ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ আলী

বেগম জিয়ার একটি মারাত্মক আপত্তিকর বক্তব্য

প্রকাশিত: ০৫:০১, ১৯ মার্চ ২০১৭

বেগম জিয়ার একটি মারাত্মক আপত্তিকর বক্তব্য

এখন থেকে প্রায় এক বছর পূর্বে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া একটি মারাত্মক আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে যারা শহীদ ও নির্যাতিত হয়েছিলেন তাদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বেগম জিয়ার বক্তব্যের কয়েকদিন পর বিএনপির আরেক নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ও একই ধরনের আপত্তিকর বক্তব্য রাখেন। আমরা জানি, ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছিলেন এবং ২ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। এই সংখ্যাটি এখন শুধু আমাদের ইতিহাসের অংশই নয়, আমাদের চেতনার গভীরে প্রোথিত একটি বেদনাদায়ক সত্য। বিষয়টি এতটাই স্পর্শকাতর এবং বিতর্কের উর্ধে যে, এ বিষয় নিয়ে কেউ প্রশ্ন করে না বা বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করে না। বিশেষ করে দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল কোন বাঙালী এ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। বন্তুত এ ধরনের স্পর্শকাতর এবং ইতিহাসের স্বীকৃত সত্য নিয়ে সভ্য জগতের কোথাও কেউ প্রশ্ন তোলে না, যদি না তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে এবং ভাড়াটিয়া লেখক হিসেবে কাজ করেন, যেমন করেছেন সুভাষ বসু/শরৎ বসু পরিবারের কলঙ্ক শর্মিলা বসু। এ ধরনের বক্তব্য রাখা বা বিতর্ক সৃষ্টি করা শহীদদের আত্মার প্রতি অশ্রদ্ধাজ্ঞাপন ও ইতিহাসকে বিকৃত করার শামিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ও যুদ্ধকালীন সময়ে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ৬০ লাখ ইহুদী নিহত হয়েছিলেন। নারী-বৃদ্ধ-বয়স্ক-শিশু নির্বিশেষে মানুষকে গুলি করে এবং গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ঐড়ষড়পধঁংঃ নামে পরিচিত এই ঘটনা ইতিহাসের একটি অত্যন্ত জঘন্য, হৃদয়বিদারক ও নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশেও পাকিস্তানীরা এ ধরনের একটি নিষ্ঠুর হত্যাকা- সংঘটিত এবং মানবসভ্যতাকে কলঙ্কিত করে। ইউরোপের এই ঐড়ষড়পধঁংঃ-এ ৬০ লাখ মানুষ নিহত হয়। এই সংখ্যাটি নিয়ে সভ্যজগতে কেউ প্রশ্ন তোলে না বা বিতর্ক সৃষ্টি করে না। বস্তুত এ বিষয়ে যদি কেউ বিতর্ক সৃষ্টি করে তাহলে সমস্ত বিশ্বে তুমুল প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় বয়ে যাবে। শহীদদের এই সংখ্যা একটি ংধপৎড়ংধহপঃ বিষয়। অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় যে, বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের একটি ংধপৎড়ংধহপঃ বিষয়ে আপত্তিকর বক্তব্য রাখলেন। তিনি ইতিহাসের স্বীকৃত সত্যকে সম্মান দেখালেন না। শহীদদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন এবং জানি না তিনি বুঝতে পেরেছেন কিনা যে, এ কাজটি করে তিনি শহীদদের স্মৃতির প্রতি অশ্রদ্ধাই প্রকাশ করলেন। তিনি যে একটি অত্যন্ত গর্হিত ও নিন্দনীয় কাজ করেছেন এবং চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি অত্যন্ত হতাশ ও ব্যথিত বোধ করছি যে, বেগম জিয়ার এ ধরনের নিন্দনীয় কাজের যে ধরনের প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি। বেগম জিয়াকে এ গর্হিত কাজের জন্য ভর্ৎসনা করা দূরের কথা অনেকে টুঁ শব্দটিও করলেন না। যাদের উচিত ছিল জোরালো প্রতিবাদ জানানো তারা এ ধরনের বক্তব্যের বিষয়ে নীরব বা নির্লিপ্ত থাকলেন, যা মোটেও বাঞ্ছনীয় নয়। সমাজের প্রতিটি মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিকদের পক্ষ থেকে কঠোর নিন্দাবাদ ও তীব্র প্রতিক্রিয়া জানানো প্রয়োজন ছিল। অন্যথায় পাকিস্তানপন্থী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যক্তিরা খালেদা জিয়ার মতোই ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দেয়ার সাহস পাবে। কিছু প্রতিবাদ হয়েছে, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু তা মোটেও যথেষ্ট নয়। আরও ব্যাপক ও জোরালো প্রতিবাদ হওয়া উচিত ছিল। কোথায় অব্যাহত প্রতিবাদ ও নিন্দাজ্ঞাপন দেখতে পাব, অথচ ইতোমধ্যে বিষয়টি স্তিমিত হয়ে পড়েছে এবং বেগম জিয়াও সহজেই ছাড় পেয়ে গেলেন, যা মোটেও কাম্য ছিল না। বেগম জিয়ার শিক্ষাগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতা আছে তা আমরা বুঝি; কিন্তু