ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শীর্ষ জঙ্গী মূসার স্ত্রী আত্মঘাতী স্কোয়াড সদস্য তৃশা মণির জবানবন্দী

জান্নাত পাওয়ার আশায় স্বামীর হাত ধরে জেএমবিতে যোগ দেই

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৪ মার্চ ২০১৭

জান্নাত পাওয়ার আশায় স্বামীর হাত ধরে জেএমবিতে যোগ দেই

গাফফার খান চৌধুরী ॥ হলি আর্টিজানে হামলার অনেক আগে থেকেই হামলার কথাটি জানা ছিল আমার। অথচ সাংগঠনিক কারণে তা বলতে মানা ছিল। সংগঠনের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে কি পেলাম? অভাবসহ নানা কারণেই এসএসসি পাসের আগেই বিয়ে হয়ে যায়। শিক্ষিত ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম। বিয়ের আগে বুঝতেই পারিনি, স্বামী নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। স্বপ্ন ছিল, স্বামীর মতো পড়াশোনা করে ভাল চাকরি করব। সুখী-সুন্দর জীবন হবে। তার কিছুই হলো না। স্বপ্ন এখন শুধুই অতীত। জঙ্গীবাদের ভয়াল কালো থাবায় সব তছনছ হয়ে গেলো। গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পর থেকেই স্বামী নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা মাইনুল ইসলাম মূসা ফেরার। স্বামীকে হন্যে হয়ে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা। স্বামীর হাত ধরে আত্মঘাতী নারী জঙ্গীর খাতায় নাম লেখাই। এখন কারাগারের অন্ধকার কক্ষে বন্দী। ভবিষ্যত অন্ধকার। জীবনে কোনদিন মুক্ত আলো-বাতাসে আসতে পারব কি-না জানি না। গত বছর ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার অস্ত্র সরবরাহকারী ও নানাভাবে সহযোগিতাকারী নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা মাইনুল ইসলাম মূসার স্ত্রী নব্য জেএমবির আত্মঘাতী নারী স্কোয়াডের সদস্য মোছাঃ তৃশা মনির (১৯) আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দীতে উঠে এসেছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। গ্রেফতারের একমাস পর গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তৃশা মনি ঢাকার সিএমএম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। জবানবন্দীতে তিনি বলেন, আমার প্রকৃত নাম তৃশা মনি। স্বামীর নাম মাইনুল ইসলাম। আমার বাড়ি রাজশাহী জেলার বাঘমারা থানাধীন সাঁইপাড়া গ্রামে। আমরা যমজ বোন। আমাদের একটি ছোট ভাই আছে। যমজ বোনের নাম নিশা মনি। আর ছোট ভাইয়ের নাম আব্দুল্লাহ আল নিশান (৬)। জন্ম রাজশাহীর বাঘমারাতেই। আমি ২০১৫ সালে সাঁইপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করি। এর আগেই ২০১৪ সালে মাইনুল ইসলাম মূসার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। আমার স্বামী রাজধানী ঢাকার উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে লাইফ স্কুলের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ২০১৫ সালে ইংরেজী বিভাগ থেকে মাস্টার্স পরীক্ষা দেন। তিনি রাজশাহীর বাগমারা মসমাইল স্কুল থেকে এসএসসি এবং রাজশাহীর তাহেরপুর ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। বিয়ের পর স্বামী আমাকে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর সড়কের একটি ভাড়া বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেখানে একমাস থাকি। এর পর উত্তরার ১৯ নম্বর সেক্টরের ১৯ নম্বর বাড়ির সপ্তম তলায় বাসা ভাড়া নেয়। সেখানে ৯/১০ মাস থাকি। আমার স্বামীর চাকরিস্থল লাইফ স্কুলে মেজর জাহিদের বড় মেয়ে পড়ত। মেজর জাহিদও ১৯ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ভাড়া থাকত। একই বাসাতেই