ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রাম অঞ্চল জুড়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু জঙ্গী ঘাঁটি ॥ চলছে অভিযান

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২১ মার্চ ২০১৭

চট্টগ্রাম অঞ্চল জুড়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু জঙ্গী ঘাঁটি ॥ চলছে অভিযান

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ নবরূপে জঙ্গী সন্ত্রাসের শক্তিশালী তৎপরতার বহুমুখী তথ্য মিলেছে। চট্টগ্রাম অঞ্চল ঘিরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য ঘাঁটির সঙ্গে অবস্থান নিয়েছে জঙ্গী গোষ্ঠীর সদস্যরা। প্রতিটি আস্তানায় অস্ত্র, গ্রেনেড, বোমা, বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জামসহ সুনির্দিষ্টভাবে সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য সম্পৃক্ত। এসব তথ্য মিলেছে সীতাকু-ের একটি জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার জঙ্গী দম্পতির কাছ থেকে। এসব তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণের পর সোমবার বিকেলে মহানগরীর পৃথক দুটি বহুতল ভবনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সমন্বিত অভিযান শুরু করে। বিকেল ৪টা নাগাদ ভবন দুটি ঘিরে ফেলে। সন্ধ্যা ৬টায় অভিযান শেষ হয়। কিন্তু সন্দেহজনক ভবন দুটির কোনটি থেকেই কোন জঙ্গী এবং কোন অস্ত্রশস্ত্র বা বিস্ফোরকদ্রব্য মেলেনি। উল্লেখ্য, সীতাকু-ের সাধন কুঠির থেকে গ্রেফতার জঙ্গী দম্পতি জহিরুল ও আরজিনাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের পর প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মহানগরীর আকবরশাহ থানা এলাকার ৫শ’ গজের ব্যবধানে এ দুটি সন্দেহজনক আস্তানার ভবনে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, সোয়াত, সিআইডি, ডিবি, জেলা ও নগর পুলিশের তিন শতাধিক সদস্যের সমন্বিত অভিযান পরিচালিত হয়। ওই জঙ্গী দম্পতি তথ্য দিয়েছে নব্য জেএমবি সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্যরা নিয়মিত আনাগোনা করত। এ ধরনের তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশের সমন্বিত অভিযান চলে সোমবার বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। ধারণা করা হচ্ছে, সীতাকু-ের দুটি আস্তানায় পুলিশী অভিযানের পর এরা সটকে পড়েছে। আকবরশাহ এলাকার ভবনটির নাম ‘মম নিবাস’। আর উত্তর কাট্টলীর ভবনটি শ্রী সাহা নামের এক ব্যক্তি মালিকানার। ৪ তলাবিশিষ্ট ভবনটির বাসিন্দার সবাই হিন্দু সম্প্রদায়ের বলে পুলিশ জানিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা নিশ্চিতভাবে ধারণা করছে, জঙ্গী সন্ত্রাস চালাতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ঘাঁটি গড়ে তুলেছে নব্য জেএমবি। এদের মূল টার্গেট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। তার মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছে পুলিশ। সীতাকু-ের দুটি আস্তানার পর সোমবার চট্টগ্রাম মহানগরীতে নতুন দুটি জঙ্গী ঘাঁটি সন্দেহে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত অভিযানের ঘটনা সাধারণ মানুষের মাঝে নতুন করে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। উল্লেখ্য, গত বুধবার সীতাকু-ের আমিরাবাদে সাধন কুঠির থেকে গ্রেফতার জঙ্গী দম্পতিকে জিজ্ঞাসাবাদের পর বেরিয়ে এসেছে বহু তথ্য। এসব তথ্য নিয়ে সোমবার সকালে সিএমপি সদর দফতরে রেঞ্জ ডিআইজি, পুলিশ সুপার, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, সোয়াত, সিআইডি, ডিবি ও এসবির সমন্বিত বৈঠক হয়। এর পর বিকেল ৪টার দিকে নগরীর আকবরশাহ থানা এলাকাধীন দুটি পৃথক বহুতল ভবন ঘিরে ফেলা হয় এবং এতে অভিযান পরিচালিত