ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বগালেকে একদিন

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১০ মার্চ ২০১৭

বগালেকে একদিন

এক সময় হুমায়ূন আহমেদের খুব ভক্ত ছিলাম, তাঁর প্রায় বইতে দুটি শব্দ তিনি ব্যবহার করতেন ভয়ঙ্কর সুন্দর। বান্দরবানে আমি যখনই যাই তখনই আমার এ শব্দ দুটি মনে পড়ে যায়- ভয়ঙ্কর সুন্দর। এই ভয়ঙ্কর সুন্দর জায়গাটির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় প্রায় বছর পনেরো আগে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আর গন্তব্য ছিল চিম্বুক পর্যন্ত। চান্দের গাড়িও চেনা হয় তখনই। মেঘকে পাশ কাটিয়ে ভয় আর রোমাঞ্চে ভরপুর সেই অনুভূতি এখনও জীবন্ত। সে যাই হোক এখন কিন্তু চিম্বুক যাচ্ছি এটা আর কেউ বলে না। সবার লক্ষ্য নীলগিরি, নীলাচল। নামের মতোই সুন্দর জায়গা- বেশ সাজানো গোছানো। তবে আমাদের এবারের ভ্রমণটা এই সাজানো গোছানো বান্দরবানকে ছাড়িয়ে আরও একটু এগিয়ে... একটু বুনো আর অনেক বেশি প্রকৃতিক কোন জায়গাকে ঘিরে। দিনটি ২৬ মার্চ, আমরা ফজরের নামাজ পড়ে শুধুমাত্র চা খেয়েই রওনা দিলাম বান্দরবানের উদ্দেশে। আমরা মানে আমরা তিন ভাই-বোন আর আমাদের ভাগিনা মোট চারজন। চারজন বললে বোধ হয় ভুল হবে। কেননা আমাদের ড্রাইভারও ছিল, মানে পাঁচজন। যেহেতু তখনও প্রকৃতিতে বসন্ত কাল তাই গ্রীস্মের গরম থাবা আমাদের নাগাল পায়নি। আমারা বেশ ফুরফুরে ভোরের বাতাস গায়ে মেখে চলছিলাম। ভোর ভোর রওনা দেওয়ায় বেশ লাভও হলো। কুমিল্লা পর্যন্ত প্রায় নির্বিঘেœ চলে আসলাম। তখন ভোর চোখ মেলে সকালকে দেখছিল আর আমাদের পেটও জানান দিচ্ছিল আজ দিনের এতটা সময় পর্যন্ত সে উপোস আছে। সুতরাং ভববার আর সুযোগ নাই... আমরা যাত্রা বিরতি দিলাম নাস্তা করবো বলে। হাইওয়ের এ হোটেলগুলোর কোন দিন-রাত নেই ২৪ ঘণ্টাই ভিড় আর হুল্লোর আমরা খাবার অর্ডার করে বেশ তাড়া দেওয়ার পরও প্রায় মিনিট চল্লিশ লেগে গেল নাস্তা সেরে নিতে। হোটেল থেকে বের হওয়ার পর কারো মধ্যেই আর কোন ব্যস্ততার লক্ষণই নেই । কেউ কলা- চিপস্ কিনছে , কেউ পাশের হ্যান্ডিক্যাপ এর দোকানে বাহারি পণ্য দরদাম করছে। সবার আচরণে মনে হচ্ছে গন্তব্য এই পর্যন্তই ছিলো—- শেষ পর্যন্ত ড্্রাইভারের ডাকে সকলের চৈতন্য হলো। আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম, আবার চলা শুরু।এরপর বিরতীহীন পথ চলা ,আমরা ঠিক করলাম একদম বান্দরবান পৌছেই দুপুরের খাবার খাবো। পথ কিন্তু এখন সকালের মতো ঝরঝরে নয় অর্থাৎ আমাদের থেমে থেমে এগুতে হচ্ছে, কারণ জ্যাম। অনেকটা কচ্ছপের মতো গতিতে আমরা বিকেল নাগাদ বান্দরবান পৌছি। যখন আমরা হোটেলে চেক-ইন করি তখন ঘড়িতে চারটা বেজে তিরিশ মিনিট। খিদেয় কারো মাথা ঠিক নেই কোন রকমে ব্যাগ-পত্তর রুমে রেখে একটু ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলাম খাবারের খুঁজে। বিকেলটা আমরা বান্দরবান শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরাঘুরি করে কাটালাম। অবশ্য এর মাঝে পরদিন বগালেক যাওয়ার ব্যবস্থাটাও পাকা করে রখলাম অর্থাৎ গাড়ি ঠিক করে নিলাম।