত দলটি। সোহেল মাহমুদের নেতৃত্বে ময়নাতদন্তে অংশ নেন ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডাঃ প্রদীপ বিশ্বাস ও ডাঃ সোহেল কবীর। প্রায় ৪০ মিনিট ধরে তারা ময়নাতদন্ত করেন। দুপরে ময়নাতদন্ত শেষে সাংবাদিকদের সোহেল মাহমুদ বলেন, নিহতের পিঠের মাঝ থেকে পরের অংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তার শরীরে ৫৪ ইঞ্চি তারের টুকরা পেয়েছি। স্কচটেপ দিয়ে আটকানো বোমা শরীরে ছিল। বাঁহাতের কব্জিতে রেগুলেটরের মতো একটা জিনিস বাঁধা ছিল। তারের বাকি অংশ ছিল সেখানে। শরীরে স্পিøন্টার পাওয়া গেছে। এর আগেও পাশের আশকোনায় নির্মাণাধীন র‌্যাবের সদর দফতরে নিহত ব্যক্তির সঙ্গে নিহত এই যুবকের কতটুকু সাদৃশ্য আছে জানতে চাইলে সোহেল মাহমুদ বলেন, আশকোনায় নিহত ব্যক্তির বুক থেকে পুরো অংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আর এর বোমা বাঁধা ছিল পিঠের পেছন দিকে। তবে বিস্ফোরণের ধরনে মিল রয়েছে। তিনি বলেন, বিমানবন্দরের চেকপোস্টে নিহত এই ব্যক্তির পরিচয় নির্ধারণের জন্য তার চুল ও দঁত ডিএনএ টেস্টের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। বিস্ফোরণের আগে সে শক্তিবর্ধক কিছু খেয়েছিল কিনা, তা জানতে প্রস্রাব, রক্ত ও ভিসেরা সংরক্ষণ করা হয়েছে। এগুলোর কেমিক্যাল এ্যানালাইসিসের জন্য রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হবে। কারণ সে মাদকাসক্ত ছিল কিনা সেটাও জানা দরকার। নিহতের শরীরে মাদকের অস্তিত্ব থাকা না থাকার সঙ্গে অনেক কিছুই আমলে নেয়ার মতো জানিয়েছেন এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ অধিনায়ক রাশেদুল ইসলাম খান। তিনি বলেছেন, তার চেহারা দেখে মাদকাসক্ত বলে মনে হয়। সে মাদকাসক্ত হয়ে থাকলে তাকে পেশাদার জঙ্গী হবার পাশাপাশি ভাড়াটে বোমারু হবারও সম্ভাবনা থাকে। দীর্ঘদিন ধরে দেশে স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় থাকা অবস্থায় কোন অদৃশ্য শক্তি জঙ্গীর আড়ালে ভাড়াটে লোকজনকে দিয়ে এ ধরনের হামলা চালিয়েছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। সপ্তাহখানেক আগে পাশের র‌্যাব অফিসেও নিজের বোমায় মারা যাওয়া যুবককেও জঙ্গী বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। কিন্তু তারও কোন পরিচয় জানা যাযনি। এ ধরনের হামলার মোট্ভি দেশ ও জাতির সর্বনাশ করা। কিন্তু নেপথ্যে কোন শক্তি কলকাঠি নাড়ছে সেটা নিশ্চিত হবার জন্যই নিহতদের বংশ পরিচয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শ জানা জরুরী। এ সম্পর্কে বিমানবন্দর গোলচত্বর পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মোস্তাফিজুর রহমান জানান, নিহত বোমারুর সঙ্গে ছিল একটি ট্রলি ব্যাগ, যা দেখে ধারণা করা হয় সে বিমানবন্দরের যাত্রীবেশেই এখানে এসেছিল। ঘটনাস্থলের দুপাশে দুটো পুলিশ বক্সে পুলিশের উপস্থিতি দেখেই আর আগে অগ্রসর হবার সাহস না পেয়ে ভয়েই নিজের সঙ্গে রাখা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রাণ দিয়েছে। এদিকে শনিবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখা যায়-আগের রাতে বোমা নিষ্ক্রিয় করার সময় পাশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আহত হয়েছে তিন জন। পুলিশ জানিয়েছে, নিহতের সঙ্গে থাকা অবিস্ফোরিত উদ্ধার বোমা নিষ্ক্রিয়ের সময় স্পিøন্টারের আঘাতে পুলিশ বক্সের পেছনে একটি রেস্তরাঁর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আল-আমিন হোটেলের তিন কর্মচারী আহত ও সামনের কাঁচ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। স্পিøন্টারের আঘাতে সিলভারের হাঁড়িতে বড় বড় ছিদ্র হয়েছে। একটি বড় ডেকচি ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। হোটেলে খাবার সাজিয়ে রাখা গ্লাসঘেরা লম্বা ফ্রিজ চুরমার। স্পিøন্টারের আঘাতে এমন কিছু নেই যার কোন ক্ষতি হয়নি। হোটেলের সামনে পড়ে থাকতে দেখা যায় জিনিসপত্রও। হোটেলে দাঁড়িয়ে মালিক শেখ ফজলুল হক নান্নু বলেন, পুলিশ বক্সের পেছনে তার দুটি হোটেল আছে। হামলার ঘটনার সময় হোটেলের সামনে এক বন্ধুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। হঠাৎ একটি আওয়াজ শুনতে পাই। ভেবেছিলাম কোন গাড়ির চাকার বিস্ফোরণ। পরে পুলিশ বক্সের সামনে গিয়ে দেখতে পাই এক যুবক পড়ে আছে, তার পেট ছিন্নভিন্ন। পুলিশ এসে সবাইকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলে। তিনি বলেন, হামলাকারীর পাশ থেকে উদ্ধার করা অবিস্ফোরিত বোমা নিষ্ক্রিয় করার সময় বিস্ফোরণ ঘটলে তাতেই হোটেলের ক্ষতি হয়। তার প্রায় ২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন। উল্লেখ্য, শুক্রবার রাতে পুলিশ বক্সের পাশে নিজ শরীরে রাখা বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ওই জঙ্গী। রাত আড়াইটার দিকে তার লাশ ঢামেক মর্গে নিয়ে যান বিমানবন্দর থানার দারোগা মনিরুল ইসলাম। তিনি জানান, তার বয়স আনুমানিক ২৩-২৫ বছর। পরনে ছিল জিন্স প্যান্ট ও ফুলহাতা শার্ট । এছাড়া ঘটনাস্থলে একটি ট্রাভেল ব্যাগ পাওয়া গেছে। যেখান থেকে তিনটি বোমা উদ্ধার করে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। গত ১৭ মার্চ এ ঘটনাস্থলের কয়েক গজ দূরেই আশকোনায় র‌্যাবের নির্মাণাধীন সদর দফতরে আত্মঘাতী হামলা চালায় এক জঙ্গী। এতে আত্মঘাতী হামলাকারী নিহত হয়। এদিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তা ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে তল্লাশি। বিমানবন্দরের বাইরে তৎপর রয়েছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক রাশেদুল ইসলাম খান জানান, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রতিটি পয়েন্টে সতর্ক নজরদারি ও তল্লাশি বাড়ানো হয়েছে। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাটি বিমানবন্দরের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে কোনভাবেই প্রভাবিত করেনি। সবকিছু স্বাভাবিক আছে। বিমানবন্দরের ভেতরের পরিস্থিতি সম্পর্কে শাহজালালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাশেদা সুলতানা বলেন-বিমানবন্দরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি বিমানবন্দরের ভেতরে যাত্রী ছাড়া দশনার্থীরা যাতে কম প্রবেশ করেন। এ ক্ষেত্রে শর্ত দিয়ে তাদের বিমানবন্দরে প্রবেশ করাচ্ছি। শনিবার দুপুরে সরজমিনে দেখা যায়, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার পরও যাত্রীসাধারণ ও অন্যান্য দর্শনার্থীর মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। বহির্গমন গেটগুলোয় সিভিল এ্যাভিয়েশনের সিকিউরিটি বাড়ানো হয়েছে। জানতে চাইলে সিভিল এ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এহসানুল গনি চৌধুরী বলেন, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে সব সংস্থা তৎপর। সতর্কতা হিসেবে বিমানবন্দর এলাকায় প্রবেশের ক্ষেত্রে তল্লাশি বাড়ানো হয়েছে। তবে কোন প্রকার এলার্ট দেয়া হয়নি। গত ১৭ মার্চ আশকোনায় র‌্যাবের নির্মাণাধীন সদর দফতরে আত্মঘাতী হামলা চালায় এক জঙ্গী। এতে আত্মঘাতী হামলাকারী নিহত হয়। দুটো ঘটনার সাদৃশ্য একই বলে জানিয়েছে র‌্যাব। একজনের বেশি দর্শনার্থী নয় বিমানবন্দরে ॥ এদিকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখাসহ নিরাপত্তার স্বার্থে বিদেশগামী যাত্রীর সঙ্গে একজনের বেশি স্বজন না নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বিমানবন্দরের পরিচালক কাজী ইকবাল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘নিরাপত্তার স্বার্থে বিমানবন্দরে একজন যাত্রীর জন্য একজনের বেশি স্বজন না যাওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। পাশাপাশি বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় বাড়তি সর্তকতাও নেয়া হয়েছে। এছাড়া শুক্রবার ওই এলাকায় পুলিশ চেকপোস্টে আত্মঘাতী বিস্ফোরণের ঘটনায় বিমানবন্দরের কার্যক্রম প্রসঙ্গে শনিবার বিমানবন্দরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাশেদা সুলতানা বলেন-বিমানবন্দরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। শুক্রবার যে ঘটনা ঘটেছে তা বিমানবন্দর এলাকার ভেতরে নয়। তবু নিরাপত্তার স্বার্থে প্রতিটি পয়েন্টে সতর্ক নজরদারি ও তল্লাশি বাড়ানো হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি, বিমানবন্দরের ভেতরে যাত্রী ছাড়া দর্শনার্থীদের প্রবেশে নিয়ন্ত্রণ করতে। বিমানবন্দরের বাইরের চেকপোস্টগুলোতে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের সদস্য সংখ্যাসহ তল্লাশি বাড়াতে বলা হয়েছে। সিভিল এ্যাভিয়েশন, এ্যাভসেক, পুলিশের সমন্বয়ে টিম বিমানবন্দর এলাকা টহলের মাধ্যমে নজরদারি করছে।
×