ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শিশুরা অশুভ সঙ্কেতে যেন বিপন্ন না হয়

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ২৪ মার্চ ২০১৭

শিশুরা অশুভ সঙ্কেতে যেন বিপন্ন না হয়

দশ মাস দশদিন একটি শিশু মাতৃজঠরে যেমন নিরাপদ আর সুরক্ষায় থাকে একইভাবে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরও সেই মায়ের কোলই হয় তার সব থেকে নির্ভরযোগ্য এবং স্বস্তির আশ্রয়। আর সেখানেই যদি কোন ভয়ঙ্কর আশঙ্কা কিংবা শ্বাপদ শঙ্কুল অরণ্যের মতো কোন বিভীষিকাময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয় তাহলে শিশুটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা ভাবতেও অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। শুধু কি শিশুর নিরাপত্তা? একজন মায়ের আজন্ম লালিত স্বপ্নে যে মাতৃত্বের আকাক্সক্ষা তিল তিল করে বাস্তবে রূপ নেয় সেই রোমাঞ্চকর অনুভবকেও কি কোনভাবেই হালকা করে দেখা যায়? রবীন্দ্রনাথের মতে কোন মেয়ের দ্বৈতরূপের একটি স্নেহে, মায়ায়, মমতায় সে মাতা আর প্রেমে, পূজায়, নিবেদনে সে প্রিয়া। মাতৃত্ব যে কোন মেয়ের জীবনে এক অতুলনীয় সম্পদ এবং সন্তানের শারীরিক আর মানসিক গঠনেও মায়ের বিকল্প আর কিছুই হতে পারে না। জানি না কোন অপঘাতে আজ চিরায়ত মাতৃত্বের স্নেহ ধারা তার কোলের সন্তানকেও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গত ১৫ মার্চ বুধবার চট্টগ্রামের সীতাকু- উপজেলার ৪নং ওয়ার্ডের আমিরাবাদ জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের সশস্ত্র অভিযানে আত্মঘাতী বোমা হামলায় এক দম্পতি শিশু সন্তানসহ নিহত হয়। অপর দম্পতি শিশু সন্তানসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়। জঙ্গী আস্তানা ‘সাধন কুটির’ থেকে বেঁচে যাওয়া দম্পতি জসিম ও তার স্ত্রী আরজিনাকে পুলিশী হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের ছয় মাসের শিশু সন্তান মোসলেনকে এক নারী পুলিশের কাছে আশ্রয় দেয়া হয়। নিহত দম্পতি কামাল হোসেন এবং তার স্ত্রী জোবাইরা ইয়াসমিনের শিশু সন্তান অভিযানের এই সংঘর্ষে নিহত হয়। নিহত এবং বেঁচে যাওয়া দম্পতিরা একই পরিবারের সদস্য বলে অনুমান করা হচ্ছে। এক সময় এই জঙ্গীবাদ ব্যক্তিক পর্যায়ে সীমিত থাকলেও বর্তমানে তা পুরো পরিবারকে এক সুতায় আবদ্ধ করেছে। যার কারণে বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে তাদের শিশু সন্তানটিও এখন জঙ্গীবাদের মারাত্মক থাবায় লাঞ্ছিত হচ্ছে। সর্বগ্রাসী যে কোন অশুভ ছায়া পারিবারিক নির্মল আবহের ওপর প্রভাব পড়লে তার যে কিরূপ ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে এর প্রমাণ আগেও অনেকবার হয়েছে। জঙ্গী হামলায় বোমা বিস্ফোরণে আত্মঘাতী মায়ের মৃত্যু হলে কোলের সন্তানটি স্পিলিন্টারের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েও বেঁচে যায়। তারও আগে জঙ্গী হামলায় বাবা নিহত হন। জানি না