ও আচ্ছা বান্দরবান যাচ্ছি এটা শুরুতেই জানিয়ে ছিলাম কিন্তু সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের কথা বলিনিতো? এখন বলা হয়ে গেল। আমাদের এবারের ভ্রমণ বগালেককে কেন্দ্র করে। বগালেক নিয়ে প্রচলিত মিথটি খুব মজার। কেমন যেন একটু রহস্যময়। তবে মিথ তো মিথই, কিন্তু সত্য এই যে এটি আসলেই একটি বিধাতার একটি বিশ্বয়কর সৃষ্টি। পরদিন বেশ সকাল সকাল আমরা আমাদের যা কিছু সম্বল সব গুছিয়ে নিয়ে রুমার উদ্দেশে রওনা হলাম। পথে কোথাও সুবিধাজনক স্থানে নাস্তা করে নিব এ চিন্তা থেকেই নাস্তা না করেই পথে নামলাম। আধ ঘণ্টা পথ চলার পর পেট যেন আর মানতে চাইল না, তাই বাধ্য হয়ে থামতে হলো। পাহাড়ি পথের বাঁকে ছোট্ট একটি দোকান জিজ্ঞেস করে জানা গেল একানে সকালের নাস্তা পাওয়া যায়। তন্দুরী রুটি আর ডিম ভাজা, সঙ্গে চাও আছে। আয়োজনটা ভালই মনে হলো- আমরা বসে পড়লাম। দোকানের ভেতরে জায়গার স্বল্পতা থাকায় বাইরে বেঞ্চ পাতা। মনোরম এক পাহাড়ের বাঁকে খোলা আকাশের নিচে বসে ডিম ভাজা আর তন্দুরী রুটি খাচ্ছি। বেশ রোমঞ্চকর, খাবারের স্বাদও মন্দ নয়। পেটপুঁজো সেরে আবার নতুন উদ্যোমে পথ চলা। এখন টানা অনেকটা পথ যেতে হবে। তাই আমরা বেশ আয়েশ করে গুছিয়ে বসলাম। আমাদের গাড়ি পাহাড় ঘেঁষে কখনও মেঘ ছুঁয়ে কখনও বা মেঘ উড়িয়ে ছুটে চলছে। আমরা ঘন সবুজের মাঝে সিঁথির মতো পথ পেরিয়ে চলছি। ঘন সবুজের মাঝে সরু পাহাড়ি পথ, কোথাও পথের দু’ধারেই খাঁদ কোথাও এক ধারে পাহাড়ের দেয়াল। খাঁদগুলো গাঢ় সবুজ জঙ্গলে ঘেরা। হঠাৎ হঠাৎ এই সবুজের ভিতর থেকে সাদা পেজাতুলা মেঘ আকাশ পানে ছুট দিচ্ছে যেন পাহাড়ের সঙ্গে দৌড় ছুটের পাল্লা দিচ্ছে। অনেকক্ষণ থেকেই রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের সঙ্গী হয়ে ছিল তবে ‘দূর কোথাও দূরে’ গানটি যখন বেজে উঠল তখন পথ আর প্রকৃতির সৌন্দর্য যেন বহুগুণ বেড়ে গেল। ওয়াই জংশনে এসে পথ দু’ভাগ হয়ে গেল একটি নীলগিরি হয়ে থানচির পথ ধরল অন্যটি রুমার। আমরা রুমার পথ ধরলাম। ওয়াই জংশনের কিছুটা আগে আমাদের মিলন ছড়ি চেকপোস্টে নামতে হয়েছিল নিজেদের পরিচয় জানতে। আর সেই সুযোগে মেঘের সঙ্গে একপ্রস্থ মোলাকাত হয়ে গেল। অনেকক্ষণ থেকেই গাড়িতে বসে মেঘের আনাগোনা দেখছিলাম ছুঁতে পারছিলাম না। এবার স্বাদ মিটল। আমরা ইচ্ছে করেই এখানে কিছুটা সময় কাটালাম। প্রায় মিনিট পনেরো পর আবার যাত্রা এবার আর কোথাও না থেমে সোজা রুমা। রুমার পথটা অতটা মসৃণ নয়। বেশ উঁচু নিচু আর খানা-খন্দে ভরা। এছাড়া পাহাড়ের নিজস্ব বাঁক তো আছেই। মুড়ির মতো ঝাঁকি খেতে খেতে আমরা বেলা নটা নাগাদ রুমা বাজারে পৌঁছুলাম। আমাদের ড্রাইভারের কাছ থেকে আগেই