হয়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার তিন শতাধিক সশস্ত্র সদস্য অংশ নেয়। রেঞ্জ ও জেলা পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে, সীতাকু-ের সাধন কুঠির থেকে জঙ্গী দম্পতি জসিম ও আরজিনার প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ দুটি ভবনে প্রথম অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই জঙ্গী দম্পতি জানিয়েছে, তাদের সঙ্গে থাকা দুই জঙ্গী নেতা দুটি ভবনে সব সময় আনাগোনা করত। কাট্টলীর ভবনটি শ্রী সাহা নামের একজনের মালিকানায়। অপরটির মালিকানা তাৎক্ষণিক জানা যায়নি। সেটিকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এখনও অভিযান পরিচালিত হয়নি। সন্ধ্যা ৬টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মহানগরীর নতুন দুটি আস্তানা ভবনের ফ্ল্যাট বাসিন্দার প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রতিটি কক্ষে তল্লাশি চালানো হয়। কিন্তু কোন জঙ্গী বা অস্ত্রশস্ত্রের সন্ধান মেলেনি। অপরদিকে, জঙ্গী দম্পতি রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, দিনাজপুর থেকে আগত নব্য জেএমবির এক নেতা বান্দরবানের বাইশারীতে অবস্থান নেয়। তারা এ নেতার নাম বলেছে, তবে পুলিশ অভিযানের স্বার্থে তার নাম প্রকাশ করেনি। ওই নেতা নব্য জেএমবির সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য এবং মুছা নামের আরেকজন চট্টগ্রাম অঞ্চলে সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করছে। দুজনই এখনও অধরা। কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্রে জানানো হয়েছে, সার্বিক রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলার চট্টগ্রামের সীতাকু- পৌর এলাকার প্রেমতলার সেই আস্তানাটিতে নিহত জঙ্গী দম্পতির মরদেহ শনাক্ত করেছেন পরিবারের সদস্যরা। এ লাশ তারা নেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। নিহত জঙ্গী কামালের পিতা বলেছেন, এই আমারই সন্তান। তার দিকে ফিরেও চাইব না। এ লাশ আমরা নেব না। এদিকে, সীতাকু-ের সেই আস্তানায় সোমবার তল্লাশি শেষ করেছে পুলিশ, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও গোয়েন্দা সংস্থা। সর্বশেষ সেখান থেকে উদ্ধার হয়েছে একটি শক্তিশালী বড় গ্রেনেড ও ১১টি জেল বোমা। সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে এসে নিহত জঙ্গী কামাল উদ্দিন ও তার স্ত্রী জোবায়দার লাশ শনাক্ত করেন কামালের বাবা মোজাফফর আহমেদ এবং জোবায়দার বাবা নুরুল আলম। সঙ্গে ছিলেন জোবায়দার ভাই জিয়াবুল হক। তাদের বাড়ি বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নে। দুটি মরদেহ দেখে তাদের শনাক্ত করতে অসুবিধা হয়নি। তারা জানান, এ লাশ আমরা নেব না। ছেলে এত বড় ঘটনা ঘটাতে পারে তা কল্পনাও করিনি। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে মোজাফফর ও নুরুল আলম জানান, প্রায় ৯ মাস আগে কামাল ও জোবায়দা বাড়ি ছেড়ে যায়। এর পর থেকে তাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ হয়নি। তারাও পরিবারের খোঁজখবর রাখেনি। কামালের বাবা মোজাফফর জানান, এলাকার মানুষের মুখে শুনেছি, পত্র-পত্রিকায় এবং সংবাদ মাধ্যমেও জেনেছি। এর পর এসে দেখলাম, লাশটি আমারই সন্তানের। কিন্তু এ দেহ গ্রহণ করতে তারা রাজি নন বলে জানিয়ে দেন। হাসপাতাল মর্গে থাকা মেয়ে জোবায়দার লাশ দেখতে যাননি পিতা নুরুল আলম। তার পুত্র জিয়াবুল মর্গে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, এ ঘটনা তাদের পরিবারে সকলকে প্রশ্নের মধ্যে ফেলেছে। পরিবার এ দায় নেবে না। এদিকে, সোমবার দুপুরে সীতাকু-ের প্রেমতলার ছায়ানীড় ভবনের নিচতলার ফ্ল্যাটের জঙ্গী আস্তানায় অভিযান শেষ হয়েছে। জেলা পুলিশ, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট