ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ট্রাম্পের রাজনৈতিক দর্শন

প্রকাশিত: ০৬:১০, ১৫ মার্চ ২০১৭

ট্রাম্পের রাজনৈতিক দর্শন

আমেরিকা ফার্স্ট বা সবার আগে আমেরিকার স্বার্থ এই সেøাগানের প্রবক্তা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শন আছে। সেই দর্শন অভিষেকের সময় তার প্রদত্ত ভাষণে অতি সুস্পষ্ট ও বলিষ্ঠভাবে ঘোষিত হয়েছে। এই দর্শন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চেহারা বদলে দিতে পারে। এই দর্শন গত ৭০ বছর ধরে বিরাজমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা পাল্টে দিতে পারে। কাছেই এই দর্শনকে বিভাজনমূলক বলে একেবারে নাকচ করে না দিয়ে বরং যতটা গুরুত্ব এর প্রাপ্য ততটা গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। পর্যবেক্ষক জো ক্লেইন এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ট্রাম্পের বক্তব্যের একটি অংশ তুলে ধরেছেন। সেখানে ট্রাম্প বলেছেন, বহু দশক ধরে আমরা মার্কিন শিল্পকে বিসর্জন দিয়ে বিদেশী শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছি। অন্যান্য দেশের সামরিক বাহিনীকে ভর্তুকি দিয়েছি আর নিজের দেশের সামরিক শক্তি অতি বেদনাদায়কভাবে ম্লান করেছি। আমরা অন্যান্য দেশের সীমান্ত রক্ষা করেছি অথচ নিজেদের সীমান্ত রক্ষায় স্বীকৃতি জানিয়েছি। আমরা বিদেশে ট্রিলিয়নকে ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছি অথচ আমেরিকার অবকাঠামো ক্ষয়িষ্ণু ও জীর্ণ দশায় নিপতিত হয়েছে। এখানে তার সে বক্তব্য নিয়ে সমর্থক মহলে বেশি উত্তাপ সঞ্চারিত হয়েছে তাহলে আমেরিকার সামরিক শক্তি ক্ষয়। অন্য দুটি শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিদেশী শিল্প ভর্তুকি দেয়া এবং অন্য দেশের সীমান্ত রক্ষা করা। প্রথমটি মুক্ত বাণিজ্যের বিষয়। দ্বিতীয়টি বৈদেশিক জোট প্রসঙ্গ। মার্কিন এসটাবলিশমেন্ট সম্পর্কে যারা মন্তব্য বা বক্তব্য দিয়ে থাকেন তারা এ দুটি বিষয়কে যত জটিল হিসেবে দেখিয়ে থাকেন এগুলো আসলে তার চাইতেও জটিল। মুক্ত বাণিজ্যের বিরুদ্ধে প্রচলিত যুক্তিটা ক্ষীণ ও সহজ। আমেরিকানদের চাকরি মেক্সিকো ও চীনে চলে যাচ্ছে। এর গতানুগতিক পাল্টা যুক্তিটা অধিকতর বিমূর্ত। দক্ষিণ ক্যারোলিনার বদলে দক্ষিণ চীনে তৈরি করা হচ্ছে বলেই এখন ওয়ালমার্টে বাচ্চাদের পোশাকের দাম অনেক কম। মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি দিয়ে বলা হয় যে এই বাণিজ্য যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আর্থিক দিক দিয়ে নিট লাভের কারণ ঘটিয়েছে। তবে মনোবল হারা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে এর এক আধ্যাত্মিক খরচও আছেÑ যা থেকে অস্তিত্বের প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়। বিদেশে মার্কিন শিল্প-কারখানায় নিয়োজিতরা একজন আমেরিকান শ্রমিকের এক-চতুর্থাংশ আয় করে। স্বদেশে লাখ লাখ আমেরিকানের কর্মসংস্থানের জন্য সেই চাকরিগুলো যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনা নিতান্তই এক কাল্পনিক ব্যাপার। মনে রাখা দরকার যে যুক্তরাষ্ট্র এখন আর বৈশ্বিক উৎপাদন ও সরবরাহ টেইনের প্রধান ভরকেন্দ্র নয়। কাজেই ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেই কারখানাগুলো যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনলে বেকারত্ব সমস্যার সমাধান হবে এমন ধারণা নিতান্তই ফ্যান্টাসি। বৈশ্বিক মেনুফ্যাকচারিং শিল্পের প্রায় অর্ধেক এখন এশিয়ায়। চীনের এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট ভৌগোলিক সুবিধা আছে। আর দুর্ভাগ্যবশত যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সেখানে ফ্যাক্টরি খোলা এখন অনেক সহজ। কারণ শিল্পের সকল উপাদান কাছাকাছি সংগ্রহ করা যায়। চীনের বিশাল ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের এবং এর প্রসারমান ভোগ্যপণ্য বাজারের কাছাকাছি হওয়ায় অন্যান্য এশীয় দেশগুলোরও অনুরূপ সুবিধা আছে। মার্কিন শিল্প- কারখানা চীন ও অন্যান্য দেশ থেকে গুটিয়ে নিয়ে ট্রাম্প খোদ যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে নিয়ে আসলে কোন সমস্যারই সমাধান করতে পারবেন না বরং নতুন সমস্যারই জন্ম দেবেন। অবশ্য ট্রাম্প বিশ্বায়নের এই সমস্যার যেভাবে সমাধান করতে চান তাতে বাই প্রোডাক্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের একঘরে অবস্থার সৃষ্টি হবে। সেই সমস্যাটি কিভাবে মোকাবেলা করবেন ট্রাম্প সেটাই এক মস্ত প্রশ্ন। দ্বিতীয় নীতি-নির্ধারণী প্রশ্ন হলো বৈদেশিক জোট। ন্যাটো জোটের সৃষ্টি হয়েছিল কমিউনিজমের হুমকি মোকাবেলার উদ্দেশে। তা ছাড়া জার্মান সমরবাদ এ ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের উত্থানের আশঙ্কাও ছিল। তখনকার পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র জার্মানি ও ইউরোপের বাকি দেশগুলোকে রক্ষা করবে এটাই সবচেয়ে চমৎকার সমাধান হিসেবে সবার কাছে মনে হয়েছিল। বস্তুত রাশিয়ার দিক থেকে কমিউনিস্ট হুমকি যতদিন ছিল ততদিন এটাই ছিল সর্বোত্তম সমাধান। আজ সেই হুমকি নেই। তার বদলে আছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে অভিবাসীর ঢল নেমে আসার হুমকি। ট্রাম্প প্রশ্ন তুলতেই পারেন যে এখন কি ইউরোপীয় দেশগুলোর উচিত নয় নিজেদের রক্ষা করার জন্য নিজস্ব প্রতিরক্ষার পেছনে অধিকতর অর্থ সম্পদ বিনিয়োগ করা? সিরীয় সমস্যার সমাধানে কি তাদের অধিকতর সক্রিয় ভূমিকা নেয়া উচতি নয়? তাদের সামরিক বাহিনীগুলোর কি নিজেদের সীমান্ত রক্ষা করা উচিত নয়? তার এসব বক্তব্য সবই সংরক্ষণবাদী নীতির পরিচায়ক। বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই সংরক্ষণবাদের জন্ম যা আমেরিকাকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে এবং একঘরে করে ফেলার দিকে প্ররোচিত করবে। চলমান ডেস্ক সূত্র : টাইম
×