ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কামরুল আলম খান খসরু

স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলো

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২৬ মার্চ ২০১৭

স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলো

(গতকালের পর) এভাবে প্রত্যেককে কমবেশি প্রহার করে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে। তারপর আমাকে বাইরে এনে প্যান্ট-গেঞ্জি পরতে দেয়। আমি প্যান্ট পরার সময় প্যান্টের লুপে হাত দিয়ে দেখি সেখানে রাখা সোনার চেইনটি নেই। তখনকার দিনে প্যান্টের লুপে ২-৩টি বোতাম ব্যবহার করা হতো। সেখানে এখন জিপার (চেইন) ব্যবহার করা হয়। ভারতে আসার আগে আমি লুপে সামান্য ছিদ্র করে তারমধ্যে একটি সোনার চেইন লুকিয়ে রেখেছিলাম। কিছুক্ষণ আগেও যে সোনার চেইনটি আমার লুপে ছিলো, এখন সেটা নেই। এ চেইনটি আমাকে দিয়েছিলেন ছাত্রলীগের বিশিষ্ট নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু (বর্তমানে পরিবেশ ও বন মন্ত্রী)। তিনি ছিলেন আমার খুব ভাল বন্ধু। ভারতে যাওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি কিছু টাকা এবং এ চেইনটি আমাকে দেন। শুধু আমাকেই নয় ছাত্রলীগের এবং আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা নিউক্লিয়াস-এর অনেক কর্মীদের তিনি টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন। চেইনটি দেয়ার উদ্দেশ্য ছিলো টাকা-পয়সা শেষ হয়ে গেলে এ চেইনটি বিক্রি করে যেন আমি চলতে পারি। চেইনটি খোয়া যাওয়ায় আমার মনটা ভারি হয়ে উঠলো। এ সময় প্রস্রাবের কথা বলে আমি ল্যাট্রিনে যাই। আমার উদ্দেশ্য এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া। ল্যাট্রিনে গিয়ে টিনের ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি পাশে একটি বাঙ্কারে একজন সিপাহী মেশিনগান ভারতের দিকে তাক করে পজিশন নিয়ে আছে। আমি পালানোর চিন্তা বাদ দেই। তারপর সেখান থেকে একইভাবে আমাদের কোমরে দড়ি বেঁধে আবার হাঁটতে বলে। তিনজন সিপাহী অস্ত্র হাতে আমাদের সামনে-পিছনে হাঁটতে থাকে। আমার সারা শরীর ব্যথা করছিলো। ক্ষুধায় পেট জ্বলছিলো। গতরাতে কিছুই খাওয়া হয়নি। ভেবেছিলাম সকালে এপারে এসে পেট ভরে খেয়ে নিবো। কল্পনাও করতে পারিনি আমাকে এরকম পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে। তবে জীবনে আমি আরো বহুবার এইরকম পরিস্থিতি আত্মবিশ্বাস এবং বীরত্বের সাথে মোকাবেলা করেছি। সাহস আর বুদ্ধি দিয়ে তা অতিক্রম করে এসেছি। পাকিস্তানিরা আমাদের ধরে রাখতে পারেনি। কয়েক কিলোমিটার হাঁটার পর সিপাহীরা গাছতলায় বসে জিরিয়ে নিচ্ছিলো। তাঁরা আমাদেরও এক জায়াগায় বসিয়ে রাখে। এ সুযোগে আমি ধৃত বাকি লোকদের সঙ্গে ফিস ফিস করে বলি, “আসুন তিনজন সিপাহীকে ঝটিকা হামলা করে বেঁধে রেখে, আমরা পালিয়ে যাই।” আমার কথা শুনে তাঁরা ভয়ে আঁতকে ওঠে বলে, “এটা করা ঠিক হবে না। আমরা এ এলাকার লোক। ওরা আমাদের খুঁজে বের করে একেবারে জানে মেরে ফেলবে। বউ বাচ্চা না খেয়ে মরবে।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ধৃত লোকগুলো ছিলো এলাকার পেশাদার চোরাকারবারি। তাঁরা মাঝেমাঝে এ ঘাট ব্যবহার করে ভারতে মালামাল আনা-নেয়া করতো। সেদিন আমাদের এভাবে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে বিওপি থেকে এগারো (১১) কি.