ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কামরুল আলম খান খসরু

স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলো

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২২ মার্চ ২০১৭

স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলো

(গতকালের পর) আর সে বছরই রাজ্জাক ভাই অর্থাৎ আবদুর রাজ্জাক (স্বাধীনতা ও সশস্ত্র যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, নিউক্লিয়াস ও বিএলএফ নেতা, স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে গঠিত ‘মুজিব বাহিনীর’ অন্যতম সংগঠক এবং ‘মুজিব বাহিনীর’ মধ্যাঞ্চলীয় কমান্ডের অর্থাৎ গৌহাটি কেন্দ্রিক সেক্টর কমান্ডার, পরবর্তীকালে যিনি আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রী ছিলেন ১৯৯৬-২০০১-এর মেয়াদকালীন সময়ে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হয়ে কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে গিয়েছিলেন। সেখানে আমরা এক সঙ্গেই যাই। তাছাড়াও বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আন্ডারগ্রাউন্ডেও আমরা একসঙ্গে কাজ করতাম। যা হোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। জগন্নাথ হল ছিল সংখ্যালঘু ছাত্রদের আবাসিক হল। তাই সে হলে পুলিশ সচরাচর রেড দিত না। সে হলের ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যরা ছিল সংখ্যাগুরু আর ছাত্রলীগের সদস্যরা সংখ্যালঘু। আমি ছিলাম তখন পাকিস্তানীদের কাছে এক নম্বর শত্রু। আমাকে একেক দিন একেক হলের ছাত্রাবাস কক্ষে রাত কাটাতে হতো। রাতের বেলা আমি জরুরী সব কাজগুলো সম্পন্ন করতাম আর দিনের বেলা ঘুমাতাম। মৃণালের সঙ্গে রাত কাটানোর সময় সে আমাকে বিপ্লবীদের জীবনী শোনাত। আমি প্রায়ই রাত জেগে মৃণালের কাছ থেকে শুনতাম নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, মাস্টার দা সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী, যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে বাঘা যতীন, ভগৎ সিংহ, রামপ্রসাদ বিসমিল, চন্দ্রশেখর আজাদ, আসফাকউল্লা খান, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, চে গুয়েভারা প্রমুখ বিপ্লবীদের জীবনী। সেসব কাহিনী শুনে আমি অনুপ্রাণিত হতাম। মনে মনে ভাবতাম আমিও তো সে পথেই হাঁটছি। আরও একটি কারণে আমি জগন্নাথ হলে যেতে পছন্দ করতাম, তা হলো জগন্নাথ হলের ডাইনিংয়ের খাবার। সেকালে জগন্নাথ হলের ডাইনিংয়ের খাবার ছিল খুবই সুস্বাদু ও মুখরোচক। মৃণালের কাছে গেলে ও খুশি মনে আমাকে ডাইনিং-এ নিয়ে খাওয়াত। এভাবে জগন্নাথ হলে আসা যাওয়া করতে গিয়েই ভারত থেকে অস্ত্র সংগ্রহের পরিকল্পনা আমার মাথায় আসে। তখন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তীব্র নকশাল আন্দোলন চলছিলো। ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর তাড়া খেয়ে কিংবা সেখানে কোন অপারেশন করে কিছু নকশাল কর্মী গ্রেফতার এড়ানোর জন্য বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিত। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার তারা ভারতে ফিরে যেত। নকশাল আন্দোলনের কিছু মধ্যম শ্রেণীর নেতা মাঝে মধ্যে আমাদের দেশে এসে জগন্নাথ হলে আশ্রয় নিত। পাকিস্তানের প্রশাসন এসব জেনেও না জানার ভান করে থাকত। পাকিস্তানীরা নকশালীদের সাহায্যও করত না, আবার বিরক্তও করত না। কারণ ভারত তাঁদের চোখে শত্রু রাষ্ট্র। আবার তাঁরা নকশাল আন্দোলনকেও সমর্থন করত না। তাই তাঁরা মৌন ভূমিকা পালন করত। আমি এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে আমাদের অস্ত্রভা-ার সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করি। ‘নিউক্লিয়াস’ নেতাদের টার্গেট ছিল দীর্ঘমেয়াদী গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করা। সে লক্ষ্যেই আমরা প্রথম দিকে নানা সূত্র থেকে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা অব্যাহত রাখি। একাত্তরে আমাদের সশস্ত্র আন্দোলনের সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে ভারত জড়িয়ে গেলে আমরা মাত্র নয় (৯) মাসে বিজয় লাভ করি। তা না হলে দেশ স্বাধীন হতে কত বছর সময় লাগত তা কে জানে! কারণ সে সময় পাকিস্তানের সঙ্গে বিশ্বের তাবত বড় বড় শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর মিত্রতা ছিল। তাঁরা তাঁদের স্বার্থেই পাকিস্তানকে কখনও ভাঙতে দিত না। যাক সে কথা। ভারতে গিয়ে নকশালীদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহের বিষয়টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে আশ্রিত এক নকশাল নেতার মাধ্যমে ঠিক করি। অসমের শিলং (বর্তমানে শিলং মেঘালয়ের রাজধানী)-এ বসবাসকৃত এ নকশালী নেতার নাম ‘শুভজিৎ’। সে অসমের শিলংয়ের চা বাগানে চাকরি করত। তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা নিশ্চিত করে ‘নিউক্লিয়াস’-এর নেতাদের কাছে বিষয়টির অবতারণা করি। তাঁরা পুরো বিষয়টি আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর ছেড়ে দেন। কারণ ব্যাপারটি ছিল খুবই স্পর্শকাতর এবং ঝুঁকিপূর্ণ। ভারতে আসা-যাওয়ার পথের বাঁকে বাঁকে রয়েছে মৃত্যুর ঝুঁকি এবং ধরা পড়ার সম্ভাবনা। আর ধরা পড়লে সবার হবে জেল জরিমানা তথা রাজনৈতিকভাবে একযুগ পিছিয়ে যাওয়া। আমি কিন্তু নাছোড়বান্দা! এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ দুঃসাহসিক কাজই যে আমার ভাল লাগে। মৃত্যুর ঝুঁকি নেয়াই আমার স্বভাবে পরিণত হয়েছে। তাই আমি ভারতে যাওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেই। অর্থের জন্য বন্ধু-বান্ধবের কাছে ধরনা দেই। শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম, ছাত্রলীগের বিশিষ্ট নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু (বর্তমানে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী), ‘নিউক্লিয়াস’-এর কয়েকজন নেতা এবং বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জের ব্যবসায়ী আমার ছোটবেলার বন্ধু আলিম হাজী এ কাজের জন্য অর্থ দিয়ে আমাকে সাহায্য করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আলিম হাজী ছিলেন পাকিস্তানের ঘোর বিরোধী এবং বঙ্গবন্ধুর অন্ধ ভক্ত। তিনি একজন ভাল কুস্তিগীরও ছিলেন। তিনি আমাদের নানাভাবে সাহায্য করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার একদিন আগে অর্থাৎ ১৫ ডিসেম্বর রাতে স্থানীয় রাজাকাররা তাঁকে, তাঁর ভাই আরিফ এবং তাঁর অপর ছোট ভাইকে (মোট ৩ ভাই) আমার কথা বলে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়। তারপর তাঁদের একটি নৌকায় চড়িয়ে, সে নৌকাটি বুড়িগঙ্গা নদীর মাঝখানে নিয়ে গিয়ে প্রথমে নৃশংসভাবে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এবং পরে অমানবিক ও পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে একসঙ্গে তিন ভাইকে গুলি করে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়। পরেরদিন জানতে পেরে আমি তাঁদের লাশ দেখতে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি, পেট ফুঁড়ে সমস্ত নাড়িভুঁড়ি বের হওয়া লাশ নদীতে ভাসছে। ঠিক সে মুহূর্তে আমার মনে হলো আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) পানির ট্যাঙ্কির ভেতর ১১ ঘণ্টা লুকিয়েছিলাম (যেহেতু তখন আমি ওয়ান্টেড ছিলাম), তখন আমাকেও পাকিস্তানী মিলিটারিরা থ্রি নট থ্রি রাইফেলের বেয়োনেটের আগা দিয়ে খুঁচিয়েছিল। কিন্তু পানির গভীরতা ভেদ করে সে খোঁচা