ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাইসুল সৌরভ

চোখ ঝলসানো কনকারিয়া লেক

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ২৪ মার্চ ২০১৭

চোখ ঝলসানো কনকারিয়া লেক

এবারের ভারত ভ্রমণে আমাদের দশজনের দলটি যখন গুজরাটের মাটিতে নিজেদের পদচিহ্ন এঁকে দিতে আহমেদাবাদ শহরে প্রবেশ করি তখন বেলা দ্বিপ্রহর গড়িয়েছে। শহরে পৌঁছে তাই ভ্রমণক্লান্তি কিছুটা লঘু করতে করতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যাওয়ায় কোথায় যাওয়া যায় ভাবছি, তখনই মাথায় এলো রাতের আলোয় মোহনীয় কনকারিয়া লেকের কথা। স্থানীয় গাইডের সঙ্গে আলোচনায় আবিষ্কৃত হলো পরদিন শেষবেলায় লেকের ঢেউ খেলানো পানিতে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে চাইলে আমাদের পরিকল্পিত পরবর্তী যাত্রা সাঙ্গ হতে পারে। তাছাড়া স্মৃতিও জ্বালাচ্ছিল রাতের মায়াবী আলোতে কনকারিয়া লেকে অবগাহন করতে। তাই ক্লান্তিকে ছুটি দিয়ে মুহূর্তের সিদ্ধান্তে তখনই গাইডকে ফেলে রেখে নিজেরাই দিলাম ছুট কনকারিয়া পানে। ঘন কালো নিশিতে কনকারিয়া সরোবরের প্রবেশদ্বার মাড়িয়ে ভেতরে পা ফেলতেই লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, বেগুনি বাহারি রঙের রঙিন আলোর রোশনাই চোখ ধাঁধিয়ে দিল। সম্রাট কুতুবউদ্দিনের আমলে পঞ্চদশ শতকে খনন করা সোয়া তিন কিলোমিটার আয়তনের লেকটি রাতের বেলাতেই যেন অপেক্ষায় থাকে দর্শনার্থীদের চোখ ঝলসে দিতে। পুরো লেকের চারিপাড় ধরে জ্বলে থাকা রঙ-বেরঙের আলোর প্রতিচ্ছবি যখন সরোবরের জলের মৃদু ঢেউয়ের সঙ্গে ঈষৎ স্পন্দিত হতে হতে মিলিয়ে যেতে থাকে তখন লেকের পানিতে যে মোহময়তার আবহ ছড়িয়ে পড়ে তা ভাষায় প্রকাশ করা দায়। কনকারিয়া লেকের আপন সৌন্দর্য মূলত বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে বিচিত্র এই আলোকসজ্জা; তাই নিরেট অন্ধকার রাত্রি-ই কনকারিয়ার পাড়ে পা ফেলার সর্বোত্তম প্রহর। দিনের আলোতে হয়ত সময় তার বৃদ্ধ নিস্তরঙ্গ ঢেউয়ে সঙ্গে মিলিয়ে যায়; কিন্তু কনকারিয়া তো রজনীর অপেক্ষায় থাকে আঁধারের সংস্পর্শে নিজের জৌলুস উদ্ভাসিত করে দর্শনার্থীদের দৃষ্টিতে ধরা দিতে। যদিও সম্রাট প্রধানত মানিনগরকে বেছে নিয়েছিলেন কনকারিয়া লেক খনন করে প্রাত্যহিক স্নানকার্য সম্পাদন করতে, তথাপি কালের আবর্তে স্নানের পরিবর্তে বর্তমানে তা নগরের অধিবাসীদের আমাদের স্থলে পরিণত হয়েছে। আদিতে লেকটি সম্রাটের নামানুসারে হাউস-ই-কুতুব নামে পরিচিতি পেলেও সময়ের প্রবাহে সংস্কারের পর ২০০৮-এর বড়দিনের পর থেকে তা কনকারিয়া লেক নামে নিজেকে ভ্রমণার্থীদের ক্লান্তি লাঘবের স্থল হিসেবে জাহির করে চলছে। বৃত্তাকার লেকের ঠিক মধ্যিখানে নাগিনা ওয়াদি নামের কৃত্রিম একটি ফুলেল দ্বীপ তৈরি করা হয়েছে; যেখানে চাইলে