ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব পানি দিবস বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২২ মার্চ ২০১৭

বিশ্ব পানি দিবস  বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

আমরা পানিকে একটি অফুরান সম্পদ হিসেবেই দেখি, কিন্তু এটা কি সত্যিই অফুরান। আমাদের চারপাশে স্বাদু পানির উৎস যেমন নদ-নদী, ঝরনা, পুকুর, হ্রদ ছাড়াও ভূগর্ভস্থ পানি রয়েছে। এই পানির উৎসসমূহ কোনটাই অসীম বা সবসময় পাওয়া যায় তা নয়। উপরন্তু বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানির উৎস সীমিত। আমরা নদ-নদী ও জলাশয় থেকে বা মাটিতে নলকূপ খনন করলেই পানি পাই। এই পানির কোনটারই সরাসরি উৎস আমরা নই। আর আমাদের যা উৎস যেমন বুড়িগঙ্গা, হালদা নদীর জলাধার এর পানি আমরা উত্তোলন করছি এর অববাহিকায় কৃষি, সেচ, গৃহস্থালিসহ নিত্যদিনের সকল কাজে। বিনিময়ে নদীকে দিচ্ছি নগরীর তরল বর্জ্য, কৃষিজ বর্জ্য, রাবারড্যাম, বাঁধ ইত্যাদি যা নদীর সর্বনাশ ত্বরান্বিত করছে। আমাদের যা কিছু অতিরিক্ত তা সহজ ব্যবস্থাপনার জায়গা হলো নদী বা জলাশয়। এ কারণেই যখনই কোন ফরমালিনযুক্ত মাছ, ফল ধরা পড়ে, নষ্ট-কিংবা কীটনাশকযুক্ত খাদ্য পাওয়া যায় তা নদীতেই সরাসরি ফেলা হয়। কিন্তু আমরা কখনও ভাবি না নদী বা জলাশয়ের পানির কি হবে অথবা এই রাসায়নিকগুলোর শেষ গন্তব্য কোথায়। এখন বুড়িগঙ্গা মৃত, হালদা মৃতপ্রায়। হালদা মৃতপ্রায় বলার কারণ এর নতুন প্রাণ লালনের ক্ষমতা কমে যাওয়া। বিষাক্ত রাসায়নিককে এর ক্ষুদ্র কণায় ভাগ করে, এর স্বাভাবিক পানীয় গুণাগুণ বজায় রাখার ক্ষমতা হলো একটি নদী বা জলাধার এর প্রাণ, এটা ফুরিয়ে গেলে কোন জীবকে ধারণ ও লালন করার ক্ষমতা থাকে না। এর পরিণতি ভয়াবহ। আমার ইউরোপের রাইন নদীর কথা মনে পড়ে, কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যরে কারণে ত্রিশের দশকে এই নদী এতটা বিষাক্ত হয়েছিল যে এর অববাহিকার সব কারখানা বন্ধ করার বিশ বছর পরেও এই নদীতে মাছ পাওয়া যেত না। রাইন নদীকে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার যে বিশাল প্রচেষ্টা জার্মানিসহ এ অন্য দেশগুলো করেছে তা অভাবনীয়। তারই ফলশ্রুতিতে রাইন নদীতে মাছ ফিরে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তাও দীর্ঘ অর্ধশতক পর! হালদা এর অবস্থা কতটা সঙ্গিন আমরা কিছুটা বুঝেছি মোহরা পানি সরবরাহ প্রকল্পের কারণে। তবু চট্টগ্রামের পানি সরবরাহ এই নদীর ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল, এ কারণে এর উজানে নতুন করে মদুনাঘাট পানি সরবরাহ প্রকল্প স্থাপন করা হচ্ছে কারণ আমাদের হাতে আর কোন বিকল্প নেই। ভূগর্ভস্থ অগভীর স্তরের পানি আর্সেনিক দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিবিধ কারণে পানির প্রাপ্যতা মারাত্মকভাবে সীমিত হয়েছে। আশার কথা হলো অগভীর স্তরের পানিতে আর্সেনিক দূষণ থাকলেও এই দূষণ গভীর স্তরে নেই। আমাদের ভূগর্ভস্থ জলাধারগুলো এক স্তরে সীমাবদ্ধ না থাকায় অগভীর স্তর পেরিয়ে গভীর স্তরে আর্সেনিক এখনও পৌঁছেনি তবে পৌঁছাবে