জেনেছিলাম রুমায় এসে আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে একজন গাইড ঠিক করা। তাই আমরা এসেই গাইডের খুঁজে লেগে গেলাম। এটা যে এতোটা ঝক্কির কাজ আগে জানাছিল না। প্রথমে এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয় তারপর এজেন্ট সিরিয়ালি গাইড সরবরাহ করে। যেহেতু এ সময়টাতে বেশকিছু পর্যটক দল বগালেক যাওয়ার উদ্দেশে রুমায় হাজির তাই সিরিয়ালটাও বেশ লম্বা। যা হোক গাইড ঠিক হলো, এবার বিপত্তি গাড়ি নিয়ে। যে গাড়িটি নিয়ে আমরা বান্দরবান থেকে এসেছি পথে দুরাবস্থা দেখে সে আর বগালেক যেতে চাইল না। অবশ্য আমাদের নব নিযুক্ত গাইড রিংকু আমাদের আশ্বস্ত করে গাড়ি যোগাড়ের চেষ্টায় নেমে পড়ল এবং সফলও হলো। এই মধ্যে বিজিবি ক্যাম্পে আমাদের নাম ঠিকানা এন্ট্রি হয়ে গেল। এটা বাধ্যতামূলক। প্রায় ঘণ্টা খানেক সময় আমাদের এখনে খরচ করতে হলো। রুমা বাজারেই শুনেছিলাম পথের বর্ণনা এখন দেখছি আর হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এতক্ষণ তো বলছিলাম মুড়ির মতো ঝঁকি খাচ্ছি এখন মনে হচ্ছে পুরোপুরি আলুভর্তা হয়ে যাচ্ছি। কোথাও কোথাও মনে হচ্ছে গাড়ি চালানোর দরকার নেই গাড়ি আপনাতেই সে টগবগ টগবগ করে চলবে। আর যে চলছে সেটা গাড়ি না ঘোড়া বোঝা দায়। একই সঙ্গে ধুলায় ধূসরিত পথের ধুলায় আমাদের সবার চেহারা ভূতুড়ে হয়ে উঠছে। যতই সামনে যাচ্ছি পথ ততই বন্ধুর হচ্ছে, অবশ্য তাতে আমাদের সামনে যাওয়ার আগ্রহে কোন ঘাটতি পড়ছে না, ঘাটতি পড়ছে না আনন্দেও। এরই মধ্যে আমরা বেশ কিছু পাহাড়ি জনপথ ছাড়িয়ে এসেছি। একেকটা জনপদের একেকটা নাম। পথ চলতি দেখা মিলল আনেক পাহাড়ির- পিঠে বাঁশের ঝুড়ি বেঁধে চলছে হাটের পথে আথবা হাট ফেরতা বাড়ির পথে, এ পাহাড়ের চিরচেনা ছবি। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক চলার পর আমরা একটা সমতল খোলা জায়গায় পৌঁছুলাম। এটিও একটি পাহাড়ি জনপদ জানলাম এর নাম কমলা বাজার। আমরা যখন বগালেক পৌঁছাই বেলা তখন দুপুর ছুঁই ছুঁই। করকরে রোদে আমরা বগালেক পাড়ায় ঢুকি। বম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত পাড়াটি বেশ জমজমাট। মনে হলো ছোটখাটো একটি আদি শহর। এখানে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা বলতে একতলা/দোতলা বিভিন্ন ধরনের কাঠের মাচাং। পাড়াটিতে ঢুকেই যে মাচাংটি আমাদের নজর কেড়েছে খোঁজ নিয়ে জানা গেল এটি জেলা পরিষদের এবং তখনও পর্যন্ত ফাঁকা ছিল। আমরা সাত-পাঁচ কিছু না ভেবে তৎক্ষণাৎ এখানেই থাকব বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। এ মাচাংয়ের বিশেষত্ব হচ্ছে সামনে পেছনে ঝোলানো ব্যালকনি এবং পেছনের ব্যালকনিটা একদম লেকের ধার ঘেঁষে। যিনি এই মাচাংয়ের দায়িত্বে ছিলেন তিনিই আমাদের খাবার-দাবারের দায়িত্ব নিলেন। সূর্য তখন ঠিক মাথার ওপর অর্থাৎ লাঞ্চ টাইম হতে আরও সময় বাকি তাই আমাদের গাইড