ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধার নামে সড়কের নামকরণ ঝুলে আছে ১১ বছর

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ২৫ মার্চ ২০১৭

মুক্তিযোদ্ধার নামে সড়কের নামকরণ ঝুলে আছে ১১ বছর

গাফিলতি আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে এক কিলোমিটার সড়কের নামকরণ ঝুলে আছে ১১ বছর। প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ ঠাকুরের পরিবার ও এলাকাবাসীর প্রতীক্ষার শেষ তবু হচ্ছে না। রায়েরবাজার হাইস্কুল মোড়ের হোল্ডিং নম্বর ২৩১ সুলতানগঞ্জ থেকে ২৯৫/বি টালি অফিস রোড পর্যন্ত সড়কটি মুরাদ ঠাকুরের নামে হওয়ার কথা ছিল ২০০৬ সালেই। এরপর অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (ডিসিসি) গাফিলতিতে ১০ বছর অপেক্ষা করেছেন তারা। আর বিভক্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) কর্তৃপক্ষও আমলান্ত্রিক জটিলতার অজুহাতে অপেক্ষায় রেখেছেন ১ বছর হলো। সড়কটির নামকরণ আজও হয়নি। এ বিষয়ে গত বছরের ১২ মার্চ জনকণ্ঠে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সে সময় বর্তমান মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেছিলেন, আগের ডিসিসি প্রশাসন নামকরণের প্রস্তাবটি যথাযথভাবে অনুমোদন করেনি। তাই নতুন করে আবেদন করার পরামর্শ দেন তিনি। মেয়রের পরামর্শ অনুযায়ী মুরাদ ঠাকুরের ছেলে আহ্সানুজ্জামান ঠাকুর স্বপন গত বছরের ২২ মার্চ স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সুপারিশসহ এ সংক্রান্ত একটি আবেদনপত্র ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দেন। এক বছরে ওই আবেদনপত্রের ওপর শুধু ধুলাই জমেছে, নামকরণের কাজ আর এগোয়নি। এ প্রসঙ্গে আহ্সানুজ্জামান ঠাকুর স্বপন জনকণ্ঠকে বলেন, আবেদনপত্র জমা দেয়ার পর নিয়মিত বিরতিতে যোগাযোগ রেখেছি। কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের কথা শুনে মনে হয়েছে, কেবল মেয়র উদ্যোগ নিলেই নামকরণের প্রক্রিয়াটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হতে পারে। স্বপন বলেন, নিজের নামে সড়কের নামকরণ করা হবে এই আশায় আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেননি। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এলাকার মানুষ তাকে নিয়ে গর্ব করতেন। তার মৃত্যুর পর শোকসভায় এলাকার মানুষ রায়েরবাজার হাইস্কুলের সুলতানগঞ্জ থেকে টালি অফিস পর্যন্ত সড়কটি তার নামে নামকরণের দাবি জানায়। এরপর ১১ বছর পেরিয়ে গেছে। ডিএসসিসির বর্তমান মেয়রের বাবাও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এখন শুধু একটা আশাই করি, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে তিনি রায়ের বাজারবাসীর আবেগ বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত সড়কটির আনুষ্ঠানিক নামকরণের ব্যবস্থা করবেন। সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) মুক্তিযোদ্ধা, ভাষাসৈনিক ও স্বনামধন্য ব্যক্তিদের অবদান স্মরণীয় করে রাখতে নগরের বিভিন্ন স্থাপনা ও সড়কের নামকরণ করার উদ্যোগ নেয়। সেই ধারাবাহিকতায় প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ ঠাকুরের নামে রায়েরবাজার হাইস্কুল মোড়ের হোল্ডিং নম্বর ২৩১ সুলতানগঞ্জ থেকে ২৯৫/বি টালি অফিস রোড পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করার আবেদন করে স্থানীয় বাসিন্দারা। আবেদনের সঙ্গে গণস্বাক্ষরও সংযুক্ত করা হয়। ২০০৬ সালের ২০ জুন ডিসিসির রাস্তা নামকরণ উপ-কমিটির নবম সভায় ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ ঠাকুর সড়ক’ নামে সড়কের নামকরণের বিষয়টি আনুষ্ঠানিক অনুমোদন করা হয়। এরপর থেকে এ নিয়ে ডিসিসিতে চলেছে একের পর এক চিঠি চালাচালি। অবিভক্ত ডিসিসির নির্বাচিত পর্ষদের অধীনে ৬৭ জন মুক্তিযোদ্ধা নামে নগরের ৬০টি সড়ক ও সাতটি স্থাপনার নামকরণ করা হয়। কিন্তু সেই তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ ঠাকুরের নাম নেই। মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ ঠাকুর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় তৎকালীন ডিসিসি প্রশাসন ও মেয়র মুরাদ ঠাকুরের নামে সড়কের নামকরণে তৎপরতা দেখাননি। পারিবার, মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন ও রায়েরবাজারের স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে, মুরাদ ঠাকুর তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সুবেদার মেজর ছিলেন। ইপিআরের পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসাররা বাঙালী সৈনিকদের সঙ্গে সবসময় চরম দুর্ব্যবহার ও হয়রানি করতেন। এসবের প্রতিবাদে মুরাদ ঠাকুর ইপিআরের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। এরপর একাত্তরে দেশমাতৃকার টানে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। ২ নম্বর সেক্টরের ক্যাপ্টেন আবদুল হালিমের অধীনে যুদ্ধ করেন মুরাদ ঠাকুর। শুধু নিজে যুদ্ধ করেননি, রায়ের বাজারের অসংখ্য তরুণ ও যুবককে সশস্ত্র প্রশিক্ষণও দিয়েছেন। তরুণদের গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়ে সেনাপতি হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। তার সহোদর