এক্ষেত্রে বিএনপির শিক্ষিত পরামর্শদাতাদের একটা ভূমিকা ছিল, যা তারা পালন করেননি। বেগম জিয়াকে বোঝানো উচিত ছিল যে, তিনি যে কাজটি করেছেন তা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং সমাজের কোন সচেতন নাগরিকের পক্ষে, বিশেষ করে তিনি যদি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হন, এ ধরনের বক্তব্য খুবই অনাকাক্সিক্ষত। আমি মনে করি এ বিষয়ে আমাদের নিশ্চুপ থাকা উচিত নয়। দেশের সর্বত্র প্রতিবাদ ও নিন্দাজ্ঞাপন অব্যাহত রাখা প্রয়োজন যে পর্যন্ত না বেগম জিয়া ও গয়েশ্বর রায় তাদের বক্তব্য প্রত্যাহার এবং জাতির কাছে তাদের এই গর্হিত কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এই প্রতিবাদ ও নিন্দাজ্ঞাপনের দায়িত্বটি শুধু ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বা গণজাগরণ মঞ্চের ওপর ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিককে গর্জে উঠতে হবে, যাতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের পবিত্র স্মৃতির প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতি কেউ অশ্রদ্ধা প্রকাশের ধৃষ্টতা না দেখায়। এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ হয়ত বলতে পারেন যে, ইতিহাস নিয়ে তো গবেষণা হবেই। কিন্তু না, সব বিষয় নিয়ে গবেষণা হয় না। কিছু বিষয় গবেষণা বা বিতর্ক বা সন্দেহের উর্ধে। ঐড়ষড়পধঁংঃ-এ ৬০ লাখ ইহুদীর মৃত্যু, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালীর মৃত্যু, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানিÑ এমনি কিছু বিষয়। বিষয়গুলো ংধপৎড়ংধহপঃ, এ বিষয়গুলোকে বিনম্র চিত্তে, মাথানত করে মেনে নিতে হয়, শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হয়। ইউরোপে ঐড়ষড়পধঁংঃ উবহরধষ অপঃ আছে, সেখানে কেউ নিহতদের সংখ্যাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে না। আমাদের দেশেও অবিলম্বে এবহড়পরফব উবহরধষ অপঃ জারি করতে হবে এবং সেই আইনটি ১৯৭১ সাল থেকে ৎবঃৎড়ংঢ়বপঃরাব বভভবপঃ সহ বাস্তবায়ন করতে হবে। এই আইনের আওতায় অবশ্যই বেগম খালেদা জিয়া ও গয়েশ্বর রায়ের মতো যারা অপরাধ করেছেন বা করবেন, তাদের বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। খালেদা জিয়ার বক্তব্যের কারণে কয়েকটি মামলাও হয়েছে। সেগুলোকে গুরুত্বসহকারে ঢ়ঁৎংঁব করতে হবে, যাতে বাদীর আগ্রহের অভাবে বা মামলা জটের কারণে মামলাগুলো চাপা পড়ে না যায়। রায়হান ফারুকী নামে এক তরুণ খালেদা জিয়ার বক্তব্যে মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে নড়াইলের আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। সম্প্রতি এই মামলায় আদালত কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। এমনি আরও যত মামলা হয়েছে সবগুলোকে সচল করতে হবে। শুধু আইনের মাধ্যমে নয়, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সাংগঠনিক সব ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমে বেগম জিয়ার বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ও বলিষ্ঠ প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে হবে। আমি আশা করছি, বিলম্বে হলেও দেশের বড় বড় নেতা, রাজনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী তথা সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক সচেতন নাগরিকদের পক্ষ থেকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জোরালো প্রতিবাদ আসবে। এ প্রসঙ্গে তরুণ সমাজের ভূমিকা ও কর্তব্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমাদের ইতিহাসের, আমাদের জাতির প্রতিটি প্রয়োজনের মুহূর্তে তারাই সবচেয়ে সাহসী ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে এবং সফলকাম হয়েছে। আমার এই বিশ্বাস আছে, তারাই পারবে বেগম জিয়াকে তার বক্তব্য প্রত্যাহার ও জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করতে। পরিশেষে আমি আবারও বলব, বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সকল অপচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দিতে হবে এবং যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করতে, আমাদের শহীদদের সংখ্যাকে বিতর্কিত করতে চায় এবং শহীদদের পবিত্র স্মৃতির প্রতি সামান্যতম অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের ধৃষ্টতা দেখায়, তাদের প্রতিহত করতে হবে। লেখক : সাবেক সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
×