সেই অবোধ, অনাথ শিশুটি আজ কার ছায়ায় তার জীবন এবং মনকে গড়ে তুলছে। যে অশুভ সঙ্কেতে তার জীবনটা অনিশ্চয়তার দিকে মোড় নিয়েছে সে দুর্বিসহ অবস্থা থেকে বেরুনোর পথ কি সত্যিই খোলা থাকে? পরের বাড়িতে অথবা কোন অনাথ আশ্রমে কিংবা সহায় সম্বলহীন হিসেবে তার কঠিন জীবনের বৈতরণী পার করতে হবে। সীতাকু-ের সেই ছয় মাসের শিশু সন্তানটি আজ পুলিশের দায়িত্বে থাকা এক নারীর বিশেষ তত্ত্বাবধানে পালিত হলেও তার ভবিষ্যত কোথায় গিয়ে যে তাকে তাড়িত করবে সে উত্তর আসলে কারও জানা নেই। এই বিধ্বংসী, সর্বনাশা, কঠিন পথ নারী-পুরুষ এবং তাদের সন্তানদের ভাবী জীবনকেও যেভাবে উদ্দেশ্যহীন ভুল পথের দিকে নিয়ে যাচ্ছে সেখান থেকে সুস্থ স্বাভাবিক পথে ফিরতে না পারলে পরিবার থেকে আরম্ভ করে সমগ্র দেশের জন্য বিরূপ পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে। কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটার জন্য যে সিক্ত পরিচর্যা, স্নেহ মাধুর্যের যে নির্মল আবহ তা প্রত্যেকটি শিশু সন্তানের জন্মগত এবং মৌলিক অধিকার। এই অধিকার মা-বাবা থেকে আরম্ভ করে সমাজ সংস্কার সবাইকে পরিপূর্ণভাবে দিতে হবে প্রতিটি শিশুকে। আর সেজন্য দরকার একটি সুস্থ পরিবেশ, পরিচ্ছন্ন সামাজিক আবহ সর্বোপরি মা-বাবার সচেতন দায়বদ্ধতা। ধর্ম যে কোন মানুষের ব্যক্তিক এবং পরিশুদ্ধ আত্মিক ব্যাপার। যা যে কোন সহিংস ঘটনা কিংবা অহেতুক রক্তক্ষয় এবং মূল্যবান জীবনকে বিপন্ন করতে সায় দিতেই পারে না। সব ধর্মই শান্তির বার্তা নিয়ে মানুষের মঙ্গল কামনায় পৃথিবীর বুকে তার স্থান করে নিয়েছে। সংঘর্ষের পথে নয়Ñ যৌক্তিক এবং নিষ্ঠার সঙ্গে ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে চলা ধর্মেরই নির্দেশিত পথ। আর এই শুভ আর শুদ্ধ পথের ব্যত্যয় হলে ইহকাল-পরকাল কোনটাই থাকে না। ধর্মীয় শিক্ষা আসবে পরিবার থেকে, মায়ের স্নেহছায়ায়। মা-ই তার সন্তানকে ন্যায়নিষ্ঠতার সঙ্গে ধর্মীয় আদেশ পালনে উদ্বুদ্ধ করবে, সহজ স্বাভাবিক পথে ধর্মীয় বোধকে ভেতর থেকে জাগিয়ে তুলবে। সব ধরনের শিক্ষায় সন্তানের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে হবে। কোন রক্তস্নাত সাংঘর্ষিক পথ এবং সন্তানের মূল্যবান জীবন কখনও এক সুতায় গাঁথা হতে পারে না। যুগ যুগ ধরে আমাদের দেশে পারিবারিক ঐতিহ্যের নির্মল আবহে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বেগম রোকেয়া, বেগম সুফিয়া কামালের মতো চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের অভ্যুদয় ঘটেছে। ভবিষ্যতেও এমন ধরনের সমাজ বিনির্মাণের অগ্রপথিকরা পারিবারিক সুশৃঙ্খল প্রতিবেশ থেকেই গড়ে ওঠবে যা একটি সুস্থ সমাজকে তার প্রয়োজনীয় সমস্ত ঐশ্বর্য আর বৈভবে পূর্ণ করবে। সুতরাং পারিবারিক নির্ভরতা, মা-বাবার সচেতনতাই নতুন কিংবা ভবিষ্যত প্রজন্মকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে দাঁড় করাবে। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×