ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সিমেন্টবোঝাই ট্রাক উল্টে এক পরিবারের ৫ জনসহ নিহত ১০

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৫ মার্চ ২০১৭

সিমেন্টবোঝাই ট্রাক উল্টে এক পরিবারের ৫  জনসহ নিহত ১০

স্টাফ রিপোর্টার, ময়মনসিংহ ও নিজস্ব সংবাদদাতা, ভালুকা ॥ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভালুকা উপজেলার মেহেরাবাড়ি নামক স্থানে শুক্রবার ভোর ৪টার দিকে সিমেন্ট বোঝাই একটি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার ওপর উল্টে গেলে একই পরিবারের পাঁচজনসহ ১০ জন নিহত ও চার আরোহী আহত হয়েছে। গুরুতর আহত চার জনকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে নয় জন ঘটনাস্থলে ও একজন ভালুকা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। ঢাকা থেকে সিমেন্ট বোঝাই মেসার্স চন্দন রাইস মিলের মালিকাধীন ট্রাকটি ময়মনসিংহের দিকে আসার পথে এই দুর্ঘটনা ঘটে। ভালুকার মেহেরাবাড়ি অংশের উন্নয়ন কাজের জন্য চার লেন মহাসড়কের পূর্ব পাশের বন্ধ থাকা দুই লেনের ভুল পথ ধরে চালক ট্রাকটি আগানোর সময় কাটা সড়কের গর্তে পড়ে নিয়ন্ত্রণ হারালে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। ভালুকা ফায়ার সার্ভিসের ইনচার্জ রেজাউল করিমের দাবি, চালকের অসতর্কতা ও খামখেয়ালিপনার কারণেই এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম জানান, ব্যারিকেড বিহীন রাস্তায় গর্ত এবং ভুল পথে ট্রাকটি আসার কারণেই এই দুর্ঘটনা। খবর পেয়ে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় ভালুকা ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও ভালুকা থানা পুলিশ হতাহতদের উদ্ধার করে। সকাল ৯টার দিকে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মোঃ খলিলুর রহমান ও পুলিশ সুপার সৈয়দ নূরুল ইসলামসহ স্থানীয় প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা। ঘটনার পর ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্র্রেট আরিফ আহমদ খানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিহতদের পরিবারের অনুরোধে বেলা ২টার দিকে স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করে ভালুকা মডেল থানা পুলিশ। ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মোঃ খলিলুর রহমান জানান, নিহত প্রত্যেক পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। ভালুকা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামনুর রশিদ জানান, নিহত ১০ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এরা হলো- তারাকান্দা উপজেলার বালিখা ইউনিয়নের ঢাকিরকান্দা গ্রামের একই পরিবারের রিক্সাভ্যান চালক আজিজুল ইসলাম (৩৫), তার স্ত্রী রেজিয়া আক্তার (৩০), শিশু পুত্র মেহেদী (১১), মিজান (৮) ও সিজার (৪০)। এছাড়া, ময়মনসিংহ সদরের চরসিরতা গ্রামের জোছনা (৫৫) ও সিরাজুল (১৮), শেরপুরের নকলা উপজেলার শুক্কুর আলী (৬৫), নালিতাবাড়ি উপজেলার শাজাহান (২৬) ও শেরপুর সদরের খোরশেদ আলম (২৫)। আহতদের মধ্যে সেলিম (৩২), কদ্দুছ মিয়া (৩৫), জহুর উদ্দিন (২৫) ও ইমাজ উদ্দিন (৪০) এই চারজনকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আহতরা আশঙ্কামুক্ত। নিহত একই পরিবারের পাঁচ সদস্য রেজিয়ার অসুস্থ বাবা জলিলকে দেখতে বাড়ি আসছিলেন। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে নিহতদের স্বজনেরা শুক্রবার দুপুরে ভালুকা মডেল থানায় ভিড় জমালে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। এ সময় স্বজনদের কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে উঠে। নিহতদের পরিবারের অনুরোধে বেলা ২টার দিকে স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। এর আগে বেলা ১২টার দিকে দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় উল্টে যাওয়া ট্রাকটি। রাস্তার ওপর থেকে সরিয়ে নেয়া হয় সব সিমেন্ট। স্থানীয়রা জানায়, দুর্ঘটনার পর পরই সটকে পড়ে ট্রাক চালক। প্রত্যক্ষদর্শী রশিদ মিস্ত্রি (৩৫) ও চৌকিদার চঞ্চল জানায়, রাতে তারা স্থানীয় মেহেরাবাড়ি বাজারে টিভি দেখছিলেন। এ সময় বিকট শব্দে তারা ঘটনাস্থল এসে দেখতে পান সিমেন্ট বোঝাই ট্রাকটি উল্টে এর নিচে চাপা পড়েছে ১০-১৫ জন আরোহী। এদের মধ্যে মহিলা ও শিশুও ছিল। চালকের আসনের পাশে ভেতরে আটকা পড়েছিল ৩ জন। ভোর ৪টার দিকে রশিদ ও চঞ্চলের চিৎকারে আশপাশের মানুষ এসে প্রথমে উদ্ধারের চেষ্টা চালায় এবং একই সময়ে স্থানীয় পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসকেও খবর দেয় তারা। ভোর ৫টার দিকে স্থানীয়দের সহায়তায় উদ্ধার কাজ শুরু করে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ। কিন্তু এর আগেই সিমেন্টের বস্তার নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারায় নয় জন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নয় জনের লাশ উদ্ধার করে এবং জীবিকা পাঁচ জনকে উদ্ধার করে ভালুকা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠায়। পরে সেখানে মারা যায় আরও একজন। ভালুকার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের স্থানীয় ইউপি মেম্বার হাফিজুল ইসলাম এবং যুবক রামবাবু জানায়, মেহেরাবাড়ি অংশে উন্নয়ন কাজের জন্য মহাসড়কের বিভিন্ন জায়গা কাটা ছেঁড়া করে রাখা হয়েছে। কিন্তু কাটা অংশের লেনে কোন ব্যারিকেড না থাকায় উল্টো পথে আসা ট্রাকটি গর্তে পড়ে নিয়ন্ত্রণ হারালে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। ট্রাক চালকের ভুল পথে আসা এবং অসর্তকতাসহ খামখেয়ালিপনার কারণেই এত বড় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এজন্য স্থানীয় এলাকাবাসী ও নিহতদের স্বজনেরা ট্রাক চালকের শাস্তি দাবি করেছেন। অসুস্থ বাবাকে শেষ দেখা হলো না রেজিয়ার ॥ জীবন ও জীবিকার তাগিদে গত সাত মাস আগে ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার ঢাকিরকান্দা গ্রাম ছেড়েছিলেন রিক্সাভ্যান চালক আজিজুল। সঙ্গে নিয়ে যান স্ত্রী রেজিয়া ও ৩ শিশু পুত্রকেও। রাজধানী ঢাকার বাসাবো এলাকায় ভাড়া থেকে রিক্সা ভ্যান চালাতেন আজিজুল আর এগারো বছরের শিশু পুত্র মেহেদী। স্ত্রী রেজিয়া করতেন বাসা বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ। এভাবেই চলছিল পাঁচ জনের সংসার। তারাকান্দার গ্রামের বাড়িতে আজিজুলের বৃদ্ধ মা হনুফা আর দুই সহোদর ভাই শামছুল ও নজরুল থাকতেন। একই উপজেলার দাদরা গ্রামের বয়োবৃদ্ধ শ্বশুর জলিল অসুস্থ হয়ে পড়েছেন- মোবাইল ফোনে এমন খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার রাতেই কম ভাড়ায় ময়মনসিংহ ফেরার জন্য সিমেন্ট বোঝাই ট্রাকের আরোহী হয়েছেন আজিজুলের পরিবার। শুক্রবার বাড়ি ফিরেছেন তারা। তবে লাশ হয়ে। শুক্রবার সকালে খবর পেয়ে নিহত আজিজুলের সহোদর শামছুল ও পরিবারের সদস্যরা ভালুকা থানায় আসার পর তাদের আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। এ সময় শামছুল জানায়, অসুস্থ শ্বশুরকে দেখা হলো না আজিজুলের।
×