ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি

কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ কিন্তু ভূমিতে প্রবেশাধিকার অনিশ্চিত

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ২৪ মার্চ ২০১৭

কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ কিন্তু ভূমিতে প্রবেশাধিকার অনিশ্চিত

পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার বিলকুড়লিয়া গ্রামে বাস করে সোনাভান খাতুন। তার জন্ম কৃষক পরিবারে, এমনকি তার স্বামীও একজন কৃষক। ছোটবেলা থেকেই কৃষির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক সোনাভানুর। কৃষি কাজে পারদর্শীও বটে এই নারী। উত্তরাধিার সূত্রে সে ও তার স্বামী আজগর কৃষি জমি ও সম্পত্তি থেকে বঞ্ছিত হওয়ার পর মাত্র দুই বিঘা জমি কিনে স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে শুরু করেন কৃষি কাজ। এ জমিতে ধানসহ পেঁয়াজ-রসুনের চাষ করেন সোনাভানু। পরিবারের ওপর একচ্ছত্র অধিকার রয়েছে সোনাভানুর। তার স্বামীও তার সব কাজে পাশে থাকেন। সোনাভানু জানান, ‘ছোটবেলা থেকে কৃষি কাজের মধ্যেই বড় হয়েছি। মেট্রিক পাস করার পর আব্বা বিয়ে দেন। কিন্তু আমার স্বামী আমার পড়ালেখা বন্ধ করেননি। সে আমাকে বিয়ের পর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। এরপর আমি ডিগ্রী পাস করি।’ একজন শিক্ষিত নারী হয়েও সোনাভানু কৃষির ওপর নির্ভরশীল। পারিবার ও মাঠ দুটো জায়গাতেই সমান ভূমিকা পালন করেন তিনি। মাঠের চাষ থেকে শুরু করে বীজ তোলা, সার প্রয়োগ, ফসল কাটা, এমনকি ফসলের বোঝা মাথায় করে ঘরে আনা এসব কিছুই স্বামীর পাশাপাশি সোনাভানুও করতে অভ্যস্ত। তিনি বলেন, ‘আমি মাত্র ৬ ঘণ্টা ঘুমায়। আর বাকি সময়গুলো সংসার ও মাঠের কাজেই পার করি। একজন নারী কৃষক হিসেবে আমি সফল।’ পর্যাপ্ত জমি না থাকায় কৃষি কাজ করে সোনাভানু পরিবারের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনতে না পারলেও এক ছেলে ও মেয়েকে পড়ালেখা না শেখানোর ভুল করেননি। তার মেয়ে ডিপ্লোমা ইন নার্সিংয়ে পড়ছে এবং তার ছেলে পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে। সোনাভানু জানান, তাদের বিলকুড়ালিয়া গ্রামে ৮০ শতাংশ নারী কৃষক কৃষি কাজে যুক্ত।’ সোনাভানুর মত অনেক নারী কৃষক রয়েছে আমাদের দেশে। যাদের কষ্টের ফসল আমরা ভোগ করি। এক গবেষণায় দেখা গেছে বিশ^ব্যাপী ৬৬ শতাংশ নারী কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অপর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে বাংলাদেশের ৮৮ শতাংশ গ্রামীণ নারী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষি কাজে জড়িত (্বারকাত, ড. আবুল, এইচডিআরসি : ২০০২)। বাংলাদেশ সরকারের দেয়া তথ্যানুযায়ী কৃষি অর্থনীতিতে গ্রামীণ নারীর অবদান ৬৪.৮৪ শতাংশ এবং পুরুষের অবদান ৫২.৮ শতাংশ। ২০০২-০৩ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ হারের প্রবণতা দেখাচ্ছে। এতে দেখা যাচ্ছে যে, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার ২০০২-০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষের অংশগ্রহণ হ্রাস পেয়েছে। ২০০২-০৩ সালে শ্রমশক্তিতে পুরুষের অংশগ্রহণ ৮৭.৪ শতাংশ থেকে ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়ে ২০১৩ সালে ৮১.৭ শতাংশে নেমে আসে। পক্ষান্তরে, নারীর অংশগ্রহণ ২০০২-০৩ সালে ২৬.