ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রূপকথার বিদায় লুকাস পোডলস্কির

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২৪ মার্চ ২০১৭

রূপকথার বিদায় লুকাস পোডলস্কির

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ যেন সিনেমার চিত্রনাট্যকেও হার মানিয়েছে। লুকাস পোডলস্কির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষের উৎসবটা তেমনই হয়েছে। বুধবার রাতে জার্মানির সিগনাল ইদুনা পার্কে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল দুই পরাশক্তি জার্মানি ও ইংল্যান্ড। প্রীতি ম্যাচ হলেও উত্তেজনার কমতি ছিল না। তবে সবকিছু ছাপিয়ে জার্মানি জাতীয় দল থেকে পোডলস্কির বিদায়টাই ছিল মুখ্য। শেষ বেলায় এসেও নিজের জাতটা চিনিয়েছেন পোডলস্কি। লিরয় সানি, টিমো ওয়ার্নার, টসি ক্রুসরা যখন গোলের জন্য হাহাকার করছেন, এমন সময় আরেকবার জার্মানির ত্রাতা হয়ে দেখা দেন জার্মান এই ফরোয়ার্ড। গোলপোস্টের ২৫ গজ দূর থেকে এমন এক গোল করলেন, তাতে ইদুনা পার্কের দর্শক অনেকক্ষণ বিমোহিত হয়ে ছিলেন। পোডলস্কির এই গোলেই আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে ইংল্যান্ডকে ১-০ গোলে হারিয়েছে জার্মানি। জয়সূচক গোলটি করে নিজের বিদায় স্মরণীয় করে রাখলেন পোডলস্কি। এই ম্যাচে সবকিছুই পোডলস্কিকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। বিদায়ী সম্মান জানাতে তার বাহুতেইছিল অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড। ২০০৪ সালে হাঙ্গেরির বিপক্ষে অভিষেক হওয়ার পর জার্মানদের হয়ে ১৩০ ম্যাচ খেলেছেন তিনি। যা দেশটির ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ। এই সময়ে ৪৯ বার প্রতিপক্ষের জাল কাঁপিয়েছেন পোডলস্কি। মাত্র ৩১ বছরেই জাতীয় দলকে বিদায় বলে দিলেন। এই বয়সেই ১৩০ বার নেমেছেন জার্মানির হয়ে। খেলেছেন তিনটি বিশ্বকাপ ও তিনটি ইউরো। কোনবারই সেমিফাইনাল না খেলে ফেরেননি। ২৪ বছর পর জার্মানিকে বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ এনে দেয়া দলেও ছিলেন তিনি। বিদায়ী ম্যাচ শেষে পোডলস্কি বলেন, যেভাবে শেষ হলো তা অনেকটা চলচ্চিত্রের ঘটনার মতোই। স্বয়ং ঈশ্বর অথবা অন্য কেউ আমাকে যে শক্তিশালী বাঁ পা দিয়েছে সেটাই ব্যবহার করেছি। গত ১৩ বছর আমি যা করেছি তাতে আমি সত্যিকার অর্থেই গর্বিত। এটা একটি অসাধারণ ম্যাচ ছিল। ম্যাচের ফলাফলও আমাদের দিকে গেছে। এভাবে বিদায় জানানোর সুযোগ হবে কখনই ভাবিনি। বিদায়বেলায় শত্রু-মিত্র সবাই প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন পোডলস্কিকে। ইংল্যান্ডের গোলরক্ষক জো হার্ট তো ভাসিয়েছেন আর ডুবিয়েছেন। এমন এক ‘প্রশংসাবাণী’ মুখ থেকে উচ্চারণ করেছেন, তা জার্মান ফরোয়ার্ডের বাড়ির লোকজন শুনলেও হয়ত অবাক হবেন। ৬৯ মিনিটে পোডলস্কির গোলটি প্রসঙ্গে ইংলিশ গোলরক্ষক বলেন, ‘যৌনসংগমের মতো উজ্জ্বল শট।’ আসলে পোডলস্কিকে প্রশংসায় ভাসাতেই এমন তুলনা হার্টের। পোডোলস্কি তার বাঁ পায়ের জন্য বরাবর বিখ্যাত। শেষ ম্যাচেও বিখ্যাত সেই পা দিয়ে গোল করেছেন। ম্যাচ শেষে বলেছেন এটি ‘ঈশ্বরপ্রদত্ত’। গোল করার পর জো হার্ট আপনাকে কী বলেছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে পোডলস্কি জানিয়েছেন, ‘ও বলল এটা অসাধারণ শট ছিল- বিস্ময়কর।’ জার্মান কোচ জোয়াকিম লো’ও পোডলস্কির এমন বিদায়ে আপ্লুত, গোলটা পোলডির প্রতিরূপ। বিশেষ খেলোয়াড়দের এমন বিদায়ই প্রাপ্য। জার্মানির হয়ে দারুণ সফল পোডলস্কি কিন্তু জাতিতে জার্মান নন। তার জন্ম পোল্যান্ডে। কিন্তু সময়ের বিবর্তণে তিনি জার্মানির নাগরিকত্ব লাভ করেন। জার্মান বুন্দেসলিগায় এফসি কোলনের জার্সিতে উজ্জ্বল অভিষেক ঘটেছিল তার। তাতে শোরগোল পড়ে যায় পোল্যান্ডে। দেশটির মিডিয়া তরুণ পোডলস্কিকে জাতীয় দলে ডাকার জন্য তৎকালীন পোলিশ ফুটবল কোচ পাওয়েল জানাসকে তাগাদা দিতে থাকেন। বিরক্ত হন জানাস। তখন এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। ওই সংবাদ সম্মেলনেই বদলে গিয়েছিল পোডলস্কির ভাগ্য। পোলিশ থেকে জার্মান হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কি হয়েছিল ওই সংবাদ সম্মেলনে? গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০০৩ সালে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পোল্যান্ড ফুটবল কোচ পাওয়েল জানাস বলেছিলেন, ওর (পোডলস্কি) থেকে ঢের ভাল স্ট্রাইকার আমাদের দেশেই আছে। তাছাড়া দু-একটা ম্যাচ দেখে কাউকে জাতীয় দলে ডাকার পক্ষপাতী নই আমি। সে তো তার ক্লাবেই এখনও সেরা একাদশে জায়গা পায় না। এমন ঠোটকাটা কথা শোনার পরও পোল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করার কথা ভেবেছিলেন পোডলস্কি। কিন্তু সময় যত এগুতে থাকে জার্মান মিডিয়ায় গ্লিউইচ ফুটবল প্রতিভাকে নিয়ে মাতামাতি বাড়তে থাকে। তাতেই যেন মত বদলাতে থাকে ৬ ফুট লম্বা ফুটবলারের। এই অবস্থায় ২০০৪ সালে রুডি ভোলারের জার্মানি দলে ডাক পান পোডলস্কি। দ্বিতীয়বার ভাবেননি, সম্মতি জানিয়ে দেন। ৬ জুন ২০০৪ হাঙ্গেরির বিপক্ষে অভিষেকও হয় তার। নতুন বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি হয়। কেননা ১৯৭৫ সালের পর প্রথম দ্বিতীয় বিভাগের দলের ফুটবলার হিসেবে জাতীয় দলে অভিষেক হয় তার। ওই বছর কোলন দ্বিতীয় বিভাগে রেলিগেটেট হওয়াতে ওমন নজির গড়তে পেরেছিলেন ১৯ বছরের বাঁ পায়ের ফুটবলার। ১৯৮৫ সালে পোল্যান্ডের শিল্প শহর গ্লিউইচে জন্মগ্রহণ করেন পোডলস্কি। তার বাবা-মা দু’জনই পোলিশ। কিন্তু দুই বছর বাদে তারা পশ্চিম জার্মানিতে স্থানান্তরিত হন। ‘রাইট অব রিটার্ন’ নীতির সৌজন্যে জার্মানির নাগরিকত্ব পান পোডলস্কির পরিবার। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে তার বাপ-দাদারা হিটলারের জার্মানিতে বসবাস করতেন। সেক্ষেত্রে জন্ম বিবেচনায় পোডলস্কির সামনে দু-দেশের হয়েই প্রতিনিধত্ব করার সুযোগ ছিল। কোচের অবহেলায় শেষ পর্যন্ত তিনি বেছে নিয়েছিলেন পাওয়ার হাউস জার্মানি। ভুল যে করেননি সেটা তো প্রমাণিত।
×