ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাফসানার ছবি

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ২৫ মার্চ ২০১৭

রাফসানার  ছবি

রাফসানা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। তাকে নিয়ে মায়ের চিন্তার শেষ নেই। একদম লেখাপড়া করে না। চতুর্থ শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। বিশেষ বিবেচনায় পঞ্চম শ্রেণীতে উঠেছে। রাফসানা ভাইবোনদের মতো টিভি দেখে না। রাত দিন বই নিয়ে পড়ে না। বরং মায়ের চোখের আড়াল হলেই ছবি আঁকতে বসে। যেখানে সেখানে ছবি আঁকে। পাঠ্যবইয়ের ফাঁকা পৃষ্ঠাতেও ছবি এঁকে ভরে রেখেছে। সে এত ছবি আঁকে তবু ড্রয়িং পরীক্ষায় নম্বর পায় কম। মা মাঝে মাঝে বকাবকিও করেন। মা বলেন, ‘তুমি এত ছবি আঁকো, তবে ড্রয়িং পরীক্ষায় নম্বর কম পাও কেন? তোমাকে আর যেন ছবি আঁকতে না দেখি।’ মায়ের ধমক আর বকা খেলেও রাফসানা আঁকাআঁকি ছাড়তে পারে না। সে কী করবে? মন চায় ছবি আঁকতে। সে ছবি আঁকে শুধু মুক্তিযুদ্ধের। এত কিছু থাকতে কেন শুধু মুক্তিযুদ্ধের ছবি? আর বিষয় নেই? মা বলেন, নদীর ছবি আঁকো, পাহাড়ের ছবি আঁকো। না, তা সে করবে না। রাফসানারা কিশোরগঞ্জ শহরে থাকে। ওর বড় এক বোন ও এক ভাই। মা এখন বড় দু ভাইবোনের প্রতিই বেশি নজর দেন। রাফসানার আশা তিনি ঘোষণা দিয়েই ছেড়ে দিলেন। ওর দ্বারা কিছু হবে না। রাফসানা যখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ত, তখন মামার কাছে শুনেছে ওর বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে তিনি শহিদ হন। মামা বাসায় এলেই যুদ্ধের গল্প শোনান। যুদ্ধের গল্পে যেন সে বাবাকে দেখতে পায়। সে যেন দেখতে পায়, এক বীর যোদ্ধা, যিনি রাফসানার, রাইফেল কাঁধে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যুদ্ধ করছেন। রাফসানার মামা বলেছিলেন, তোমার বাবাকে রাজাকাররা খুব নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। তুমি শিশু। তোমাকে সব কথা বলা যাবে না। কষ্টের কথা রাফসানাও শুনতে চায় না। ওর কান্না পায়। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে। একদিন মামা নিয়ে এলেন মুক্তিযুদ্ধের দুটি গল্পের বই। নাও মামু, পড়। মুক্তিযুদ্ধের কথা জান। রাফসানা গল্পের বই পড়ে। পড়ার পরেই তার চোখে যেন মুক্তিযুদ্ধের ছবি ভেসে ওঠে। ভাসে। আর তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকে। মাটিতে আঁকে। ঘরের দেয়ালে। খাতায়। এমনকি বইয়ের পাতায়ও। কখনও রং পেন্সিল দিয়ে, আবার কখনও শুধু স্ক্যাচ। কিশোরগঞ্জ নতুন মহকুমা প্রশাসক এসেছেন। একদিন তিনি ঘোষণা দিলেন, এবারের স্বাধীনতা দিবসে ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা হবে। শিশুরা ছবি আঁকবে। বিষয় মুক্তিযুদ্ধ। রাফসানার মামা বিকেলে এলেন। রাফসানাকে বললেন, মামু, তুমি ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে? মামা রাফসানাকে আদর করে মামু ডাকেন। মামার কথায় রাফসানা কোন আগ্রহ দেখাল না। গা ছাড়া ভাব। না গেলেই প্রাণে বাঁচে। মা রাগ করলেন। বললেন, তা যাবে কেন? এখানে সেখানে ছবি আঁকবে। পরীক্ষায় গাব্বা মারবে। একে নিয়ে আমি কী করব বুঝতে পারছি না। কোন একটা কাজ যদি হতো! কপাল আমার! মায়ের রাগ দেখে রাফসানা ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় যাবে বলল। মামা তো খুব খুশি। রাফসানাকে কোলে নিয়ে নাচতে নাচতে গেলেন মহকুমা অফিসের মাঠে। শুরু হয় আঁকাআঁকি। বিচারক হিসেবে এসেছেন কয়েকজন দেশ বরেণ্য আঁকিয়ে। শিশুরা ছবি এঁকে জমা দিল। বিচারকরা ছবি বাছাই করছেন। একটি ছবি তাদের চোখে-মুখে আনন্দ ফুটে উঠেছে। বিচারকরা বললেন, এটা কোন শিশুর আঁকা ছবি? এটা তো জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার মতো ছবি! মহকুমা প্রশাসক চোখ বড় করে ছবিটার দিকে তাকালেন। ছবিতে তাঁরও চোখ আটকে গেল। তিনি বললেন, সত্যি তো অবাক করার মতো ছবি! ছবিটি দেখে বললেন, শিশুর হাতে এমন নিখুঁত ছবি হতে পারে, ভাবতে পারছি না? অবাক কা-! ছবির নিচে লেখা রাফসানার নাম। বিচারকগণ ছবি বাছাই করলেন। রাফসানা ‘সেরাদের সেরা শিল্পী’ হিসেবে নির্বাচিত হলো। পুরস্কার দেয়ার সময় হলো আরেকটা ঘটনা ঘটে গেল। রাফসানাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মামা মাঠ জুড়ে তল্লাশি চালালেন। না, নেই। রাফসানা নেই। কোথা গেল? মামা বাসার দিকে দৌড় লাগালেন। হায় কপাল! মন খারাপ করে বসে আছে রাফসানা। মামা বললেন, মামু, তোমার ছবি তো সেরাদের সেরা ছবি হয়েছে। তুমি আমাকে না বলে চলে এলে কেন? তাড়াতাড়ি চল। বুবু তুমিও চল। তোমার মেয়ে সেরাদের সেরা পুরস্কার পেয়েছে। এত আনন্দের খবরেও রাফসানার মুখে হাসি নেই। রাফসানাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেলেন মামা। সঙ্গে মাও। পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। মঞ্চে আসার জন্য সেরাদের সেরা শিশুশিল্পী রাফসানাকে ডাকা হলো। রাফসানা বিচারকের হাত থেকে পুরস্কার নিল। ক্রেস্ট। মহকুমা প্রশাসক চেক দিলেন। প্রধান বিচারক বললেন, আমি তোমার ছবি দেখে মুগ্ধ। আমার জীবনে অনেক ছবি আঁকার প্রতিযোগিতার বিচারক হয়েছি। কিন্তু এমন সুন্দর ছবি আর নিখুঁত কোন দিন দেখিনি। তুমি বলো তো মা, ছবি আঁকার উৎসাহ কে দিয়েছেন? এই প্রেরণা তুমি কোথায় পেলে? কে-ই বা তোমাকে ছবি আঁকা শিখিয়েছেন? রাফসানার মন খারাপ। এত বড় পুরস্কার পেয়েও মুখে খুশির কোন চিহ্নমাত্র নেই। সে আস্তে আস্তে বলল, ছবি আঁকার উৎসাহ দিয়েছেন আমার বাবা। ছবি আঁকার প্রেরণা আমার বাবা। ছবি আঁকা শিখিয়েছেন আমার বাবা। আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। আমি কোন দিন বাবাকে ‘বাবা’ ডাকতে পারিনি। আমার বন্ধুরা যখন বাবা ডাকে তখন আমারও বাবা ডাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমি পারি না। আমার বন্ধুরা যখন বাবার গল্প করে আমারও বাবার গল্প করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমি পারি না। মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে আমি আমার বাবাকে দেখতে পাই। রাফসানার চোখের পানি গাল বেয়ে টপ টপ করে নিচে পড়ছে। রাফসানার কথা শুনে উপস্থিত সবার চোখেই পানি টলমল করছে। হঠাৎ সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানটি স্তব্ধ হয়ে গেল। রাফসানা আস্তে আস্তে মঞ্চ থেকে নিচে এলো। মায়ের পাশে এসে দাঁড়াল সে। হাতে ক্রেস্ট ও চেক। মা শাড়ির আঁচল দিয়ে রাফসানার চোখের পানি মুছে দিলেন। মায়ের চোখেও পানি। অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×