ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. চিত্তরঞ্জন দাশ

বালটিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১০ মার্চ ২০১৭

বালটিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

(পূর্ব প্রকাশের পর) এদিকে মূল অনুষ্ঠান শুরু হতে কিছুটা সময় তখনও বাকি, কিন্তু উচ্চমাত্রার পশ্চিমা যন্ত্রসঙ্গীতের মূর্ছনায় কর্ণগুহরে যে যন্ত্রণা ইতোমধ্যে অনুভব করছি তাতে কতক্ষণ যে এখানে অবস্থান করতে পারব সেটাই চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার সঙ্গীর অবস্থা আরও সঙ্গীন। শব্দ দূষণে সে মোটেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। তারপরও ক্রুজশিপ বলে কথা। দেখাই যাক না কি ধরনের চমক অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। এদিকে দর্শক গ্যালারি কানায় কানায় পূর্ণ হওয়ায় বাকিদের সুবিধামতো স্থানে দাঁড়িয়ে থেকে এই বিশেষ অনুষ্ঠান উপভোগ করার জন্য রীতিমতো একটা ঠা-া প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কোন কোন মদ্য সেবীদের ভর্তি গ্লাস নিয়ে নিজ আসনে ফিরে যেতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারপরও যাত্রীরা যে কতটা ন¤্র ভদ্র এবং শালীনতা বজায় রেখে চলতে পারে তারও একটা নিদর্শন দেখা গেল এই প্রমোদ তরীর নাইট ক্লাবে, যেখানে সাধারণ নিয়মনীতি ও ভদ্রতা কিছুটা হলেও শিথিল। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে হঠাৎ রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলো একদল ডানাবিহীন পরি। শুধু ডানাবিহীনই বা বলি কেন বস্ত্রবিহীনও বলতে কোন বাধা নেই। সারা শরীরের তিনটি স্থানে যতটুকু বস্ত্র আছে সেটা না থাকারই নামান্তর। আধুনিক সভ্যতার এই যুগে অসভ্যতার এক নতুন সংস্করণ এই ধরনের নগ্নতা। সভ্যতার সকল আদর্শ লালন পালন এবং ধারণ করে আবার সেই আদিম যুগে ফিরে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। পার্থক্য শুধু আদিম যুগের বন জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে নাগরিক সভ্যতার সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ অট্টালিকায় বসবাস। যা হোক ভুলেই গিয়েছিলাম যে, এটা নাইট ক্লাব এখানে তো এই ধরনের পোষাক পরিচ্ছদের প্রচলন হওয়ারই কথা, না হলে কিসের আবার বিনোদন। পশ্চিমা সভ্যতার এই দিকটাতে আমরা এশিয়ানরা এখনও ততটা খাপ খাইয়ে উঠতে পারিনি বিধায় আমাদের চোখে একটু হলেও লাগে। তবে এসব দেশে জন্ম ও বেড়ে ওঠা দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা হয়ত তাদের পিতামাতার কারণে এবং ভারতীয় সংস্কৃতির কিছুটা এখনও অবশিষ্ট থাকার ফলে ততটা উদারতা দেখাতে পারছে না। তবে তৃতীয় প্রজন্মকে আর কোন ক্রমে ঠেকিয়ে যে রাখা যাবে না সেটা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। এইখানে আমাদের ভারতীয়দের করণীয় অনেক কিছুই আছে, ভারতীয় সংস্কৃতিকে পশ্চিমা সভ্যতার মাঝে টিকিয়ে রাখার জন্য। যদিও পশ্চিমা সভ্যতার আগ্রাসন আজ পৃথিবীর সর্বত্র লক্ষণীয়। গভীর রাতে গভীর সমুদ্রের মাঝে প্রমোদ তরীতে বসে পশ্চিমা সঙ্গীতের উচ্চ মাত্রার শব্দ দূষণে যখন কান ঝালাপালা ও ত্রাই মধুসূদন অবস্থা তখন এই পরিবেশে বসে দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষা করার কথা ভাবাটাই নিরর্থক। বরং যে সংস্কৃতি চোখের সামনে সেটা উপভোগ করাটাই শ্রেয়, আর সেটাই তো উপভোগ করার জন্য এখানে আসা। শুরু হলো কিউবান নৃত্যের মন মাতানো চোখ ধাঁধানো কান ঝাঁঝালো রসালো পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। একে একে কত ধরনের ড্যান্স যে হলো তার হিসেব রাখাটাই একটা ঝামেলাপূর্ণ কাজ। শারীরিক পারফরন্স্ করতে পারফরমাররা ভীষণ পারদর্শী তাতে কোন সন্দেহ নেই। এরা সার্কাস দলের এক একজন দক্ষ শিল্পী। গান আর বাজনার তালে তালে নাচের সমন্বয় ঘটিয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জন করতে এদের জুরি মেলা ভার। দর্শকদের মধ্যেও কোন রকম ধৈর্যচ্যুতি লক্ষ্য করা গেল না। তারা পরম তৃপ্তি সহকারে একটার পর একটা অনুষ্ঠান উপভোগ করছে আর করতালিতে বিশাল আকৃতির হলটাকে মুখরিত করে তুলছে। এই মুখরিত অবস্থা যে কতক্ষণ চলেছিল বলতে পারবো না। শব্দ দূষণে অস্থির হয়ে নাইট ক্লাবটা পরিত্যাগ করার পূবে দেখলাম দর্শকদের অধিকাংশ টালমাটাল অবস্থায় নিজ নিজ আসন পরিত্যাগ করে ফ্লোরে অবস্থান নিয়েছে পারফর্ম করার জন্য। এদিকে অনুপ বাবু বায়না ধরেছেন স্যুটে গিয়ে আত্মহারা হবেন চাঁদনি রাতের আলো আঁধারের লুকোচুরির মাঝে কেমন সে দৃশ্য সাগর কূলে দেখায় তারই সাক্ষী হওয়ার। স্যুটে প্রবেশের কার্ডটা হাতে দিয়ে বললাম, আমরা চললাম আর এই রইল বিনা অনুমতির প্রবেশ পত্র। ইচ্ছামাফিক যখন খুশি ঢুকে পড়বেন সঙ্কোচ করবেন না। চলবে...
×