ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্ত এলাকা হতে প্রকাশিত হতো জাগ্রত বাংলা

প্রকাশিত: ০৩:২৮, ১৮ মার্চ ২০১৭

মুক্ত এলাকা হতে প্রকাশিত হতো জাগ্রত বাংলা

একাত্তরের উত্তাল মার্চের শুরু থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের চারদিকে প্রতিরোধ আর সম্মুখযুদ্ধের ডামাডোল চলছে। এপ্রিলের পর ময়মনসিংহের বেশিরভাগ অঞ্চল পাকসেনারদের দখলে চলে যায়। তারপরও নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কেবল মুক্ত ছিল বনাঞ্চল আর লালমাটির পাহাড় অধ্যুষিত ভালুকা। ময়মনসিংহের এই মুক্ত অঞ্চল থেকে প্রকাশ করা হয় হাতে লেখা প্রথম সাহসী সংবাদপত্র ‘জাগ্রত বাংলা’। প্রথম দুটি সংখ্যা এপ্রিল ও মে হাতের লেখায় প্রকাশ করা হলেও পরের সংখ্যা বের করা হয় সাইক্লোস্টাইল মেশিনে। মুক্তিযুদ্ধে ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহাসিক এই দলিলের সম্পাদক ও প্রকাশক বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএ কালাম। আলাপচারিতায় এসএ কালাম জানালেন সেদিনের এই দুঃসাহসিক উদ্যোগের ইতিবৃত্ত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জাগ্রত বাংলার ১ম সংখ্যা প্রকাশ করা হয়েছিল একাত্তরের এপ্রিলে। ২য় সংখ্যাটি বের হয় সে বছরের মে মাসে। হাতের লেখায় বুলেটিন আকারে কাগজের ফুল স্কেপে এই দুটি সংখ্যা বের করার পর পরের সংখ্যাগুলো বের করা হয় সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ঘুরিয়ে। ভালুকা উপজেলার দুর্গম ডাকাতিয়া ইউনিয়নের আজাদ নগর থেকে প্রকাশ করা হতো জাগ্রত বাংলা। মুক্তিযুদ্ধকালীন ভালুকার আফছর বাহিনীর প্রধান প্রয়াত মেজর আফছর উদ্দিন আহমদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএ কালামের সম্পাদনায় বের হতো জাগ্রত বাংলা। বাংলাদেশের মানচিত্র ও স্বাধীন বাংলার পতাকাসহ জাগ্রত বাংলা প্রকাশ হতো। প্রথমে ফুল স্কেপ কাগজে লিখে দিতেন এসএ কালাম। পরে সেটি দেখে কপি করতেন স্থানীয় আমজাদ হোসেন, আবু হানিফ, মুকতাদির, হযরত আলী, আবদুল বারী, মতিউর রহমানসহ ২০ জনের দল। পরে সেটি মূলত ট্রেনে বিলি বণ্টন করা হতো। আজাদ সংঘের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা এই বিলি বণ্টনের কাজটি করতেন। ১ম ও ২য় সংখ্যা বের হয়েছিল ৫০০ কপি। এসব কপি গফরগাঁও, কাওরাইদ, শ্রীপুর, ভালুকা ও ময়মনসিংহ রেলস্টেশনে ট্রেন যাত্রীদের কাছে বিলি করা হয়। আর ১০০ কপি পাঠানো হয় ভারতের কলকাতায়। প্রথম দিকে হাতে লেখায় জাগ্রত বাংলা বের করার সময় প্রধানত বাঙালীদের উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন মুখরোচক সেøাগান আর মুক্তিযোদ্ধাদের সভা-সমাবেশের খবর দেয়া হতো। স্লোগানের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল একটা দুইটা পাঞ্জাবী ধর, সকাল বিকেল নাস্তা কর, ভুট্টোর মুখে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর, টেংরা মাছের তিন কাটা, বোয়াল মাছের দাড়ি, টিক্কা খান ভিক্ষা করে শেখ মুজিবের বাড়ি’। পরবর্তীতে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও মেজর আফছরের দেয়া দুটি সাইক্লোস্টাইল মেশিন পাওয়ার পর জাগ্রত বাংলা গতি পায়। স্থানীয়ভাবে রিয়াজ পাগলা ও কাদের এই মেশিন বহন করত। মুক্ত ভালুকার বিভিন্ন জায়গা থেকে এটি প্রকাশ করা হয়। এর পেশাদার কোন লেখক কিংবা সাংবাদিক ছিল না। তবে মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডারদারদের দেয়া খবরই প্রকাশ পেত জাগ্রত বাংলায়। এর মধ্যে বেশিরভাগ লেখাই ছিল সম্পাদক এসএ কালামের। ময়মনসিংহ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক জেলা কমান্ডার আবদুর রব জানান, একাত্তরে জাগ্রত বাংলার প্রকাশনা ছিল দুঃসাহসিক পদক্ষেপ। এর বাইরে ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে ওই সময় আর কোন প্রকাশনা ছিল বলে জানা যায়নি। কাজেই জাগ্রত বাংলা এই বিবেচনায় ঐতিহাসিক দলিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন জাগ্রত বাংলায় ময়মনসিংহ অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধার বিজয় ও সাফল্য ছাড়াও পাকসেনাদের হত্যা লুণ্ঠন অগ্নিসংযোগ ও নারী ধর্ষণের খবর ছাপা হতো। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিবাহিনীর ইশতেহার এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার খবরও ছাপা হয়। ইশতেহারের হাজার হাজার কপি বিলি করা হয়। এই ইশতেহার প্রচারের পর অনেক রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। একাত্তরে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে জাগ্রত বাংলা। তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাগ্রত বাংলা পত্রিকাকে শুভেচ্ছা বাণী দিয়েছিলেন। আর মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সান্ট সিং মেজর আফছর উদ্দিনের উদ্যোগের প্রশংসা করে তাঁকে যথোপযুক্ত পুরস্কারের সুপারিশ করেছিলেন। এর সম্পাদক এসএ কালাম মহান একাত্তরের বিভিন্ন যুদ্ধ নিয়ে পরে প্রকাশ করেন ‘মুক্তিযুদ্ধে মুক্ত এলাকা।’ এই গ্রন্থে ভালুকা ছাড়াও ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন প্রতিরোধ ও সম্মুখযুদ্ধের বিবরণ রয়েছে। -বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ থেকে
×