ভাড়ায় বসবাস করা। স্বামীর স্কুলে মেজর জাহিদের মেয়ের পড়াশোনার কারণে স্বাভাবিকভাবেই তাদের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক হয়। আমার স্বামী ও মেজর জাহিদ একত্রে মসজিদে নামাজে যেত। সকালে একত্রে জগিং করত। মেজর জাহিদের সঙ্গে পরিচয়ের আগ থেকেই আমার স্বামী জেএমবির সঙ্গে জড়িত ছিল। মেজর জাহিদ আর আমার স্বামী একত্রে আরবী পড়ত। আরবী ভাষা শিখত। আমার স্বামীর সাংগঠনিক নাম আবু মূসা। তিনি জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। ২০১৫ সালের শেষদিকে আমার স্বামী আমাকে জেএমবিতে যোগ দিতে বলে। জেএমবিতে যোগ দিলে জান্নাত পাওয়া যাবে বলে জানায়। আমি তার কথায় বিশ্বাস করে জেএমবিতে যোগ দেই। ২০১৬ সালের ২৮ এপ্রিল হিজরতের জন্য (ধর্মের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া) উত্তরা বাসা ছেড়ে দিই। মিরপুর সাংবাদিক কলোনিতে বাসা নেই। সেখানে ২০১৬ সালের রোজার ঈদের পর ৪ দিন পর্যন্ত থাকি। এর পর মেজর জাহিদ (পল্লবীতে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত), তানভীর কাদেরী (আজিমপুরে পুলিশের অভিযানকালে গ্রেফতার এড়াতে আত্মহত্যাকারী) ও আমাদের পরিবার মিলে হিজরত আরম্ভ করি। আমরা মিরপুর সাংবাদিক কলোনির ১১ নম্বর সেক্টরে বসবাস শুরু করি। তানভীর কাদেরী মিরপুরের রূপনগরে (আফিফাদের বাড়িতে) বসবাস শুরু করে। আর মেজর জাহিদ কল্যাণপুরে বসবাস শুরু করে। আমাদের বাসায় রাহুল ওরফে বাসারুজ্জামান ও রাশেদ মাঝে মধ্যে যাতায়াত করত। মিরপুরের বাসায় ৩ মাস থাকার পর স্বামী আমাকে বলে, আমাদের সংগঠনের একটাই স্বপ্ন গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলা। হামলার কথাটি রাশেদও আমাকে বলেছিল। এর পর আমরা মনে করেছিলাম রাহুল পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। এজন্য রোজার ঈদের পরেই বাসা পরিবর্তন করে মিরপুরের পল্লবীতে চলে যাই। পল্লবী থানার পাশের ওই বাসায় একমাস পরেই আকাশ একজনকে নিয়ে আসে। এই একজনের সঙ্গে আরও দুজন আসে। এর ১৫ দিন পর সেলিম, ফিরোজ, আদরসহ (ভাল নাম আফিফ কাদেরী আদর আর সাংগঠনিক নাম নাবিল-আত্মহত্যা করা তানভীর কাদেরীর যমজ ছেলের একজন, মাইলস্টোন স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র ছিল) ৯/১০ জন আমাদের বাসায় আসে। তারা আমাদের বাসায় একমাস থাকে। পল্লবীর এই বাসায় আমরা প্রায় দুই মাস ছিলাম। এর পর আমাকে, নুরুল ইসলাম মারজান (পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত) ও রাহুলের স্ত্রীর জন্য আশকোনায় একটি বাসা ভাড়া করা হয়। আশকোনার বাসা ভাড়া করা হয় সংগঠনের তরফ থেকে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আশকোনার বাসায় উঠি আমরা। ইতোমধ্যেই নারায়ণগঞ্জে আমাদের সংগঠনের তিন জন (তামিম চৌধুরীসহ পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে) মারা যায়। এরপর আজিমপুরে তানভীর কাদেরীর বাসায় মারজানের স্ত্রী আফরিন ওরফে প্রিয়তি, মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা, নব্য জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা জামান ওরফে বাসারুজ্জামান ওরফে চকোলেটের স্ত্রী শায়লা আফরিন যায়। সংগঠনের নির্দেশে মেজর জাহিদ রাজধানীর রূপনগরে মালামাল আনতে যায়। সেখানে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। পুলিশের অভিযানকালে মেজর জাহিদ ৪ পুলিশকে আহত করেছিলেন বলে সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে শুনেছি। জাহিদ মারা যাওয়ার ২ দিন পর আমার স্বামী মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলাকে আমাদের আশকোনার বাসায় নিয়ে আসে। আশকোনার বাসায় প্রথমে আমি, এরপর শীলা ভাবি, এরপর সেলিম ও আফিফ কাদেরী আদর, ফিরোজ, আকাশসহ ১০ জন দুই ভাগে ভাগ হয়ে পল্লবী থেকে আশকোনার বাসায় আসে। আশকোনার বাসা থেকে তিন জন গাজীপুরে চলে যায়। সেখানে তারা পুলিশের অভিযানে মারা যায়। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত বছর অক্টোবরে গাজীপুরে পুলিশ ও র‌্যাব জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালায়। অভিযানে ১২ জঙ্গী নিহত হয়। নিহত জঙ্গীদের মধ্যে আশকোনা থেকে পলাতক তিন জঙ্গীও রয়েছে। এরমধ্যে আশকোনা থেকে পলাতক রাশেদ ও আকাশের নাম জানা গেছে। জবানবন্দীতে তৃশা মনি আশকোনার আস্তানায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের চালানো অপারেশন সম্পর্কেও জবানবন্দী দেন। তাতে তিনি বলেন, আশকোনার আস্তানায় আমি, সাকিনা, জেবুন্নাহার শীলা, আদর, ফিরোজ ও আমাদের তিন মহিলার তিন বাচ্চা ছিল। ২০১৬ সালের ২৩ নবেম্বর রাত আনুমানিক একটার দিকে পুলিশ দক্ষিণখান থানাধীন আশকোনা হাজীক্যাম্প সড়কের ৫০ নম্বর সূর্য ভিলা নামের বাড়ির দরজায় নক করে। আদর আমাকে দরজা খুলতে নিষেধ করে। আমি দরজার ফাঁক দিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলি। এরই মধ্যে আদর আমার স্বামীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে। তার কাছে কি করবে জানতে চায়। ওই সময় আমাদের ঘরে ৩টি পিস্তল, ৩টি সুইসাইডাল ভেস্ট, তার প্রত্যেকটিতে ৫টি করে গ্রেনেড ছাড়াও ছুরিসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ছিল। আদর নিজে এবং মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলার শরীরের গ্রেনেডসহ সুইসাইডাল ভেস্ট বেঁধে দেয়। আমি নিজেই গ্রেনেডসহ সুইসাইডাল ভেস্ট বেঁধে নিই। নির্দেশনা মোতাবেক গ্রেনেড বাঁধা ভেস্টসহ আমাদের পুলিশের মধ্যে গিয়ে পুলিশকে আমাদের গ্রেফতার করার কথা বলার কথা ছিল। আমি পুলিশকে বলি আমি বাঁচতে চাই। আমাকে ধরে নেন। কিন্তু পুলিশ তাতে রাজি হয় না। আমরা সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য বলে পুলিশ ধরে নেয়। তাই পুলিশ আমাদের পরনে থাকা গ্রেনেডের ভেস্ট খুলে আসতে বলে। সাকিনা ভাবি ড্রইংরুমে গিয়ে নিজেই গ্রেনেডসহ সুইসাইডাল ভেস্টগুলো বেঁধে পুলিশের কাছে যায়। পুলিশকে ভেস্টগুলো খুলে নিতে বলেন। পুলিশ নেয়নি। পুলিশ সুইসাইডাল ভেস্ট খুলে দিতে বলে ভাবিকে। এরই মধ্যে ফিরোজ রান্নাঘরের দেয়ালে থাকা গরম বাতাস বের করে দেয়ার ফ্যান খুলে পালিয়ে যায়। আমি ও শীলা ভাবি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করি। পরে শুনি সাকিনা ভাবি নিজের শরীরে বাঁধা গ্রেনেড নিজেই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। পুলিশ জানায়, গ্রেনেড বিস্ফোরণে সাকিরার মৃত্যু হয়। তার লাশটি বাড়িতে প্রবেশের নিচ তলার সামনের বারান্দায় পড়ে ছিল। আর আদর পুলিশের অভিযানকালে মারা যায়। আমার মেয়ে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ছিল। আমার স্বামী সুইসাইডাল ভেস্টগুলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে এনেছিল। আমার স্বামী আমাকে মালয়েশিয়া নিতে চেয়েছিল। বলেছিল, কিছুদিন দেখো। আমার স্বামীর পরিবারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ করা যাবে না। আমার স্বামীও করবে না। এটা আমার স্বামীর পরীক্ষা বলে আমাকে বলেছিল। অভিযানের এক পর্যায়ে আমি ও শীলা ভাবি সুইসাইডাল ভেস্টগুলো খুলে ড্রইং রুমে রাখি। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে আমরা দরজা খুলে বের হয়ে আত্মসমর্পণ করি।
×