পরামর্শ দিল আমরা চাইলে এ সময়টায় কেওক্রাডং ঘুরে আসতে পারি। আইডিয়াটা মন্দ ছিল না। তাই আমরাও রাজি। আমাদের অস্থায়ী আবাসের সাময়িক দখলদারিত্ব বুঝে নিয়ে মালামাল যা কিছু গাড়িতে ছিল তা কোন রকমে ঘরে রেখে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম। বগালেক পাড়ার ভিতর দিয়েই কেওক্রাডং যাওয়ার রাস্তা। হেঁটে যেতে প্রায় ঘণ্টা আড়াই/তিন লাগলে গাড়িতে আমরা মিনিট ৪০/৪৫ এর মধ্যে কেওক্রাডং পৌঁছে যাই। এখানে মেঘকে অনেক কাছ থেকে দেখা যায়। মেঘে আর রোদের অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা চলে এখানে। আর মাঝে মাঝেই দমকা বাতাস তাদের খেলায় ব্যাঘাত ঘটায়। কেওক্রাডং এ আসার পর থেকে আমার মাথায় ছোট বেলায় সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে পড়া ‘বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কেওক্রাডং (এখন বিজয়)’ এই কথাটি অকারণে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর আমি এখন তার চূড়ায়। একটু নস্টালজিক অনুভূতি। জানি না অন্যদের মনের ভাবনা কি ছিল। কেওক্রাডংএ বেশ কিছু খাবার হোটেল আছে। না আহামরি কিছু না, এ বিজন পাহাড়ের তা সম্ভবও নয়। হোটেলগুলো তখন পর্যটকদের আপ্যায়নে ব্যস্ত। আমরা যখন বগালেক ফিরে এলাম তখন সবে বিকেল তার পসরা সাজাচ্ছে। ফেরার পথে খুব ক্লান্ত লাগছিল মনে হচ্ছিল ঘরে ফিরে একটু রেস্ট নিতেই হবে। কিন্তু ফেরার পর লেকের দিকে তাকিয়ে সমস্ত ক্লান্তি যেন কোথায় পালিয়ে গেল। বিকেলের সোনা রোদে ঝলমল করছে লেকের জল। মনে হচ্ছে রূপকথার রাজ্যের সোনার কাঠির ছোঁয়ায় লেকের সমস্ত জল যেন সোনা হয়ে গেল। অবাক করা সৌন্দর্যে মুগ্ধ আমরা ভাষাহীন। এরই মাঝে বিকেল সন্ধ্যের কাছে সময়ের ভার দিয়ে ঘরে ফিরল। আমরাও ফিরলাম। সন্ধ্যেটা আর একটু জাঁকিয়ে বসতেই আমরা তৈরি বগালেকের জলে জলকেলির জন্য। এ সময়টা বেছে নেওয়ার একটি কারণ ছিল বৈকি, একটু নির্জনতা আর নির্জনে জলের সঙ্গে আলাপনের সুযোগ। এরপর রাত। তরণী রাত্রিতে বগালেক পাড়া কোলাহলে মুখরিত। গানে আড্ডায় জমজমাট পুরো পাড়া। রাতজুড়ে এতটুকুর জন্য নির্জনতা আসেনি বগালেক পাড়ায়। তবে নির্জন ভোরের দেখা মিলেছিল। আমরা বেশ ভোরেই বিছানা ছাড়ি, মনের মধ্যে একটা তাড়া ছিল বগালেক আর সমস্ত পাড়াটা একটু ভালো করে ঘুরে দেখা। সূর্য তখনও কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে আছে। ভোরের কোমল আলোয় ¯িœগ্ধ বগালেক আর চারধার..। আমরা পাড় ঘেঁষে জেগে থাকা পাথরের চাইয়ের ওপর বসে লেকের জলে পা ডুবিয়ে বসি। নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে এক সময় তন্ময় হয়ে সূর্যের গা থেকে কুয়াশার চাদর সরে যেতে দেখি। দেখি সূর্যের প্রথম আলোক ছটায় ঝলমলিয়ে ওঠা লেকের জল। বেলা বাড়তে থাকে আবার ব্যস্ত হতে শুরু করে জনপদ। আমরাও ব্যস্ত হই নিজেদের গুছগাছে, ফিরতে হবে ...।
×