দুই ভাইও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এর মধ্যে একজন পুলিশের এসআই ছাত্তার ঠাকুর যুদ্ধে শহীদ হন। মুরাদ ঠাকুরের সহযোগিতায় রায়েরবাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি শক্তিশালী গোপন ঘাঁটি গড়ে ওঠে। এখান থেকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনায় প্রায়ই চোরাগোপ্তা হামলা চালানো হত। মুক্তিযুদ্ধের পর সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এ এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে কাজ শুরু করেন তিনি। এছাড়া এলাকার উন্নয়নেও তার অবদান রয়েছে। স্থানীয় অভাবী, দুস্থ মানুষের চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য আজীবন কাজ করেছেন। রায়েরবাজারে বহু শিক্ষা, ধর্মীয় ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গঠনে এলাকাবাসীর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছেন মুরাদ ঠাকুর। ২০০৬ সালের ১৭ জানুয়ারি তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার দাফনসম্পন্ন হয়। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মুরাদ ঠাকুরের নামে ২০০০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেট ইস্যু করে, যার নম্বর ৪৯৯৬০। এরপর ২০০৯ সালের ২১ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্টিফিকেটে ও ২০১৫ সালের ৪ নবেম্বর প্রকাশিত গেজেটেও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার নাম উল্লেখ রয়েছে। এমনকি স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও তাকে ভুলেনি এলাকার মানুষ। একজন দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে রায়েরবাজার এলাকার সর্বত্র পরিচিতি তার। সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রায়েরবাজার হাইস্কুল মোড় থেকে টালি অফিস পর্যন্ত এক কিলোমিটারেরও কম দৈর্ঘ্যের সড়কটির বিভিন্ন জায়গায় পাঁচটি ব্যানার টানানো। মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ ঠাকুরের নামে সড়কটির নামকরণের দাবিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সংগঠনসহ স্থানীয় কমিশনার এবং আওয়ামী লীগ নেতারা এসব ব্যানার টানিয়েছেন। রায়েরবাজার হাইস্কুল মোড়ের একটি দোকান ঘেঁষে একটি নামফলক রয়েছে। দোকানদার জানালেন, মুরাদ ঠাকুরের নামে রাস্তার নামকরণের জন্য এই ফলক বসানো হয়েছিল। কিন্তু এত দিনেও ফলকে তার নাম ওঠেনি। রাস্তাসংলগ্ন একাধিক দোকানদারের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের আলাপ হয়। অনুমোদনের পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও সড়কের নামকরণ না হওয়ায় তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা প্রত্যেকেই জানান, মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ ঠাকুর একজন সমাজসেবী ও সজ্জন মানুষ ছিলেন। বর্তমান ডিএসসিসি মেয়রের কাছে তাদের দাবি, দ্রুত সড়কটির নামকরণ করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুরাদ ঠাকুরের স্মৃতির প্রতি যথাযথ সম্মান জানানোর। গত বছর সিটি কর্পোরেশনে জমা দেয়া স্বপন ঠাকুরের আবেদনপত্রে মুরাদ ঠাকুরের নামে সড়কের নামকরণের জন্য সুপারিশ লিখেছিলেন স্থানীয় ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোঃ সেলিম। এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে মোঃ সেলিম বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ওয়ার্ডের বিভিন্ন স্থাপনা ও সড়কের নামকরণের বিষয়ে ডিএসসিসির উদ্যোগ অব্যাহত আছে। এ জন্য দুই মাস আগে কর্পোরেশন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা চেয়ে একটি চিঠি কাউন্সিলরদের পাঠানো হয়েছে। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ ঠাকুরসহ আরও বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা, সমাজসেবক ও ত্যাগী রাজনীতিকের নামে স্থাপনার নামকরণের দাবি এলাকাবাসী জানিয়েছেন। নামের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। খুব শীঘ্রই কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তা জমা দেয়া হবে। কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই করে নামকরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন। ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, ডিএসসিসির সড়ক বা স্থাপনার নামকরণের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এর আগে কর্পোরেশন সাধারণ সভায় প্রস্তাবিত নামের ব্যাপারে সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ ঠাকুর সড়কের ক্ষেত্রে এর আগে এ প্রক্রিয়া অনুসৃত হয়নি। নামকরণের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল জনকণ্ঠকে বলেন, ওয়ার্ডের বিভিন্ন স্থাপনা ও সড়কের নামকরণের জন্য কাউন্সিলরদের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা চাওয়া হয়েছে। ওয়ার্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক কার্যালয় তালিকায় থাকা নামগুলোর প্রয়োজনীয় তদন্ত করবে। চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই শেষে কর্পোরেশনের বোর্ড মিটিংয়ে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
×