ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কাব্য-সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৩:২৭, ১৮ মার্চ ২০১৭

কাব্য-সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর দ্রুত এগিয়ে যায় আমাদের কাব্য সাহিত্য ও নাটক। তবে সাড়ে চার বছর পার হতেই তাতে ভাটা পড়তে শুরু করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পরই সাহিত্য ও নাটকের অভিযাত্রা স্থিমিত হয়ে পড়ে। সামরিক সরকার কখনই চায়নি মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে বুদ্ধিজীবীরা সোচ্চার হোক। লেখালেখি হোক। এমনকি তারা জাতির পিতার নামটি পর্যন্ত মুছে ফেলতে চেয়েছে। এ জন্য যত রকম অপতৎপরতা সবই করেছে তারা। এর মধ্যেই সামরিক জান্তাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার লেখকরা লেখালেখি করেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে তাদের চোখে দেখা ঘটনা বর্ণনার রীতিতে তুলে ধরেন। কেউ সেদিনের ঘটনার নাটক লিখে মঞ্চায়ন করেছেন। বিচ্ছিন্নভাবে এমন লেখালেখির মধ্যে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে স্বাধীনতার ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত চরমপত্রের লেখক ও পাঠক এম আর আখতার মুকুল রচিত ‘আমি বিজয় দেখেছি’ পাঠকমহলে সমাদৃত হয়। ’৭১-এর অবরুদ্ধ বাংলাদেশ কি অবস্থায় ছিল, মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে বীরত্বের সঙ্গে লড়ে হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পরাভূত করে সেই চিত্র উঠে আসে তাঁর লেখনীতে। তাঁর লেখা ’৪০ থেকে ’৭১ সময়ের চলমান ইতিহাস। ড. নীলিমা ইব্রাহিমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ এমন একটি প্রকাশনা, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতœ সম্পদের মতো সম্পদ। যা চেতনার বহ্নিশিখার একেকটি পাতা। মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য ছিল এমন একটি প্রকাশনা ড. কামাল হোসেনের। নামই বলে দেয় বাঙালী জাতিকে কেন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল। ড. আলীম চৌধুরী ও শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর ’৭১-এর শহীদ, আন্দালিব রুশদীর ’৭১-এর দলিল, জাহানার ইমামের ’৭১-এর দিনগুলো, সুফিয়া কামালের ’৭১-এর ডায়েরি, হুমায়ুন আহমেদের ১৯৭১ প্রকাশনা সমুহ কালের প্রবাহে ১৯৭১ সাল আর বাংলাদেশকে তুলে ধরেছে। একই সঙ্গে ইতিহাসে কুখ্যাত হিসেবে পরিচিত হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কলঙ্ককে প্রকারান্তরে বিশ্বে পাকিস্তানের কলঙ্ক হিসেবে প্রমাণ করেছে। বাঙালীর এখনও ভাবতে অবাক লাগে এই কলঙ্কিত পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত বিভাগের পর ২৩ বছর বর্তমানের বাংলাদেশ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান কি করে ছিল! প্রকাশনাগুলো প্রমাণ দেয় বাংলাদেশকে পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্ত করার কত প্রয়োজন ছিল। আমাদের গর্ব মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান, মুনতাসীর মামুন, ড. এনামুল হক, শাহরিয়ার কবির, নির্মলেন্দু গুণ, ইমদাদুল হক মিলন, মইনুল আহসান সাবের, হাসান আজিজুল হক, লুৎফর রহমান রিটন, বজলুল করিম বাহারসহ অনেক গুণী লেখক সত্য ঘটনা তুলে ধরে প্রামাণ্যচিত্রের মতো কেউ গল্প, উপন্যাস, কেউ ইতিহাস কেউ কবিতা কেউ প্রবন্ধ লিখে গেছেন। কেউ কেউ এখনও লিখছেন। একটি জাতিকে জন্ম দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির পিতার জীবনালেখ্য ও রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন অনেক বরেণ্য লেখক। বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা অসমাপ্ত আতœজীবনী প্রকাশিত হয়েছে। ওই প্রকাশনায় উল্লেখ আছে ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধুর চারটি খাতা বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তগত হয়। খাতাগুলো অতি পুরনো। পাতাগুলো বিপন্নপ্রায় এবং লেখা প্রায়শ অস্পষ্ট। এটি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত লেখা। যা তিনি ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ অবস্থায় লেখা শুরু করেন। কিন্তু শেষ করতে পারেননি। তার কন্যা শেখ হাসিনা জাতির সামনে তা উন্মোচন করে জাতির পিতাকে এ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও একটি জাতির জন্ম নিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের সাহিত্য। কবির চৌধুরী সঙ্কলিত ও সম্পাদিত চিরঞ্জীব শেখ মুজিব, শ্যামল বসুর আমি মুজিব বলছি, ড. অনুপম হাসান, ড. বোরহান বুলবুল, অসীম কুমারের স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, আনিসুল হকের মা, সাহাদত হোসেন খানের পলাশী থেকে একাত্তরসহ অনেক সৃষ্টি আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে শিশু