না এমনটি নয়। কিন্তু এই পানির উৎস কোথায়। অবশ্যই আমাদের বৃষ্টির পানি, নদী বা জলাশয়ের পানি। তবে এই পানির পুনঃস্থাপন অঞ্চল ক্ষুদ্র জায়গায় সীমাবদ্ধ। তাই গভীর স্তরের পানি অসীম নয়। যদিও নির্দিষ্ট করে এর আকার বা পরিমাণ বিচার করার আগেই আমরা আরও গভীর নলকূপ খনন চালিয়ে যাচ্ছি। আমার প্রায় দেখি আমাদের পাম্প পানি দিচ্ছে না যদিও পাম্প কোম্পানিগুলো পানির নিশ্চয়তা দিয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই ভূগর্ভস্থ স্তরের পানি ফুরিয়ে গেলে বা তার পুনঃউৎপাদন ক্ষমতার বেশি উত্তোলন করলে এর পানি ধারণ ক্ষমতা কমবে, সঙ্গে ভূমিধসের মতো বিপদও হতে পারে (!) তাছাড়া পানির অতিরিক্ত উত্তোলন ভূগর্ভে দূষিত রাসায়নিকের প্রবাহ বাড়বে। তাই পানির বাজেট নিয়ে ভাবার সঙ্গে সঙ্গে আর ভাবতে হবে মানসম্মত পানির পরিমাণ এবং এই উৎসসমূহ কতটা নিরাপদ। এবারের পানি দিবসের প্রতিপাদ্য দ্বৈত অর্থবোধক হলেও কিন্তু সার্বিক অর্থে কোন বিতর্ক নেই। কারণ পানির ব্যবহার বা অপচয় যাই করি না কেন, আমরা যদি ব্যবহৃত পানিকে পুনরায় ব্যবহারের জন্য তৈরি করতে না পারি তবে এই পানি আমাদের প্রাত্যহিক পানির চক্র থেকে হারিয়ে যায়। এই হারানো পানি পুনরায় ফিরে আসার সম্ভাবনা শত বছর থেকে লাখ বছরও হতে পারে। তাই উন্নত দেশসমূহ ৭০-৮০ ভাগ বর্জ্য পানি পুনরায় ব্যবহার করে সেক্ষেত্রে আমরা করি ১০ ভাগ বা তারও কম। আমাদের এই সীমাবদ্ধতা যতটা না আর্থিক এর চেয়ে বেশি মানসিক। পানি এমন এক তরল যা প্রায় সকল মৌলিক ধাতু ও অনেক জৈবযৌগকেও দ্রবীভূত করতে পারে। একই কারণে পানি এতটা দূষণ প্রবণও বটে। তাই যখন পানির দূষণ ঘটে তার সার্বিক প্রভাব পরিবেশের অন্য সকল উপাদান এর ওপর পড়ে। এই জন্য পানির বর্জ্য, পানি থেকে আলাদা করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পানি হারানোর সঙ্গে পানিতে দ্রবীভূত ধাতব উপাদানও কিন্তু আমাদের ব্যবহারের চক্র থেকে হারিয়ে যায়। অথচ পানির পরিপূর্ণ বিশোধন করার মাধ্যমে আমরা পানি এবং এর দ্রবীভূত মৌলসমূহ আমাদের ব্যবহারে ফিরিয়ে আনতে পারি। কিন্তু আমরা তা করছি না কেন বা কতটুকুই করছি? আশাব্যঞ্জক হলো নতুন যে কোন কলকারখানা স্থাপনের সময় আমরা এখন তরল বর্জ্য বিশোধন প্লান্ট বসানো এবং তার ব্যবহার নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। যদিও এই তরল বর্জ্য বিশোধন প্লান্টের ব্যবহারে সফলতা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা পরিবেশ ও প্রতিবেশ নিয়ে অনেক বেশি সচেতন। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন যে তরল বর্জ্য তার গন্তব্য কোথাই? আমাদের নগর ব্যবস্থাপনায় তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ? আমাদের সকল বর্জ্যরে গন্তব্য আমাদের পাশের নালা তারপর জলাশয়, খাল, ছড়া, নদী এরপর সাগর। আমরা প্রতিদিন মাথাপিছু ৯০-১৫০ লিঃ তরলবর্জ্য তৈরি করি। এই তরলবর্জ্য মৌলিক ধাতুগুলোর সঙ্গে সঙ্গে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়ামসহ অন্য যৌগসমূহের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে। এই