মি. দূরে সাতক্ষীরা ইপিআর সদর ঘাঁটিতে আনা হয়। প্রথমে আমাদের হাঁটিয়ে একটি পাঁকা রাস্তার সামনে আনা হলো। উল্টো দিক থেকে এ সময় একটি বাস আসছিলো। ইপিআর সিপাহীরা তাতে ওঠে এবং বাসের যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে আমাদের তুলে নিয়ে রওনা হলো। সেখানে অর্থাৎ ইপিআর ঘাঁটিতে আরো ৮-১০ জন বন্দি ছিলো। বিভিন্ন অভিযোগে বর্ডার এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এখানে আনার পর এক পাঞ্জাবি আর্মি অফিসারের সামনে আমাদের পর্যায়ক্রমে নেয়া হয়। তারপর ল্যাট্রিনে বসার মতো করে তাঁর সামনে সবাইকে বসতে বলা হয়। সবার শেষে আমাকে তার সামনে আনা হয়। আমাকে দেখে তিনি একটু নড়েচড়ে বসেন। আমাকে তার সামনে একটি বেঞ্চে বসতে দেয়া হয়। তারপর শুরু হয় আমার জেরা। এ সময় এক সিপাহী অস্ত্রের ব্যাগটি আমার সামনে এনে রাখে। আর্মি অফিসারটি উর্দু ভাষায় আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমহারা নাম কেয়া হায়’ (তোমার নাম কি)? আমি তখন আমার মিথ্যে নামটি বলি অর্থাৎ ছদ্মনামটি, যা আমার রংপুরের বন্ধু পারভেজের নাম। ‘কাহা র‌্যায়তে হো’ (কোথায় থাকো)? যথারীতি এ প্রশ্নেরও আমি মিথ্যে উত্তর দেই অর্থাৎ আমার ঢাকার বন্ধু নূরুল ইসলামের বাড়ির ঠিকানাটি বলি। এবার জানতে চায়, ‘ক্যায়া কারতে হো’ (কি করো)? ‘কিসলিয়ে ইন্ডিয়া গায়া থা’ (কেন ভারত গিয়েছিলে)? ‘ইয়ে মাল কিসকা হায়’ (এ ব্যাগটি কার)? ইত্যাদি নানারকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। আমি ভাল উর্দু এবং হিন্দি কথা বলতে পারি। তাই উর্দুতেই তাঁর সব প্রশ্নের উত্তর দেই। তবে আমার সব উত্তরই মিথ্যা ছিল। মিথ্যা না বললে তো ধরা পড়ে যাব। অফিসারটি আমার ঠিকানা যাচাই করার জন্য দফতরের ভেতর গিয়ে ঢাকায় পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টারে তারবার্তা পাঠিয়ে আসে। অফিসার এসে আবার আমাকে জেরা করতে থাকে। আমি তাঁকে বলি, ‘ম্যায় বিজনেস কারতা হু’ (আমি ব্যবসা করি)। ‘নিউমার্কেট মে মেরা দোকান হ্যায়’ (নিউমার্কেটে আমার দোকান আছে)। ‘মুঝে ফিল্ম দেখনে কা বহুত শওখ হ্যায়’ (আমার ছবি দেখার নেশা)। ‘ম্যায় উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন আওর দীলিপ কুমার কা ফ্যান’ (আমি উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন এবং দীলিপ কুমারের ভক্ত)। ‘উন লোগ কা ফিল্ম দেখনে কে লিয়ে ম্যায়নে ইন্ডিয়া গায়া থা” (তাঁদের ছবি দেখার জন্য আমি ইন্ডিয়া গিয়েছিলাম)। অফিসারটি বলে পাকিস্তানের ফিল্মেও তো ভাল হিরো, হিরোইন আছে। যেমন মোহাম্মদ আলী, জেবা, ওয়াহিদ মুরাদ। তাঁদের ফিল্ম দেখো না কেন? আমি বলি তাঁদের ফিল্মও দেখি এবং দুয়েকটি ফিল্মের নামও বলি। যেমন- হিরো ওয়াহিদ মুরাদের ছবি (আরমান), হিরো মোহম্মাদ আলী এবং হিরোইন জেবার ছবি (কানিজ)। আর্মি অফিসারটি তখন আমাকে বলে, ‘তুম ভি তো হিরো কে তারাহ লাগতে হো (তুমিও তো দেখতে নায়কের মতো)। ‘তুম ফিল্ম মে কাম কিউ নাহি কারতে হো’ (তুমি ছবি কেন করো না)? ‘আসাল মে তুম ইন্ডিয়ান জাসুস হো’ (আসলে তুমি ভারতীয় চর)। ‘জাসুস’ কথাটা শুনেই আমি চমকে উঠি। ‘ইয়ে হাতিয়ার কা ব্যাগ তুমহারা হায়’ (এ অস্ত্রের ব্যাগ তোমার)? তুমি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র দিতে এসেছো। অস্ত্রের ব্যাগটি আমাকে দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘ইয়ে হাতিয়ার জোড় দো’ (অস্ত্রের নাটবল্টু জোড়া দাও)। আমি বলি, ‘মুঁঝে ইয়ে চালানা নেহি আতা’ (আমি অস্ত্র চালাতে পারি না)। ‘ইয়ে ব্যাগ জিসকা হায়, ওয়ো ইপিআর কে সিপাই কো দেখকার ডার কে মারে কিস্তি সে পানি মে কুঁদ গিয়া, উছে গোলি লাগি আওর ওয়ো মার গায়া’ (এ ব্যাগটি যার সে ইপিআর সিপাহীকে দেখে ভয়ে নৌকা থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। অফিসারটি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছিল না, তা বুঝতে পারছিলাম। তাঁর বিশ্বাস আনার জন্য আমি বলি, রংপুর স্কুলে পড়ার সময় আমি স্কাউট করতাম। ১৯৫৮ সালে চিটাগাংয়ে আমি স্কাউট জাম্বুরীতে যোগ দেই। সেই সময় স্কাউট জাম্বুুরিতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান চিটাগাং-এ চিফ গেস্ট হয়ে এলে আমাদের স্কাউটের দল তাঁকে স্যালুট দিয়েছে। চলবে...
×