ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জলি রহমান

সোনালি আঁশের সুদিনে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৯ মার্চ ২০১৭

সোনালি আঁশের সুদিনে বাংলাদেশ

বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে পাটের ভূমিকা অনেক। প্রাচীনকাল থেকেই পাটের ব্যবহার হয়ে আসছে। এক সময় পাটকে বলা হত সোনালী আশঁ। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাট ও পাটজাত পন্যের অবস্থান ছিল প্রথমে। প্রাচীনকালে আফ্রিকা ও এশিয়া অঞ্চলের লোকজন দড়ি ও বুননতন্ত্র হিসেবে পাটের ব্যবহার করত। উনিশ শতকের শেষের দিকে ফ্রান্স, আমেরিকা, ইটালি, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, বেলজিয়াম ও জার্মানিতে পাটকল স্থাপিত হয়। সম্ভাবনাময় এই শিল্পের বিকাশ ঘটে খুবই দ্রুত। ১৯৫১ সালে বাংলাদেশে স্থাপিত হয় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ আদমজী জুট মিল ঢাকার নারায়ণগঞ্জ জেলায়। স্বাধীনতার পর এই মিলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮২টিতে। কিন্তু ২০০৩ সালে বন্ধ হয়ে যায় আদমজী জুট মিলস। ফলে শত কোটি টাকা লোকসান হয়েছিল সরকারের। অসংখ্য লোক হয়েছিল কর্মহীন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত ও পারদর্শিতায় পাট শিল্পে আবার আশার আলো উন্মোচিত হয়। এবারই প্রথম ৬ মার্চ পালিত হয়েছে জাতীয় পাট দিবস। তাছাড়া ‘সোনালি আঁশের সোনার দেশ পাট পণ্যের বাংলাদেশ’ এই স্লোগান নিয়ে পাঁচ দিন (৯-১৩ মার্চ) ব্যাপী পাট শিল্পমেলা নানা আয়োজনের মাধ্যমে শেষ হয়েছে। পাটের বহুমুখী ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি)’ এ মেলার আয়োজন করেছিল। মেলায় পাট পণ্যের স্টল ছিল ৬১টি। কথা হয়েছিল মেলায় অংশ নেয়া কিছু উদ্যোক্তার সঙ্গে। যারা শুনিয়েছিল পাট নিয়ে তাদের সাফল্য ও আশার কথা। নাম মজিবুর রহমান চৌধুরী ‘নকশি বাংলা ইকোটেক্স’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বাড়ি নরসিংদী। ২০০৭ সালে মাত্র তিন লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন পাট শিল্পে। বর্তমান বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২ কোটি টাকা। নরসিংদী ‘নকশি বাংলা ইকোটেক্স’ ফ্যাক্টরিতে পাট থেকে তৈরি হয় সুতা এবং ফেব্রিক্স। বাংলাদেশের সর্বত্রই সরবরাহ করছেন পাটের বহুমুখী পণ্য ও ফেব্রিক্স। উদ্যোক্তা মজিবুর রহমানের বহুমুখী পাটপণ্য ও ফেব্রিক্স দেশের অভ্যন্তরে টিএস জুট হ্যান্ডিক্রাফট, ক্রিয়েটিভ কালেকশন, ব্যাগ বাজার, রেনু হেন্ডিক্রাফট, ভাই ভাই জুট, গ্রীন হস্তশিল্প ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করছেন। তার বহুমুখী পাটপণ্য শুধু দেশে নয় ব্যক্তি উদ্যোগে রফতানি করা হচ্ছে বিদেশেও। সরকারের আর্থিক সহায়তার চেয়ে মার্কেটিংয়ের সুবিধা বেশি প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। এবং যারা আন্তর্জাতিক মানের পণ্য উৎপাদন করছে তাদের পণ্য বহুমুখী বাজারজাত করার লক্ষ্যে বিদেশে উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণের সুব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়েছেন। বিগত সালে কিছু উদ্যোক্তাদের পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তারা আর ফিরে আসেনি। ফলে বর্তমানে অনেক বড় বড় উদ্যেক্তারা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। খুলনার শাকেরা বানু একজন সফল ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। জেডিপিসি থেকে ট্রেনিং নিয়ে মাত্র এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। বর্তমানে তার বিনিয়োগের পরিমাণ ১০ লাখ টাকা। বহুমুখী পাটপণ্য তৈরি করে আজ তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা। তার মাধ্যমে তৈরি হয়েছে আরও অনেক উদ্যোক্তা। তার অধীনে কাজ করে প্রায় ৩০ জন কর্মচারী জীবিকা নির্বাহ করছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রয়োজন স্বল্পসুদে ঋণ। তিনি বলেছেন, ‘প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার মতো শত শত উদ্যোক্তা রয়েছে। যাদের তৈরি পণ্য শুধু এলাকায় বিক্রি করা হয়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী এই পণ্য বিক্রয়ের বাজার আরও সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। তবে আশার খবর হলো এই মেলার মাধ্যমে জেডিপিসি এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় থেকে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষি ফান্ড থেকে দুই শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। আবার কৃষি খাতে বৈদ্যুতিক যেসব সুবিধা দেয়া হচ্ছে পাট শিল্পেও যথাপযুক্ত প্রযুক্তির ব্যবস্থা করা হবে। সরকার ২০১০ সালে পাটের মোড়ক আইন প্রণয়ন করেছেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে এই আইন কার্যকর করা হয়। বর্তমানে মোট ১৭টি পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহার করা হচ্ছে। বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে পাটের ইতিহাস জড়িত। বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন ও এর ব্যবহার বৃদ্ধির সহায়তাকল্পে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০০২ সালে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ খাতের ওপর নির্ভরশীল।’ দেশীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টির সঙ্গে মানানসই পাট ও পাটজাত পণ্য দেশে যেমন গুরুত্বের দাবিদার, তেমনি বিশ্ব বাজারেও এটি এখন অনন্য পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে সমাদৃত। ইউরোপ ও আমেরিকায় এসব পণ্যের কাপড় বা ফেব্রিক্স প্রতি মিটার ৬ থেকে ৭ ডলার দামে বিক্রি করা হয়। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, জেডিপিসি এরইমধ্যে ১৩৫টি ডিজাইনের বহুমুখী পাটপণ্য উদ্ভাবন করেছে। ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হয় বহুমূখী পাটপণ্য। তাছাড়া সুইজারল্যান্ডসহ কিছু দেশে রফতানির প্রক্রিয়া চলছে। বিভিন্ন বৈচিত্র্যকৃত পাটজাত পণ্য রফতানিতে ২০ শতাংশ নগদ আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে সরকার। বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কাঁচাপাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানিতে আয় হয়েছিল ৯১ কোটি ৯৫ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। চলতি (২০১৬-১৭) অর্থবছরে এই খাতের রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৬ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। পাট শিল্প উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ও নামমাত্র সুদে ঋণ দেয়ার পাশাপাশি তাদের উৎপাদিত পণ্য রফতানির সুব্যবস্থা করলে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে পরিবেশবান্ধব এই পণ্যের বাজার। ফলে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন যেমন সহজ হবে। তেমনি বাড়বে কর্মসংস্থানও।
×