ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কয়েকটি অনু গল্প ॥ জেবুন্নেসার ‘পানি পানি’

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ২৪ মার্চ ২০১৭

কয়েকটি অনু গল্প ॥ জেবুন্নেসার ‘পানি পানি’

দুঃখজনক হলেও সত্য, জেবুন্নেসা বেগমের ছেলেরা তিনবারের সময় চরম বিরক্ত। শত বছরের নিকটবর্তী কমপ্লিটলি শয্যাশায়ী এই রোগীটির এর আগেও দুইবার জবান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ছেলেরা রুহের নিরাপদ যাত্রার জন্য দুইবারই কোরান খতমের আয়োজন করলেও মৃত্যুপথযাত্রী পরদিন ভোরের আগেই মৃত্যুকে জয় করে ফজরের নামায সফলভাবে আদায় করতে পেরেছিল। তাই এইবার জবান বন্ধ হলেও আয়োজন নেই। উল্টো ছেলেরা নৈশকালীন কাজও খুঁজতেছে! যাতে কাজের জরুরীতে তাদের সেবাবিহীন মায়ের মৃত্যুবিষয়ক অবহেলা নিজেরাও টের না পায়! তাই ছেলেরা কিংবা ছেলের বউদের না থাকার মধ্যেই জবান খোলার পর জেবুন্নেসা দেখে, শেষরাতে চাঁদ বড় হয়ে গেছে, খড়ের চালার ফুটো দিয়ে তা দেখে চরম পিপাসাযুক্ত হয়ে ‘পানি, পানি’ জবানে সে ছটফটানো অবস্থায় ফজর শেষ না করেই যাত্রা করল। ইন্তেকালের আগে তার মনে হয়েছিল, এই সেই চাঁদ যা সে ১৯৮৮ তে দেখেছিল! মা চলে যাবার কিছুদিনের মধ্যেই ছেলেরা দেখল, গ্রামের সবচেয়ে পুরনো কবরটায় বাচ্চারা মাছ ধরছে, যেটা অনেক উঁচুতে। রাস্তাগুলো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। চাপকল থেকে পানি নেওয়া যাচ্ছে না। প্রতীক্ষা অনেক বছর আগে আমি একবার এক পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম। ঢুকতেই দেখি এক বৃদ্ধ ভাঙা একটা চেয়ারে বসে কাঁপছেন। ঠোঁটের কোনা দিয়ে লালা ঝরছে। আমি বাড়িটা সম্পর্কে ধারণা নিতে তাঁকে প্রশ্ন করলাম, ‘কদ্দিন ধরে আছেন দাদা এ বাড়িতে? আমি কি একটু ঘুরে দেখতে পারি? ’ শুনে তিনি আঁতকে উঠলেন। জানতে চাইলেন, ‘এইডা কি আপনার পূর্বপুরুষদের বাড়ি? ওপার থেকে আইছেন?’ ফলে আমার তাঁকে এভাবে বলতেই হলো, ‘জি না, আমি ঢাকা থেইকা আসছি।’ এবার তিনি উত্তেজনা কমিয়ে কেন যেন কেঁদে দিলেন। তারপর বললেন, ‘মাফ করবেন বাবা, চোখে দেহি না তো।’ বিভোর জীবনের শেষভাগে অভিমানকেই মানে পরিণত করে আবুল হাশেম পরিচিতদের বলতেন,‘ প্রায় ত্রিশ বছর ভোর দেখি না মিস্টার। রাত করে ঘুমাই, উঠি এগারোটায়।’ বেশ ভাবসাব নিয়ে বললেও বোঝা যেত, কথাটার কোথায় যেন একটা দুঃখের গিট্টু আছে। আজ সকালে জানা গেল, হাশেম সাহেব সুইসাইড করেছেন। চোখ তার খুলে গেছে পাখির ডিমের মতো ফুটে। তাতে হেরে যাওয়া পড়া যাচ্ছে। যুবক বয়সে প্রিয় মানুষটার সঙ্গে বসে ভোর দেখার কথা ছিল তার। নির্দিষ্ট রাতে তিনি গেলেন, কিন্তু ভোর হয়ে সকাল হয়ে গেলেও সে এলো না। তারপর থেকে অভিমানে জীবনে আর কখনো ভোর দেখেননি হাশেম। ভুলেও যাতে ভোরে ঘুম না ভাঙে শেষরাতে ঘুমাতেন। গতকাল সন্ধ্যায় হঠাৎ তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ হলেন। একসময় জ্ঞানও হারালেন। হারের চর অনেক স্মরণীয় ঘটনা শুধু সম্পূর্ণ হওয়ার দরুন তাতে স্মরণের আনন্দ অহেতুক হয়ে পড়ে। আবার কিছু ঘটনা অসম্পূর্ণ হেতু চিরস্মরণীয়। বেলা-অবেলায় মনে পড়ে। কদিন আগে বন্ধু প্রকাশ কর্মধারয় দেশের নীরব-প্রান্তিক গহীন এক চরে নিয়ে গেল একটা ‘কনফিডেনসিয়াল কালচার’ দেখাবে বলে। পথ আধেক যেতেই রোম খাড়া হওয়া অবস্থা। যেখানে যাচ্ছি, একযুগ আগে একবার একা আমি গিয়েছিলাম! প্রকাশকে বললাম না। তবুও বর্তমানের শিহরণে এগিয়ে চললাম চরে। গোধূলিবেলায় আমরা শহুরে দুই যুবক হারের চরে পৌঁছে পানির খোঁজ করব করব ভাব। পিপাসায়। কিন্তু, পানি পাওয়ার আগেই পাণিগ্রহণ প্রস্তাবের অদেখা রীতি প্রকাশের সুযোগটি পেয়ে গেল প্রকাশ। এটা দেখাতেই এই প্রত্যন্ত বিরানে ডেকে এনেছে। মেয়েটির কাঁখে মাটির কলসি, চুল বাঁধা, কানে সোনার পাশা, নাকে কনক-নথ, শুধু গলায় কালো সুতা, স্বর্ণহীন। বন্ধু ফিসফিয়ে বলল, ‘এখানে নিজবাড়ির বাইরে কোনো পুরুষ কোনো উপযুক্ত মেয়েকে ডাকলে তারা থামে না। একশর্তে থামে। এই ল সেই শর্ত এই ক্ষণে পূরণ করব।’ প্রকাশ তার জিন্স প্যান্টের পকেট হাতড়ে কী একটা বের করে মেয়েটাকে ইশারায় ডেকে নিকটে গেল। আমি নির্বিকার। একটা সোনার হার, মেয়েটির গলায় পরিয়ে দিল। এইবার তার দেহে ষোলআনা স্বর্ণপ্রভা। আন্ধারিতেও। এখানে গোধূলিকালে সামর্থ্যবান হারবাহী পুরুষ তার পছন্দের নারীকে এইভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। হার গলায় মেয়েটি চলে গেলে বুঝতে হবে বিবি এই মিয়াতে রাজি। মেয়েটি চলে যাচ্ছে। প্রকাশ ফিরছে। পণ পূরণের উচ্ছ্বলতা তার। চরের মেয়েকে বিয়ে করার পণ করেছিল সে, এইভাবে। সে আশাপূর্ণা। প্রকাশ ক্রমেই হারের চরের নির্জনতার ঘন আন্ধার থেকে হালকা আন্ধারে আমার নিকটে প্রকাশিতব্য। এই ক্ষণে নিরালা আন্ধার প্রবাহে শূন্যপথে আমার কেবলই স্মরণে আসছে, একযুগ আগে এইখানে এই মায়াপ্রপঞ্চে আমি এসেছিলাম! তখন আমার কুঁড়ি বছর। এমনই এক গোধূলিবেলায়, কলসি কাঁখে দূরের কলতলা থেকে পানি আনতে যাওয়া এক বালিকা আমাকে ইশারা দিয়েছিল। তার খালি কলসির ভেতর থেকে একটা হার বের করে কী যেন বলতে চেয়েছিল! সে জানত, আমি হারবাহী না? সেদিন সকালেই তার সঙ্গে প্রথম দেখার পর সে তাকিয়ে হেসেছিল। গোধূলিবেলায় ফ্রি হার হাতে পেয়েও সেদিন বুঝতে পারিনি আজকের এই কনফিডেনসিয়াল কালচার! বালিকা কোথায়? শূন্য কলসিতে হারের বাজনা শুনলাম হারের চরে।
×