পানি আমরা পানের উপযোগী বিশুদ্ধকরণ করতে পারি। তাছাড়া সেচ কাজে ব্যবহার করে আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহারের ৭০ ভাগ পানি কমাতে পারি তাতে পরোক্ষভাবে জমিতে সারের ব্যবহারও কমবে। পানিকে তার বৈশিষ্ট্য ফিরিয়ে দিয়ে তার উৎসে ফেরাতে হবে। তার জন্য একটি আধুনিক নগরের দরকারÑ ১. পানির উৎস ব্যবস্থাপনা ও উৎসসমূহের থেকে উত্তোলনযোগ্য পানির পরিমাণ নিরূপণ। ২. পানির পুনঃব্যবহার ও বিশোধন নিশ্চিত করা, বৃষ্টির পানি ধারণ, ব্যবহার ও বিশোধনপূর্বক ভূগর্ভে প্রতিস্থাপন করা ৩. ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন কর প্রবর্তন করা ৪. বর্জ্য পানি নিঃসরণের ওপর কর আরোপ এবং বর্জ্য পানি এর মান এর সঙ্গে পরিমাণকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে অন্তর্ভুক্ত করা ৫. দ্বিচক্র বিশিষ্ট পানি সরবরাহ লাইন রাখা, যাতে পুনরুৎপাদিত পানি আলাদা লাইন এ সরবরাহ করে গাড়ি পরিষ্কার, বাগান করা, রাস্তা পরিষ্কার, ফোয়ারা, সেচ ও অন্যান্য কাজে এই পানি ব্যবহার করতে পারে। তবে পুনরুৎপাদিত পানির ক্ষেত্রে পানির যথাযথ গুণাগুণ বজাই রাখা জরুরী যাতে এর ব্যবহারকালে কৃষক বা প্রান্তিক ব্যবহারকারীর স্বাস্থ্য দূষণঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকে। বর্জ্যপানির শোধনের অর্থায়ন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ থেকে আলাদাভাবে চিন্তা করার সুযোগ নেই, উপরন্তু তা নগর অবকাঠামো উন্নয়ন অর্থায়নের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জের মতো নদীকেন্দ্রিক শহরে বর্জ্য পানি ব্যবস্থাপনা নদী অববাহিকা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে করা যেতে পারে। তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা জন্য প্রয়োজন বিশাল অঙ্কের মূলধন যেমন, চট্টগ্রামের মতো একটি শহরের জন্য দরকার হাজার কোটি টাকার চেয়ে বেশি। যেহেতু বর্জ্য নিঃসরণ ফি বর্জ্যপানির বিশোধন প্লান্টের মূলধন যোগান দেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই সরকারকেই এই ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্যপানির পরিমাণ ও বর্জ্য পানিতে দূষণের মাত্রা বৈশ্বিকভাবেই বেড়েছে। তদুপরি বর্জ্যপানি ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে উপেক্ষিত। তাই আমরা এর গন্তব্য নির্দিষ্ট করেছি আমাদের পরিষ্কার পানির উৎসসমূহে। ফলে আমাদের বর্জ্য পানির পরিমাণই শুধু বাড়ায়নি, কমেছে আমাদের পানির উৎসও। বর্জ্যপানি মূল্যহীন ভেবেছি কারণ, আমার এটিকে পানির উৎস হিসেবে, শক্তি, গাছের পুষ্টি উপাদানের বা অন্য সকল উপাদান যা পুনরুদ্ধার সম্ভব এর উৎস বিবেচনা করছি না। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার স্বর্ণখনির তরলবর্জ্য বিশোধন প্লান্ট জিপসাম সরবরাহ করছে, তেমনি লবণাক্ততা শোধন করার প্লান্ট হতে পারে লবণের উৎস। তাই সময়ের ও ভবিষ্যতের প্রয়োজনে আমাদের বর্জ্য পানি শোধন ও পুনঃব্যবহার করতে হবে। লেখক : সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×