কনক্রিটের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে গাছ-গাছালি আর ফুলাবৃত্ত পরিবেশে সঙ্গীতের তালে তালে ঝর্ণার রঙিন জল দুলতে দেখে বা লেজার শোয়ের জাদুতে মজে সমগ্র সরোবরের সৌন্দর্যের সঙ্গে মিলেমিশে অবগাহন করা যাবে। লেকটিকে কেন্দ্র্র করে জনসমাগমের উপস্থিতিতে বিনোদন বণিকেরাও তাদের পসরা সাজিয়ে বসতে ভুল করেনি; সেখানে তারা বিনোদনের খুব কম উপাদান-ই অনুপস্থিত রেখেছে। চাইলে ছোট্ট ট্রেনে চেপে বৃত্তাকারে পুরো লেক একবার পাক দিয়ে দেখা যাবে। আছে হাঁটার জন্য চমৎকার ওয়াকওয়ে; স্থানীয় অধিবাসীরা যেখানে গাঁটের পয়সা খরচ করে রোজ সন্ধ্যায় ঘাম ঝরাতে আসে। অবাক করেছে কনকারিয়া লেকের পরিচ্ছন্নতা; কোথাও এতটুকু উচ্ছিষ্ট পড়ে নেই। গাছের পত্র-পল্লব পড়া মাত্রও পরিচ্ছনতা কর্মীটি সঙ্গে সঙ্গে তা কুড়িয়ে নিচ্ছে। মোদিজির স্বচ্ছ ভারত যে তার নিজ রাজ্যে বেশ সফলতার সঙ্গেই উতরে গেছে কনকারিয়া লেকের স্বচ্ছ জলাধারের মতোই এর স্বচ্ছ পাড়ও ভিনদেশী পর্যটকদের নিকট সে প্রমাণ বহন করে চলছে। লেকের একপাড়ে শিশুদের জন্য রয়েছে আধুনিক এ্যামিউজমেন্ট পার্ক, চিড়িয়াখানা, বেলুন সাফারি প্রভৃতি; চলতে চলতে ক্ষুধা পেয়ে গেলে আছে আহারের ব্যবস্থা। এতটুকু পড়ার পড়ে মনে হতে পারে লেকের ধারের বিনোদনের সব উপকরণ কি আর জলকেলির আনন্দ মেটাতে পারে? তা ঠিক; তবে লেকের পানিতে জলকেলিতে মেতে ওঠার সুযোগ না থাকলেও জলযানে চেপে সরোবর চক্কর দেবার ব্যবস্থা ঠিক-ই রাখা হয়েছে। ভাললাগার জিনিসে কিছুটা না পাওয়া যেন নিয়ম হয়ে উঠেছে আমার জন্য। কনকারিয়া লেকও সে না পাওয়া থেকে বঞ্চিত করেনি আমাকে। লেকের জলে পা চুবিয়ে একাকি বসে বসে যদি ঢেউয়ের সঙ্গে অভিমানগুলো ভাসিয়ে দেয়া না যায়; দু’টো গোপন কথা কনকারিয়াকে চুপি চুপি জানিয়ে না আসা যায়; তবে আর অত পথ মাড়িয়ে তাকে কেবল দেখে কি আর আঁশ মেটে? এ প্রশ্ন শেষমেষ তাই উঠতেই পারে। আহমেদাবাদ মিউনিসিপাল কর্তৃপক্ষ এবং যে বেসরকারী বাণিজ্যিক সংস্থাটি বর্তমানে লেক দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে তারা দর্শনার্থীদের লেকের পাড়ে বসে ঢেউ গণনার ব্যবস্থা রাখলেও পাড় ঘিরে উঁচু দেয়াল দিয়ে পা ভেজানোর পথ রহিত করে রেখেছে। হয়ত তাতে কনকারিয়াকে পেয়েও না পাওয়ার আফসোস বেড়েছে; কিন্তু আখেরে কনকারিয়া বুঝিয়েছে তার রূপ সহজলভ্য হলেও সে নিজে অভেদ্য। আসার সময় কেবল মনে হচ্ছিল আমাদের রাজধানীর বুকেও চমৎকার রবীন্দ্র সরোবর আছে, শুলশান লেক আছে; যদিও হাতির ঝিল ইতোমধ্যে ভাগাড়ে পরিণত হতে বসেছে। তথাপি নিদেনপক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কৃত্রিম লেকটিকেও কি কনকারিয়া লেকের মতো বাহারি আলোতে ভরিয়ে স্বচ্ছ জল আর পাড় বানিয়ে নগরবাসীদের ক্লান্তি কিছুটা মিলিয়ে দিতে উদ্যোগ নেয়া যায় না? [email protected]
×