ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শেরপুরে গ্রামীণ কৃষি চিন্তকের উদ্যোগ

ডিজিটাল তথ্যসেবায় পাল্টে গেছে ৯ গ্রামের কৃষিচিত্র

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ২৬ মার্চ ২০১৭

ডিজিটাল তথ্যসেবায় পাল্টে গেছে ৯ গ্রামের কৃষিচিত্র

রফিকুল ইসলাম আধার ॥ কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্রের (এআইসিসি) সুবিধা ভোগ করছেন আধুনিক কৃষিসমৃদ্ধ অঞ্চল শেরপুরের নকলার কৃষক। এলাকার কয়েকজন গ্রামীণ কৃষি চিন্তকের উদ্যোগে গড়ে ওঠা ওই কেন্দ্রের আওতায় ডিজিটাল তথ্যসেবায় পাল্টে যাচ্ছে স্থানীয় ৯ গ্রামের কৃষিচিত্র। ভাগ্য বদল হচ্ছে অনেক কৃষক-কৃষাণীর। ফলে এলাকার কৃষি উন্নয়নে মডেল হয়ে উঠেছে এআইসিসি। অনেকেই এখন কৃষিক্ষেত্রে সহায়তা পেতে এআইসিসির প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠছেন। কৃষকদের ডিজিটাল তথ্যসেবা দেয়ার লক্ষ্যে ২০০১ সালের দিকে নকলা উপজেলার বানেশ্বর্দী ইউনিয়নের মোজারবাজার ও পোলাদেশী গ্রামের ২০ কৃষক ও ৫ কৃষাণী মিলে গঠন করেন ‘অগ্নিবীণা ক্ষুদ্র কৃষক আইপিএম ক্লাব’। পর্যায়ক্রমে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্রের মাধ্যমে ডিজিটাল কৃষি তথ্যের প্রচলন ও গ্রামীণ জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পের সহযোগিতায় ওই আইপিএম ক্লাবের মাধ্যমে স্থানীয় মোজারবাজারে আত্মপ্রকাশ করে কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি), যা সার্বক্ষণিক কৃষি তথ্য সার্ভিস নামে পরিচিত। ওই এআইসিসির দেয়া ডিজিটাল সেবা নিয়ে পোলাদেশী, মোজারবাজার বানেশ্বর্দী, ভূরদী, নয়াপাড়া, বাউশা, কবুতরমাড়ি, ছাল্লাকুড়া, খন্দকারপাড়া গ্রামের পিছিয়ে থাকা হাজারও কৃষক আজ স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। যে কারণে এআইসিসি নজর কেড়েছে সবার। স্থানীয় কৃষি বিভাগের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা সপ্তাহে সম্ভব না হলেও মাসে একবার করে পরিদর্শন করেন ওই কেন্দ্র। সম্প্রতি এআইসিসির কার্যক্রম পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক কৃষিবিদ মিজানুর রহমান এবং ময়মনসিংহ বিভাগীয় কৃষি তথ্য কর্মকর্তা কৃষিবিদ গোলাম মাওলা। এআইসিসির সেবার মান ও সফলতা দেখে কৃষি ও সমাজ সেবার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে পার্শ্ববর্তী ভূরদী খন্দকারপাড়া কৃষি পণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থা নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। কৃষিবিদ ও সুধীজনদের মতে, সারাদেশে প্রতি ওয়ার্ডে বা ইউনিয়নে এআইসিসি এবং ভূরদী খন্দকারপাড়া কৃষি পণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার মতো সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠত, তাহলে দেশ আরও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেত। সরেজমিনে গেলে কথা হয় এআইসিসির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে দায়িত্বরত সভাপতি কৃষক আলহাজ কিতাব আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, সপ্তাহে ৭ দিন সকাল ৭টা হতে রাত ৯টা পর্যন্ত কৃষি তথ্য সেবা খোলা থাকে। প্রতি সপ্তাহে বা মাসে এলাকার যে কোন কৃষি সমস্যা নিয়ে একদিন নিয়মিত সভা হয়। নিজেরা সমাধান না দিতে পারলে সরাসরি কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য সেবা কেন্দ্রে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সমাধান নেন তারা। এভাবেই তথ্যসেবা কেন্দ্রটি কৃষি মন্ত্রণালয়ের নজর কাড়ে। তাদের চেষ্টাকে জোরাল করতে এলাকার সংসদ সদস্য, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী ২০১৪ সালে নিজে উপস্থিত থেকে প্রায় ৪ লাখ টাকার ডিজিটাল কৃষি সেবা পণ্য দেন ওই প্রতিষ্ঠানকে। এআইসিসির সাধারণ সম্পাদক কৃষি বিষয়ক কবি আব্দুল হালিম বলেন, তাদের ওই তথ্যসেবা কেন্দ্রে সার্বক্ষণিক সেবা দিতে মোঃ জাকির হোসেন সজীব নামে এক তরুণকে উদ্যোক্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সে মাসে যা আয় করে তার ২০% থেকে ৪০% নিজে নেয়। বাকি অংশ সমিতির এ্যাকাউন্টে জমা থাকে। এতে সজীবের মাসিক আয় হয় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। তা দিয়েই সজীব তার শিক্ষা খরচ বহন করে। সজীব জানায়, ওই তথ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে কৃষির যে কোন তথ্যদান ও সেবাসহ অন্যান্য সকল প্রকার অনলাইন কাজ করা হয়। তার মধ্যে ফসলের যে কোন মারাত্মক সমস্যায় সরাসরি কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যসেবা কেন্দ্রের সঙ্গে মাঠ কৃষকদের ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেবা প্রদান উল্লেখযোগ্য। ভূরদী খন্দকারপাড়া কৃষি পণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ছাইদুল হক বলেন, আমরা সফলতা পেতে শুরু করেছি। ভূরদী এলাকার কোন কৃষক ২ বছর যাবত কৃষি ক্ষেত্রে কোন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন না। এআইসিসি সেবা গ্রহণকারী মোজারবাজার এলাকার বৃদ্ধ কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এআইসিসি প্রতিষ্ঠা করে আমরা এলাকায় ধাপে ধাপে এগিয়ে যাই। এতে আমাদের সুবিধাভোগের পরিমাণও দিন দিন বেড়ে যায়। তারই অংশ হিসেবে এখন আমরা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য সেবা কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলতে পারি, নিতে পারি নানা পরামর্শ ও সহায়তা। স্থানীয় মৃত জালাল উদ্দিনের স্ত্রী কৃষাণী মিনারা বেগম বলেন, ‘আগে আমরা কিছুই বুঝতাম না, অহন সব কিছুই বুঝি। বড় বড় স্যারদের সঙ্গে কম্পিউটারে দেইক্কা দেইক্কা কতা কই। নেপটপ ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া স্যারগো ক্ষেতের সমস্যা দেহাই। স্যারেরা দেইক্কা যে ওষুধ দিবার কয়, ওই ওষুধই দেই। অহন আঙ্গরে আর ফসল নষ্ট অয়না। বরং ডিজিটাল সেবা নিয়া আমরা অহন দিন দিন ধনীই অইয়া যাইতাছি’। এ ব্যাপারে শেরপুর খামারবাড়ির উপ-পরিচালক আশরাফ উদ্দিন বলেন, কৃষি বিভাগের সহায়তায় নকলায় প্রতিষ্ঠিত ‘এআইসিসি’ এলাকার কৃষকের ভাগ্য খুলে দিয়েছে। এর সেবা ভোগ করে এখন অনেকেই আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠছেন।
×