কিশোরদের জন্য লিখেছেন সেলিনা হোসেন, একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প লিখেছেন রফিকুর রশিদ। দেশের বিভিন্ন জেলা শহর থেকে প্রকাশিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর নানা ঘটনা নিয়ে লেখা। নিজের চোখে দেখা ঘটনাগুলো কথা মালায় গেঁথেছেন সম্ভাবনার লেখক জিএম ইকবাল হাসান। তার লেখা ‘রাজাকারের ঘরে কৃষ্ণা’ গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধের ও পরবর্তী ঘটনার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। গ্রন্থের প্রথম গল্পটি রাজাকারের ঘরে কৃষ্ণা। গ্রামের চঞ্চলা মিষ্টি মেয়ের জীবনকে ঘিরে আবর্তিত সত্য ঘটনা। গ্রামের নাম সোনাপুর। সেই গ্রামের মেয়ে কৃষ্ণা। বিয়ে হয় মিষ্টির দোকানি হরিরামের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে গ্রামের হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আবুল কাসেম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দেন। কুদৃষ্টি পড়ে হরিরামের স্ত্রী কৃষ্ণার ওপর। মিলিটারির ভয়কে পুঁজি করে হেড মাস্টার নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয় তাদের। কৌশলে হরিরামকে হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে হত্যা করিয়ে নেয়। ঘরে বউ-বাচ্চা থাকার পরও কৃষ্ণাকে জোর করে বিয়ে করে। তারপর স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জনের পর পঁচাত্তরে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগে ভোল পাল্টে ফেলে সে। ঘটনার ইতি টানা হয়েছে এভাবে- কৃষ্ণার এখন ভাবনা একটাই কবে বিচার হবে রাজাকার আবুল কাসেমের। গ্রন্থের তেইশ পদের তরকারি গল্পটিতে হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের চামচা মতি মিয়ার চরিত্রের মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছে। একপর্যায়ে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর ইফতেখারের দৃষ্টি পড়ে মতিমিয়ার মেয়ে লিপির ওপর। মতি মিয়ার সামনেই লিপিকে তুলে নিয়ে যায় মেজর। মতি মিয়া একদিন দেখেছে তার মেয়ের বান্ধবীকে ওই মেজরের বিছানায় নিথর দেহ হয়ে পড়ে থাকতে। গ্রন্থে ‘নীরদ প-িত কি সন্তানের মুখ দেখেছিলেন’ এমন ঘটনাসহ মুক্তিযুদ্ধের অনেক বাস্তব ঘটনা জিএম ইকবাল হাসান তুলে ধরেছেন তাঁর গ্রন্থে। বগুড়ার মুক্তিযোদ্ধা ডা. আরশাদ সায়ীদ তাঁর ‘আমার অনেক ঋণ আছে’ গ্রন্থে যেভাবে তিনি যুদ্ধ করেছেন তার বর্ণনা এমনভাবে দিয়েছেন যা পড়ে মনে হবে পাঠক নিজেই যুদ্ধের ফ্রন্টে যুদ্ধ করছে। ডা. আরশাদ সায়ীদ ও তাঁর সহযোগী যোদ্ধারা বগুড়া শহরে গেরিলা যুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানী সেনাদের পাওয়ার হাউস ক্যাম্পে ছদ্মবেশে ঢুকে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাকিস্তানের ১৪ আগস্ট পালন করতে দেননি। এ দিন ছিল পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। মুক্তিযুদ্ধের এমন অনেক বর্ণনা তিনি তুলে ধরে জাতির প্রতি তাঁর ঋণ শোধ করার চেষ্টা করেছেন। পাবনার ছেলে আবুল হোসেন খোকনের প্রকাশনার মধ্যে আছে- ঘাতকের পদতলে বসবাস, জনযুদ্ধের দিনগুলো, অরণ্য শ্বাপদ, মুক্তিযুদ্ধে পাবনার আঞ্চলিক ইতিহাস। খোকন তাঁর গ্রন্থে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশী দোসর কুখ্যাত রাজাকার আলবদর আলশামসের নিষ্ঠুরতার যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তা পাঠ করে কোন সুস্থ মানুষ রাজাকার ও পাকিস্তানকে কখনই ক্ষমা করতে পারে না। বর্তমান প্রজন্মের লেখক মামুন রশীদ লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস, সেলিনা শিউলি লিখেছেন বগুড়া জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আবদুল কাইয়ুম সওদাগর লিখেছেন বগুড়ার মুক্তিযুদ্ধ। বগুড়া থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি তৌফিক হাসান ময়না ২৫ মার্চ কালরাতে বগুড়া শহরের মানুষ কিভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তার বর্ণনা শুধু নাটক লিখেই বসে থাকেননি। বগুড়া শহরের রাস্তায় এই নাটক প্রামাণ্য নাটক হিসেবে মঞ্চস্থ করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কাব্য ও সাহিত্যকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। দেশের প্রতিটি প্রান্তের অনেক লেখক স্বাধীনতার ইতিহাস ও আমাদের গর্বের মুক্তিযুদ্ধকে কাব্য সাহিত্য অঙ্গনের বিশাল ভা-ারকে ভরিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভা-ার এত বিশাল যে কয়েক জনমে লিখেও শেষ করা যাবে না। যারা লিখেছেন ও এখনও লিখছেন তাদের সকলের নাম স্বল্প পরিসরে দেয়া সম্ভব নয়, তবে তারা প্রত্যেকে এ দেশের মানুষের অপার শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র হয়ে থাকবেন অনন্তকাল। তাদের প্রতি স্যালুট। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×