ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঐতিহ্যের মসলিন ফিরে আসুক

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ২৪ মার্চ ২০১৭

ঐতিহ্যের মসলিন ফিরে আসুক

সম্পদশালী বাংলার নৈসর্গিক এবং বৈষয়িক প্রাচুর্যে বার বার আকৃষ্ট হয়েছেন যেমন দেশীয় কবি সাহিত্যিকরা একইভাবে প্রলুব্ধ হয়েছেন ভিনদেশী রাজন্যবর্গ, পরিব্রাজকরাও। আমরা জানি বাংলার তাঁত শিল্পের এক সময় বিশ্বজোড়া খ্যাতি এবং চাহিদা ছিল। যা দেশের প্রয়োজন মিটিয়েও বাইরে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হতো। আর এই তাঁত শিল্পের সবচেয়ে দামী এবং আকর্ষণীয় বস্ত্রই ছিল জগতজোড়া খ্যাত মসলিন। এমন সমৃদ্ধ বৈভব আজ বিলুপ্ত। সুদূর প্রাচীনকাল থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত এই মসলিনের অপরূপ বুনোনশৈলী সারা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিত। তবে এত উঁচুমানের বস্ত্রশিল্প কখনই সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছাতে পারেনি। রাজসিক এই মসলিন শিল্প রাজ রাজেশ্বর থেকে আরম্ভ করে পৃথিবীর ধনাঢ্য দেশগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। এরই অভিনব এবং চমকপ্রদ বর্ণনা পাওয়া যায় অবিভক্ত বাংলায় ভ্রমণ করা বিভিন্ন পরিব্রাজকের লেখায়। মসলিন বস্ত্র শিল্পের যে নির্মাণশৈলী তা যেমন শৈল্পিক একইভাবে মিহি সুতার এক অভিনব সূক্ষ্মতার মনোমুগ্ধকর হস্তশিল্পের অপরূপ নিদর্শন। ধারণা করা হয় মসলিম এক বিশেষ সুতার আঁশ থেকে তৈরি অতি ক্ষুদ্র চিকন লম্বাটে এক ধরনের উপাদান যাকে সংশ্লিষ্টরা চুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এমন সুতা তৈরি করা হতো যার ব্যাস এক ইঞ্চির এক হাজার ভাগের একভাগ হতো। সুতরাং সহজেই অনুমেয় এমন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আঁশ দ্বারা তৈরি মিহি সুতার নিপুণ হাতের শৈল্পিক কারুকার্য কত না চমকপ্রদভাবে অনুপম বস্ত্র শিল্পের মর্যাদা পেত। এই অপূর্ব কারুশিল্পের একজন সমঝদার ছিলেন মুঘল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান। তিনি এই শিল্পের উৎকর্ষতার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলেও প্রচলিত আছে। তিনি নিজেই সূচী শিল্পের একজন দক্ষ নির্মাতা। অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই মসলিন ব্যবহার হতো রাজদরবারে, রাজা বাদশাদের পোশাক হিসেবে। মুঘল আমলে মির্জা নাখান নামে এক সেনাপতির রচিত গ্রন্থে এই মসলিন নিয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। তিনি মালদহ থেকে চার হাজার টাকা মূল্যের একখ- মসলিন ক্রয় করেছিলেন। এত সূক্ষ্ম এবং মসৃণ কাপড় বুনতে তাঁতীদের দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হতো। তাই শুধু দামীই নয় অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ ছিল এই বহু মূল্যের সূক্ষ্ম কারুকার্য খঁচিত বস্ত্র। দৈর্ঘ্যে চার গজ এবং প্রস্থে এক গজ মসলিন সে যুগে পাওয়া যেত প্রায় ৪০০ টাকায়। পঞ্চাশ থেকে ষাট গজ দৈর্ঘ্যে এবং দুই গজ প্রস্থের মসলিনের পাড়ে সোনা, রূপা এবং সিল্কের জরির কাজ শোভা পেত। আর তা রফতানি হতো পারস্য, তুরস্ক এবং খোরাসানে। চতুর্দশ শতকে পর্যটক ইবনে বতুতা সোনারগাঁওয়ে অবস্থানকালে তাঁত শিল্পীদের নিখুঁত হাতে তৈরি করা মসলিনের মিহি সুতার বস্ত্র দেখতে পান। ষোলো শতকে পর্তুগীজ ভ্রমণকারী বারবোসা এই কারুকার্য খচিত বস্ত্র শিল্পের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এই কাপড় এতই সূক্ষ্ম ছিল যাকে স্বচ্ছ কাঁচের সঙ্গেও তুলনা করা হতো। যা বাঁশের মধ্যে পুরে বিদেশে রফতানি হতো। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বাংলার এই ঐতিহ্য তাঁতশিল্প তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারাতে বসে। মারাত্মক ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রাচীন বাংলায় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সমস্ত মূল্যবান পণ্যের ওপর ব্রিটিশ শাসকরা এত বেশি কর ৭০ থেকে ৮০% আরোপ করতে থাকে যা দেশীয় সমস্ত পণ্যকে সর্বনাশের মুখে ঠেলে দেয়। আর মসলিন একেবারেই বিলুপ্তির পথে চলে যায়। যদিও মসলিনের একটি রূপ জামদানি আজও তার গৌরব আর মর্যাদা নিয়ে দেশে-বিদেশে সবার প্রত্যাশা মিটিয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশ রাজশক্তি শুধু বর্ধিত কর আরোপ করেই ক্ষান্ত হয়নি এ শিল্পে নিয়োজিত তাঁতীদেরও বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে দেয়। সেই হারানো তাঁত শিল্পের ঐতিহ্যকে আবারও নতুন উদ্যামে ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা দেয়ারও আশ্বাস প্রদান করা হয়। হারিয়ে যাওয়া এমন উন্নতমানের বস্ত্রশিল্প যা এক সময় অভিজাত এবং ধনাঢ্য শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত তা আজ নতুন প্রকল্পে সর্বসাধারণের হাতে পৌঁছে দেয়াও সময়ের দাবি।
×