ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শ্রাবণী আক্তার সান

বারবার ফিরে আসুক এমন স্মরণীয় মুহূর্ত!

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২২ মার্চ ২০১৭

বারবার ফিরে আসুক এমন স্মরণীয় মুহূর্ত!

নিজেদের শততম টেস্টে এক স্মরণীয় জয় ছিনিয়ে আনল বাংলাদেশ। গড়ল নতুন ইতিহাস। যাদের বিপক্ষে টেস্টে জয়হীন ছিল, সেই শ্রীলঙ্কার মাটিতে তাদেরই হারাল মুশফিক-বাহিনী। অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তান এই তিন দেশ কেবল জয়ের মুখ দেখেছে শততম টেস্টে। ইতিহাসে চতুর্থ জয়ী হিসেবে মুশফিকরা নিজেদের নামটি নতুন করে লিখল। কলম্বোর পি সারা ওভালে শততম টেস্টে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কাকে ৪ উইকেটে হারায় টাইগাররা। শ্রীলঙ্কার দেয়া ১৯১ রানের টার্গেট শেষ দিনে খুব সহজে না হলেও ঠিকই জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ। অধিনায়ক মুশফিক ৪৫ বলে অপরাজিত ২২ রানে দক্ষ নাবিকের মতো দলকে জয়ের বন্দরে নোঙর করিয়েছেন। তরুণ মেহেদী হাসান মিরাজ (২) জয়সূচক রান তুলে মুশফিকের সঙ্গে উৎসব করতে করতে ফিরেছেন। দশম দেশ হিসেবে শততম টেস্ট খেলল টাইগাররা। এর আগে নিজেদের ১০০তম টেস্টে জয় তুলে নিতে পেরেছে ৩টি দল। অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তান। ইতিহাসের মাত্র চতুর্থ দল হিসেবে নিজেদের ১০০তম টেস্ট জিতে এলিট ক্লাবে তো ঢুকবেই পড়ল টাইগাররা, সেই সঙ্গে মর্যাদার আরও বড় কয়েকটি দলকে ফেলল পেছনে। পঞ্চম ও শেষ দিনের শুরুতে দুই লঙ্কান অপরাজিত ব্যাটসম্যান ভুগিয়েছেন। কিন্তু তারপরও শ্রীলঙ্কাকে অলআউট করা গেল ৩১৯ রানে। ১৯০ রানের লিড স্বাগতিকদের। আড়াই সেশনের বেশি বাকি তখনও। প্রথম ইনিংসে লঙ্কানদের ৩৩৮ রানের জবাবে সাকিবের সেঞ্চুরিতে ৪৬৭ রান করেছিল বাংলাদেশ। গোটা ম্যাচে দারুণ দাপট বাংলাদেশের। ব্যাটে-বলে। আর ১৯১ রানের টার্গেট শেষ দিনে পূরণ করতে গিয়ে নার্ভাসনেস তো পেয়ে বসেছিল। ২২ রানে হারাতে হয় ২ উইকেট। তামিম ইকবাল ৮২ রানের ঝকঝকে ইনিংস খেলে বীরের কাজ করেছেন। যদিও আউটটা দৃষ্টিকটু। সাব্বির রহমানের (৪১) তৃতীয় উইকেটে ১০৭ রানের জুটি গড়েছেন তামিম। বাংলাদেশকে জয়ের পথ থেকে সরে যেতে দেয়নি ওই জুটি। তবু শঙ্কার মেঘ তবু ওড়াউড়ি করছিল। ৪ উইকেটে ১৫৬ রানে চা বিরতিতে বাংলাদেশ। আর ৩৫ রান করলেই লঙ্কাপতিদের গুঁড়িয়ে ঐতিহাসিক জয়! কিন্তু বিরতি থেকে ফিরেই এই ম্যাচের আসল নায়ক সাকিব আল হাসান (১৫) আউট। কিন্তু তখনও দিনের খেলা কত বাকি! বাংলাদেশের দরকারি রান ও বাকি ওভার প্রায় সমান! এই অবস্থায় অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম কি আর ভুল করতে পারেন? সেনসেশনাল মোসাদ্দেক হোসেন (১৩) জয় থেকে ২ রান দূরে থাকতে ফিরেছেন। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে তার জুটিটা ২৫ রানের। এই শ্রীলঙ্কাই কিছুদিন আগে দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়াকে হোয়াইটওয়াশ করেছিল তিন টেস্টের সিরিজে। প্রথম টেস্টে বাংলাদেশকে হারিয়েছিল ২৫৯ রানের বড় ব্যবধানে। কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টের একাদশে ৪টি পরিবর্তন নিয়ে নামা টাইগাররা যেন ভিন্ন এক দল! নিউজিল্যান্ডে জয়ের শেষ চাপ রক্ষা করতে পারেনি। হেরেছে শেষ দিনে। কিন্তু এবার শেষ দিনে জয়ের সুযোগটাকে আরও কাছে এনে সেটিকে অর্জন করেই উৎসবে মাঠ ছেড়েছে বাংলাদেশ। এরআগে বাংলাদেশ ৮ টেস্টে জিতেছিল। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে পাঁচটি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুটি ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটি টেস্ট জিতেছিল বাংলাদেশ। এরমধ্যে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে একটি ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুটি টেস্টে জয় মিলেছিল তাদেরই দেশে। কিন্তু জিম্বাবুইয়ে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোন দলই এত আহামরি ছিল না। শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কাকে প্রথমবারের মতো হারিয়ে নবম টেস্ট জয়টি তুলে নিল বাংলাদেশ। সেটি আবার বাংলাদেশের শততম টেস্টেই জয় মিলল। অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর শততম টেস্টে চতুর্থ দল হিসেবে জিতল বাংলাদেশ। এরআগে ১৯১২ সালে ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নিজেদের শততম ম্যাচটিতে জয় পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ১৯৬৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শততম টেস্টটিতে জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৯৭৯ সালে মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শততম টেস্ট ম্যাচ জিতেছিল পাকিস্তান। নিজেদের শততম টেস্টে জিতল বাংলাদেশ। ইতিহাস গড়ল। ২০০০ সালে স্ট্যাটাস পাওয়ার সতেরতম বছরে এসে টাইগারদের নবম জয় এটি। পরিসংখ্যান মোটেই গর্ব করার মতো নয়। তবে এই সাফল্যের মহিমা অনেক। কারণ বিদেশের মটিতে এই প্রথম শক্তিধর কোন দেশকে হারাল বাংলাদেশ। ভিনদেশে আগের জয়গুলো ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুইয়েতে, যখন দুটি দলই বেশ দুর্বল ও খর্বশক্তির। এবার উপমহাদেশীয় ক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তি লঙ্কানদের বিপক্ষে তাদেরই মাটিতে দাপুটে জয়ে অনন্য গৌরবের সঙ্গী হলেন মুশফিকুর রহীম, সাকিব-আল হাসান, তামিম ইকবালরা। বাংলাদেশ অবশ্য প্রথম টেস্ট ম্যাচ জিতেছিল নিজেদের মাঠে, ২০০৫ সালে চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে, জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে। ঐতিহাসিক শততম এই টেস্টে টাইগারদের জয়ের নায়ক তামিম। দ্বিতীয় ইনিংসে মূল্যবান ৮২ রানের দারুণ এক ইনিংস উপহার দেন। প্রথম ইনিংসে ৪৯ রান করে অল্পের জন্য হাতছাড়া করেন অর্ধশতক। দ্বিতীয় ইনিংসে নিজেকে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রমাণ দেখান। একেবারে নিখুঁত একটি ইনিংস খেলেন তিনি। যদিও অন্যপ্রান্তে বাকি ব্যাটসম্যানরা তাকে সেভাবে সঙ্গ দিতে পারছিলেন না। আরপি. সারা ওভালে পঞ্চমদিনের উইকেট স্পিনারদের জন্য স্বর্গ হয়ে ওঠে। শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞ স্পিনার রঙ্গনা হেরাথ তো ছিলেনই বড় হুমকি হিসেবে। সেটা পঞ্চমদিনে ১৯১ রানের জয়ের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে হাড়েহাড়ে টের পেয়ে যায় বাংলাদেশ। দলীয় ২২ রানের মধ্যে সাজঘরে ফিরে যান সৌম্য সরকার ও ইমরুল কায়েস। তৃতীয় উইকেটে সাব্বির রহমনাকে নিয়ে ১০৯ রানের জুটি গড়ে মূলত তামিমই দলকে চাপমুক্ত করে দেন। যার ওপর দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ঐতিহাসিক