আমার শরীরকে স্পর্শ করতে পারেনি। ভাগ্যিস সেদিন আমি বেঁচে গিয়েছিলাম। নইলে আমারও হয়ত আমার বন্ধুর মতো পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে এমন পরিস্থিতি হতো। হয়ত আমার লাশও ট্যাঙ্কির পানির মধ্যে ভাসত। নদীতে ভাসমান লাশগুলো দেখে মুহূর্তের মধ্যে আমার মনে অনেক করুণ স্মৃতির উদয় হলো। আমি তাঁদের লাশ দাফনের জন্য মৃতদের আত্মীয়স্বজনের কাছে অনুরোধ করি। আত্মীয়রা তাঁদের বাড়ির আঙ্গিনায় লাশগুলোকে দাফন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এ রকম নাম জানা-অজানা কত মানুষ যে প্রাণ দিয়েছেন, তার কোন হিসাব নেই। দিন তারিখ ঠিক করে আমি পথে নেমে পড়ি। আমার সফরসঙ্গী হয় ছাত্রলীগ ও নিউক্লিয়াস কর্মী নিমু। যদিও ইতিপূর্বে আমি দু’বার ভারত গিয়েছি। প্রথমবার গিয়েছি স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ নেয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৬৯ সালে। সে সময় ভারত যাই হবিগঞ্জ বর্ডার দিয়ে। সেবার হবিগঞ্জ বর্ডার পর্যন্ত আমাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ বলে খ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল আলম খান, ছাত্রলীগ নেতা ও নিউক্লিয়াসের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসানুল হক ইনু (বর্তমানে তথ্যমন্ত্রী) এবং ছাত্রলীগ ও নিউক্লিয়াস কর্মী নিমু। আর দ্বিতীয়বার ভারত যাই অস্ত্র সংগ্রহের সম্ভাবনা দেখতে। দ্বিতীয়বার আমার সঙ্গে ছিল মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল হক জিয়া (টাক জিয়া) এবং ইকবাল। অবশ্য তাঁরা আমাকে কলকাতায় একা রেখে পালিয়ে আসে। কলকাতায় পৌঁছে একস্থানে বিশ্রাম করার সময় আমি আমার ব্যাগে রাখা রিভালভার, বেয়োনেট ও ডেগারগুলো খুলে রাখছিলাম। তখন সে দৃশ্য দেখে তাঁরা হয়ত ভয় পায় এবং সুযোগ মতো রাতে পালিয়ে দেশে চলে আসে। আসলে সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না। সে যাত্রায় আমি মাত্র একটি অস্ত্র সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম। সেবার ভারত গিয়েছিলাম যশোর বর্ডার দিয়ে আর ফিরে এসেছিলাম সাতক্ষীরা বর্ডার দিয়ে। নিমুকে নিয়ে একদিন আমি ভারতে রওনা হই। এবার দুর্গম পথে ভারত যাওয়ার পরিকল্পনা করি। কারণ আমি ছিলাম পাকিস্তানীদের কাছে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’। ধরা পড়লে একদম রক্ষা নেই। তাই প্রতিটি পদক্ষেপ আমাকে খুব ভেবেচিন্তে ফেলতে হয়েছে। যাতে ধরা পড়ে না যাই। তখন গোপীবাগ, মানিকনগর এবং ধলপুরের পেছন দিক দিয়ে একটি খাল ছিল, যা শীতলক্ষ্যা নদীতে গিয়ে মিলেছে। একদিন রাতে নৌকায় চড়ে সে খাল দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে আসি। তারপর নদী পার হয়ে ডেমরা চলে আসি। ডেমরা থেকে বাসে চেপে চলে আসি নরসিংদী। নরসিংদী এসে আমি আর নিমু আখাউড়া জংশনে নেমে পড়ি। তারপর সিলেটগামী লোকাল ট্রেনে চেপে বসি। এসব লোকাল ট্রেন সাধারণত স্টেশনে স্টেশনে থেমে থেমে যায়। ট্রেনে চলার সময় আমি বিশেষ কৌশল অবলম্বন করি। স্টেশনে ট্রেন থামার আগেই আমি প্ল্যাটফর্মের উল্টো দিকে নেমে ট্রেনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতাম। টিটি আর টিকটিকি (পাকিস্তানের চর) কম্পার্টমেন্টে উঠে ঘুরে গেলে, তারপর আবার আমি ট্রেনের ভেতরে প্রবেশ করতাম। কখনও কখনও ট্রেনের ছাদে উঠে শুয়ে সময় কাটাতাম। কারণ দীর্ঘ পথ। আর এভাবে বারবার ট্রেন থেকে নেমে পালিয়ে থাকতে দেখে প্যাসেঞ্জাররা সন্দেহ করতে শুরু করেছিল। বাস টার্মিনাল, ট্রেন স্টেশন, নৌবন্দর সর্বত্রই পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের তীক্ষè দৃষ্টি। তাঁরা আমাকে ধরার জন্য সারাদেশে জাল বিছিয়ে রেখেছে। চলবে...
×