এবং সিএমপির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ টিমের তল্লাশিতে সর্বশেষ উদ্ধার হয়েছে একটি বড় গ্রেনেড, ১১টি জেল বোমা এবং বিস্ফোরক ও বোমা তৈরির উপাদান। এ বাড়িতেই অভিযানকালে আত্মঘাতী গ্রেনেড বিস্ফোরণ ও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল জঙ্গী দম্পতি কামাল ও জোবায়দা এবং এক শিশুসহ ৫ জন। গত ১৬ মার্চ বৃহস্পতিবার ছায়ানীড়ের এই জঙ্গী আস্তানায় অভিযান পরিচালিত হয়। আগের দিন বুধবার সীতাকু- পৌর এলাকার আমিরাবাদের ‘সাধন কুঠিরে’ বাড়ির মালিকের বুদ্ধিমত্তায় ধরা পড়ে জঙ্গী দম্পতি জহিরুল ও আরজিনা। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে সন্ধান মিলে প্রেমতলার আস্তানাটির। সীতাকু-ের সাধন কুঠির থেকে গ্রেফতার দম্পতিকে দুটি মামলায় ১২ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে জঙ্গীদের আরও আস্তানার তথ্য। এরই ভিত্তিতে সোমবার চট্টগ্রাম নগরীর আকবরশাহ থানার ১ নম্বর চউকের আবাসিক এলাকা ও উত্তর কাট্টলীর দুটি ভবন ঘেরাও করে তল্লাশি চালানো হয়। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের রিক্রুট ॥ পুলিশ ও গোয়েন্দাদের সূত্রে ধারণা করা হচ্ছে, জঙ্গী সংগঠনগুলো রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার তৎপরতায় লিপ্ত। বহু আগে থেকে কক্সবাজারজুড়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের তৎপরতা রয়েছে। এছাড়া মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরএসওসহ (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন) কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠনের কর্মকা- বিস্তৃত রয়েছে। গত বছর অক্টোবর থেকে মিয়ানমারে নতুন করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর ৯০ হাজার রোহিঙ্গা নর-নারী বাংলাদেশে অবস্থান নিয়েছে। এরা চট্টগ্রামসহ বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। কক্সবাজারের উখিয়া, রামু ও টেকনাফের শরণার্থী এবং টাল (বস্তি) গুলোতে যে পরিমাণ রোহিঙ্গা রয়েছে এর বহুগুণ বেশি রয়েছে বাইরে। এদের একটি অংশ বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িসহ অরণ্যের বিভিন্নস্থানে অস্থায়ী বাড়িঘর করে থাকছে। সীতাকু-ের সাধন কুঠির থেকে গ্রেফতার জসিম ও আরজিনা নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারী থেকে চট্টগ্রামে এসে জঙ্গী সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়েছিল। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তাদের মতো অনেকে এ ধরনের কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েছে। আরজিনা মূলত রোহিঙ্গা নারী। আর্থিক লোভ ছাড়াও স্বামীর সঙ্গে সে জঙ্গী তৎপরতায় লিপ্ত বলে স্বীকার করেছে। দিনাজপুর থেকে যে জঙ্গী নেতা কক্সবাজার, নাইক্ষ্যংছড়ি ও চট্টগ্রামে আনাগোনা করে থাকে; তাকে সে চিনে। সে তার নামও জানিয়েছে। কিন্তু নামটি তার প্রকৃত না ছদ্ম, তা নিশ্চিত নয়। চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলার পটিয়া, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, বাঁশখালী, ফটিকছড়িতেও নব্য জেএমবির সক্রিয় সদস্যদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আস্তানা রয়েছে বলে পুলিশ বিভিন্ন সূত্রে ধারণা পাচ্ছে। এ নিয়ে সমন্বিত অভিযান চালাতে পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। পুলিশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিগন্যাল অনুযায়ী জঙ্গী বিরোধী অভিযান পরিচালিত হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে বলে চট্টগ্রাম রেঞ্জ, জেলা ও মহানগর পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে।
×