জয়। আর সিরিজসেরা হন তারকা অলরাউন্ডার সাকিব-আল হাসান। গলের প্রথম টেস্টে ব্যাট হাতে দুই ইনিংস মিলিয়ে ৩১ রান (২৩ ও ৮) করেন। বল হাতে নেন তিন উইকেট (১ ও ২ উইকেট)। দলও হারে ২৫৯ রানের বড় ব্যবধানে। কিন্তু কলম্বো টেস্টে এমন সুবাতাস ছড়ান যে দল জয়ই পেয়ে যায়। প্রথম ইনিংসে তিনি যে ১১৬ রানের অসাধারণ ইনিংসটি খেলেন, সেই ইনিংসে শুরুতেই এগিয়ে থাকে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ইনিংসে যদিও ১৫ রানের বেশি করতে পারেননি। তবে বল হাতে প্রথম ইনিংসে ২ উইকেট নেয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ৪ উইকেট শিকার করেন। তাতেই শ্রীলঙ্কা হারের খপ্পরে পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ৪ উইকেটে জিতেও যায়। শততম টেস্টে জয় তুলে নেয়। সেই সঙ্গে প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কোন সিরিজে ১-১ ড্র করে সিরিজও শেষ করে। প্রথম ইনিংসে যখন সেঞ্চুরি করেন, তখনই এ বছর ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রান করার কৃতিত্ব গড়ে ফেলেন। বছর এখনও শেষ হতে অনেকদিন বাকি। আপাতত যে কয়টা মাস গেছে, তাতে সাকিব সবার ওপরে। ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রান করেছেন সাকিব। অস্ট্রেলিয়ার স্টিভেন স্মিথ কিংবা ভারতের বিরাট কোহলিরা কিংবা কেন উইলিয়ামসন, ডেভিড ওয়ার্নাররাও সাকিবের ধারে কাছে নেই। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত সাকিব ৫ টেস্টের ১০ ইনিংস খেলেছেন। তাতে একটি ডাবল সেঞ্চুরিসহ দুটি সেঞ্চুরি ও ২টি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৫৫.০০ গড়ে ৫৫০ রান করেছেন। যেটি এ বছর এখন পর্যন্ত সেরার স্থানে আছে। বল হাতেও সাকিব অনন্য। বিশ্বের সেরা বাঁহাতি স্পিনারদের কাতারে চলে এসেছেন সাকিব। সর্বকালের সেরা পাঁচ বাঁহাতি স্পিনারদের কাতারে এখন সাকিবের নাম রয়েছে। সাকিবের উইকেট শিকার সংখ্যা এখন ১৭৬। তাতেই পাঁচ নম্বরে অবস্থান করছেন সাকিব। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলম্বো টেস্টের চতুর্থদিনে বাংলাদেশকে ভোগানো সেঞ্চুরিয়ান করুনারতেœর উইকেটটি নিতেই সেই তালিকায় নাম লেখান সাকিব। টেস্ট ইতিহাসের বাঁহাতি স্পিনারদের রেকর্ড পাতায় তার সামনে আছেন কেবল চারজন স্পিনার। শ্রীলঙ্কার রঙ্গনা হেরাথ (৩৭২ উইকেট), নিউজিল্যান্ডের ডেনিয়েল ভেট্টরি (৩৬২ উইকেট), ইংল্যান্ডের ড্যারেক আন্ডার উড (২৯৭ উইকেট), ভারতের বিষেন সিং বেদী (২৬৬ উইকেট) আছেন। সাকিব পাঁচ নম্বরে রয়েছেন। টেস্টে দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেয়া সাকিব একের পর এক রেকর্ড গড়েই চলেছেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজেই দেশের হয়ে ব্যাটসম্যানদের মধ্যে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ২১৭ রানের রেকর্ডটি গড়েছেন। দেশের শততম টেস্টে এসে এমনভাবেই জ্বললেন দলও জিতে গেল। সাকিব তাই বলেও দিলেন, ‘শ্রীলঙ্কায় টেস্ট জেতা দারুণ অনুভূতি। নিজেদের শততম টেস্টে জয় পেয়েছি। এ জয়ের চেয়ে তাই ভাল কিছু আর হয় না।’ সঙ্গে টাইগার ক্রিকটের বড় তারকা আরও যোগ করেন, ‘যেভাবে আমরা দিন দিন উন্নতি করছি তাতে সামনে আমরা আরও ম্যাচ জিতব। দেশের মাটিতে আমরা ভাল সময় কাটাচ্ছি। হোম সিরিজের পাশাপাশি দেশের বাইরেও আমাদের আরও ভাল খেলতে হবে।’
×