ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকাশনার জোয়ার আসে ৯০ দশকে

প্রকাশিত: ০৩:২৮, ১৮ মার্চ ২০১৭

প্রকাশনার জোয়ার আসে ৯০ দশকে

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রকাশনা সমাজ ও জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। যার মাধ্যমে দেশ ও জাতির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশিত এসব সংকলন জাতির পরিচয় বহন করে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো মাদারীপুরেও স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রকাশনার রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। যা নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করতে শেখায়। ১৯৭১ অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত এর সংখ্যা ছিল না বললেই চলে। দু’একটা যাও বা প্রকাশিত হয়েছে তা ছিল একুশের চেতনাভিত্তিক। সেসব প্রকাশনার মধ্যে স্বাধীনতার বীজ নিহিত থাকায় তা নতুন যুগে পদার্পণের পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে। অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে পরবর্তী প্রজন্মকে। তাই স্বাধীনতার পর ’৯০ দশক পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রকাশনার মোটামুটি একটা জোয়ার ছিল। এ সকল প্রকাশনার প্রতিটি স্তরে একুশের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা গেছে। ’৯০ দশকের পর থেকে মুক্তমনা প্রকাশনা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শভিত্তিক লেখার আবেদনও কমতে থাকে। কারণ, ’৯০ দশকের পর থেকে দেশে জঙ্গীবাদ ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। একে একে হত্যা করা হয় ব্লগার ও মুক্তমনা লেখকদের। হত্যাকারীদের বিচার না হওয়ার প্রবণতায় সারাদেশের প্রগতিশীল লেখক-কবি-সাহিত্যিকরা নীরব বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়। তাই বলে তারা যে লেখা বন্ধ করে দিয়েছে, তা নয়-শুধু প্রকাশনার হাত কিছুটা সংকুচিত করে রেখেছে। ’৭১-এর পর ’৯০ দশক পর্যন্ত জাতীয় বিশেষ দিবসগুলোতে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অসংখ্য প্রকাশনার পাশাপাশি বহু সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছে। এ সকল পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে। এর মধ্যে রয়েছে- কথা, নওরোজ, প্রকাশ, মাদারীপুর বার্তা, গ্রামবাংলা, স্বদেশবাণী, অতন্ত্র প্রহরী, আড়িয়াল খাঁ, ইশারা, বর্তমান ইশারা, শিবচর সাময়িক, মাদারীপুর বাণী, পোস্টার, সুপ্রভাত, যুগচেতনা, শান্তি সাময়িকী, শাহমাদার, ময়নাকাটা, শরীয়তউল্লাহ, সুবর্ণগ্রাম, বিনির্মাণ, আজকাল, প্রতিভা, আলোড়ন, সকাল, সুবার্তা, প্রান্ত, গণসচেতনতা, বিশ্লেষণ, আনন্দবাংলা, একুশ দর্পণ, আশ্বাস। বছর জুড়ে প্রকাশিত এ সকল প্রকাশনায় স্থান পেয়েছে একুশ ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিক ইতিহাস। এছাড়া মাদারীপুর থেকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাব্যগ্রন্থ, ছড়া, নাটক, গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে বেশ ক’টি। এর মধ্যে বাংলা একাডেমির উপ-পরিচালক ইতিহাসবিদ ড. তপন বাগচীর মুক্তিযুদ্ধে কিশোর ইতিহাস (ইতিহাস গ্রন্থ), মঞ্জুরুল হকের একাত্তরের নিঃসঙ্গতা (উপন্যাস), মুক্তিযোদ্ধা আকন্দ মোশাররফ হোসেনের স্মৃতির নিঃশব্দ সূর্যাস্ত (উপন্যাস), ইতিহাস ঐতিহ্য অমরত্বের কালকিনি (ইতিহাস গ্রন্থ), রক্ত নদীর জোয়ার (কাব্যগ্রন্থ), একাত্তরের বিপ্লব (নাটক), বিদ্রোহী বাউল (নাটক), বর্ণমালার ছন্দে মুক্তিযুদ্ধের কবিতা (ছড়া গ্রন্থ প্রকাশিতব্য), পরাধীন বাংলার বঙ্গবন্ধু (ইতিহাস গ্রন্থ), মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দিন জমাদারের মাদারীপুর শহীদ স্মৃতি কথা (ইতিহাস গ্রন্থ), কাজী আবুল হোসেনের মুক্তিযুদ্ধ পথে পথে (উপন্যাস), সিরাজউদ্দিন আহমেদের মাদারীপুর জেলার ইতিহাস (ইতিহাস গ্রন্থ), দুলাল ম-লের রক্ত আলেখ্য একাত্তর (গল্প গ্রন্থ), তবুও আমি যাব (কাব্য গ্রন্থ), বেনজীর আহমেদের মুক্তিযুদ্ধে মাদারীপুর (ইতিহাস গ্রন্থ), মাদারীপুর জেলা প্রশাসনের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী (ইতিহাস সংক্রান্ত স্মরণিকা), কবি দুলাল সরকারের একটি বকুল গাছ ও আমার একাত্তর (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ)। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত দু’-চারটে প্রকাশনা ছাড়া সবগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে শখের বশে পত্রিকায় দু’-একটি প্রকাশ করছেন। পারিপার্শ্বিক কারণে অথবা অর্থনৈতিক বা পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে প্রায় সব প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে মাদারীপুর অঞ্চলে যেসব পত্রিকা কোনমতে টিকে আছে তার মধ্যে সুবর্ণগ্রাম (দৈনিক), বিশ্লেষণ (দৈনিক), প্রান্ত (দৈনিক), মাদারীপুর সংবাদ (দৈনিক), সাপ্তাহিক পত্রিকার মধ্যে বর্তমান ইশারা, শরীয়তউল্লাহ, সুবার্তা, আনন্দবাংলা, একুশ দর্পণ, আশ্বাস প্রকাশিত হচ্ছে অনিয়মিতভাবে। ১৯৭১ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত এই বিশ বছরে বেশ কিছু প্রকাশনার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৯১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ২১ বছরে মিডিয়া স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে। এ সময় বেশ কিছু সংবাদপত্র সরকারী অনুমোদন পায়। তবে আধুনিক ও তথ্য প্রযুক্তির যুগে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক, মননশীল, গবেষণা ও বিশ্লেষণধর্মী প্রকাশনা খুঁজে পাওয়া দুস্কর। এক সময় উপজেলা ও জেলা সদর থেকে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে প্রকাশিত হয়েছে স্মরণিকা ‘আমি বিজয় দেখেছি,’ ‘মননে মুজিব,’ ‘সন্দীপন,’ ‘চিন্ময় রক্তপাত,’ ‘স্বদেশ আমার,’ ‘বিজয়ের প্রসন্ন প্রহর,’ ‘ধূপছায়া,’ ‘ভাঁজপত্র’, ‘স্বাধীনতা,’ ‘গাঙচিল কণ্ঠ,’ ‘রঙধনু’, ‘সবুজ পাতা’, ‘কালোত্তর’, ‘গণকবর,’ ‘শহীদ সুফিয়া আমার বোন,’ ‘বীরাঙ্গনা,’ ‘যুদ্ধশিশু’ ও ‘মুক্তিসেনা।’ এ সকল প্রকাশনা ছিল একুশ ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাময়িকী। -সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×