১ শতাংশ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ক্রমবর্ধমান। আলোর পেছনে যেমন অন্ধকার থাকে তেমনি উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান এই ধারার সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এখনও অধিকার বঞ্চিত। বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার নারীরা কৃষক হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত। [জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশ১৯৭০ এবং ’৮০ এর দশকে বাংলাদেশে খুব কম নারী বাড়ির বাইরে গিয়ে কৃষি কাজে অংশগ্রহণ করত। তাদের কৃষি কাজ বলতে প্রধানত বাড়ির আঙ্গিনায় সবজি উৎপাদন, ধান উৎপাদন পরবর্তী যে সব কাজ যেমন- ধান সেদ্ধ, মাড়াই, ধান শুকানো এবং হাঁস-মুরগি পালনকেই বোঝাত। তবে, ’৯০ এর দশকের শুরু থেকেই নারীরা জমি প্রস্তুত, ধান রোপণ, ধান কাটা থেকে শুরু করে সকল কাজই করে। পাশাপাশি বাড়ির গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি পালনের কাজকর্মের সঙ্গেও জড়িত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নারীর অবদান খুব একটা দৃশ্যমান নয়। এর কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়েছে বাংলাদেশের সমাজে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক নিয়মকানুন যা সর্বত্রই বিরাজমান, যা নারীকে সব সময় অবদমিত করে রাখে। বসতবাড়ির সবজি/ফল উৎপাদন ও পশুসম্পদ যেমন : হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল প্রভৃতি উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায় নারীর অংশগ্রহণ শতকরা ৪৫-৮৫ ভাগ। গ্রামীণ নারী দিবস উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত একটি সেমিনারে এ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের একটি উপস্থাপনায় দেখা যায়, কৃষি ক্ষেত্রে ক্ষমতায়নের ৫টি নির্ণায়কে বাংলাদেশী নারীর অবস্থান যথাক্রমে- উৎপাদনে-১৪.৯%; সম্পদে অভিগম্যতা-২১.৬%; আয়ে-১৫.৮%; নেতৃত্বে-৩৫.১%; এবং সময়ে-১২.৭% এবং ১০টি নির্ণায়কে গ্রামীণ নারীর অবস্থা যথাক্রমে- সিদ্ধান্ত গ্রহণে অবদান-১১.৩%; উৎপাদনে- ৩.৬%; সম্পদের মালিকানা- ৪.৬%; সম্পদ ক্রয়, বিক্রয় বা হস্তান্তর- ৭.৫%; ঋণ প্রাপ্তিতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ-৯.৫%; আয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ-১৫.৮%; দলীয় সদস্যপদ-১৮.৩%; জনসমাজে কথা বলার ক্ষমতা-১৬.৭%; কাজের বোঝা-৪.৮%; এবং বিনোদন- ৭.৯% । রাষ্ট্র ২০০৯ সালে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন এবং পরবর্তীতে ২০১১ সালে তা সংশোধন করেছে। কিন্তু সেই পরিবর্তনও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় বহন করছে। ফলে জমি-জায়গা ও কৃষিতে নারীর অধিকার বা ভূমিকা অবমূল্যায়িত রয়েছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৯.৪ শতাংশ নারী কিন্তু ভূমিতে গ্রামীণ নারীর মালিকানা মাত্র ২-৪ শতাংশ এবং বাকি ৯৬ শতাংশ জমির ব্যক্তি মালিকানা রয়েছে পুরুষের নামে। খাস জমি বিতরণ নীতিমালা অনুযায়ী অগ্রাধিকার তালিকায় নারীর যৌথ মালিকানার কথা বলা হয়েছে। সেখানে বিধবা নারীদের ক্ষেত্রে সক্ষম পুত্র সন্তানসহ আবেদনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ভূমিহীন নারীদের একক নামে সরকারী খাস জমি বরাদ্দ দেয়ার জন্য সরকারের এই নীতিমালায় কোথাও কিছু বলা হয় নাই। একদিকে জেন্ডার বৈষম্য এবং পুরুষতান্ত্রিকতার সামগ্রিক আবহে কৃষিসংক্রান্ত প্রযুক্তিগত তথ্য, কৃষি সম্প্রসারণ সেবা, সার, বীজ, সেচের পানি, বাজার ব্যবস্থা ইত্যাদি সুবিধাদি থেকে যেমন নারী বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে, নারী কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি না থাকার কারণে কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত নারীরা প্রয়োজনীয় ব্যাংক ঋণও পাচ্ছে না। ব্যাংক ঋণ উত্তোলনের কোন সুযোগ পেয়েছেন কিনা প্রশ্নে জবাবে সোনাভানু বলেন, ‘আমাদের চাটমোহর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নে প্রায় ৪০০ জন নারী কৃষিকার্ড পেয়েছেন। এ ছাড়া নিয়ম অনুযায়ী ১০ টাকার বিনিময়ে ব্যাংক এ্যাকাউন্টও খুলেছি আমরা। কিন্তু ঋণ পেতে হলে কার্ডধারী নারীর নামে ৩১ শতক জমি থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের গ্রামে প্রায় ১৪০০ ভূমিহীন পরিবার রয়েছে। (চলবে)
×