ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দিলরুবা শাহানা

বইমেলাতে ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ দুপুরবেলার অক্ত...’

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বইমেলাতে ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ দুপুরবেলার অক্ত...’

ফেব্রুয়ারি শোকের মাস। ফেব্রুয়ারি দুঃখের মাস। ফেব্রুয়ারি গৌরবের মাস। ফেব্রুয়ারি চেতনাকে আলোকিত করার মাস বুদ্ধিবৃত্তিকে শানিত করার মাস। শহীদের রক্তেই একুশের দুপুর ছিল অক্ত বা মাখানো ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের শহীদের রক্তে নির্মিত। তাঁদের প্রতি জানাই আনত শ্রদ্ধা। কেউ যদি না জানে একুশে ফেব্রুয়ারি কিভাবে নির্মিত হলো তারও জানা বোধহয় (নাকি অবশ্যই!Ñ দরকার। যার আত্ম আলোকিত একুশের আলোকে তিনি নিজেকে বাঙালী বলেই সম্মান করতে জানেন। যিনি এ ব্যাপারে অজ্ঞ তার জন্য দুঃখ হয়। আর যিনি নির্লিপ্ত ও বাঙালী পরিচয় নিয়ে দ্বিধায় ভুগছেন তিনি নিজের আত্মপরিচয়কে সম্মান করতে জানেন না। করুণা ও অবজ্ঞা তার প্রাপ্য। ঈদপর্ব, পূর্জাপার্বনে নতুন পরিচ্ছদ উঠে অবয়বে। পিঠাপুলি, পায়েস আর পরোটা কাবাব, সেমাইয়ে রসনা হয় তৃপ্ত। আর ফেব্রুয়ারি এলে নতুন বই আসে ঘরে, আত্মতৃপ্ত হয়, সমৃদ্ধ হয় নানা ধরনের বইয়ের রস আস্বাদনে। বইমেলা প্রাণের মেলা। বিদেশে বসেও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে বা কল্যাণে বইমেলা সম্বন্ধে খবর জানা যাচ্ছে। ইন্টারনেটে পত্রপত্রিকায় বইমেলার প্রতিদিনের গল্পগাঁথা সমাচার তো রয়েছেই। বাংলাভিশন ও চ্যানেল আই বাংলা একাডেমির বইমেলা প্রাঙ্গণ থেকে টিভিতে সরাসরি অনুষ্ঠানও দেখাচ্ছেন। শিশু থেকে পরিণত বয়সের মানুষের ঢল নেমেছে বইমেলাতে। পছন্দের বই খুঁজে নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরছেন কেউ, কেউ বার বার যাচ্ছেন নতুন কি কি বই এলো দেখার জন্য। দেখা, চেনা, জানা ও বই কেনার উৎসব ফেব্রুয়ারি, যে উৎসব শহীদের স্মৃতিচারণায় অর্পিত। দেশে প্রিয়জনের কাছে আবদার যাচ্ছে কি কি বই কিনতে হবে সেই তালিকা নিয়ে। নদীর সুপেয় পানি তাকে ঘিরে থাকা অঞ্চলের মানুষেরই শুধু পিপাসা মিটায় আর সুন্দর সুমিষ্ট বই সীমানা ছাড়িয়ে দূরে, বহু দূরেও হৃদয় পরিতৃপ্ত করে। বই কাল থেকে কালান্তরে, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে বয়ে নিয়ে যায় তার বাণী। অনেক বছর আগে একটি ছড়া শুনেছিলাম। একটি বাচ্চা ছড়াটি শুনিয়ে নিজেই হাততালি দিয়ে পাঁয়রা উড়ানোর মতো হাত ওপরে ছুড়ে শেষ করল এই বলে যে ‘প্রভাতফেরি প্রভাতফেরি আমায় নেবে সঙ্গে বাংলা আমার বচন আমি জন্মেছি এই বঙ্গে’ এই ছড়ার গল্প আমার এক বান্ধবীকে শুনাই। তার কাছে যে এই ছড়া নিয়ে আরও চমৎকার ঘটনা আছে তা জেনে বিস্মিত হই। তখন মনে হয় বই পারে এক প্রজন্মের ভালবাসা মেখে পৌঁছে যেতে আরেক প্রজন্মের কাছে। সে ১৯৮৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ছোট্ট ভাইজিকে বাংলা একাডেমির বইমেলাতে নিয়ে যায়। তখনো পড়তে শিখেনি তো তাই ফুল, পাখি আঁকা রঙিন মলাটের বইই পছন্দ হলো মেয়েটির। বই কিনেই ক্ষান্ত হলো না। বাড়িতে ফুপু, চাচু, মা, দাদু সবাইকে ব্যতিব্যস্ত রাখত বই থেকে ছড়া পড়ে শুনানোর জন্য। নিজে পড়তে না জানলেও ছড়া শিখতে তার দেরি হলো না। এদিকে বইয়ের অবস্থা নরম হয়ে এলো। ফুপু সেলাই করে বইটি যতেœ অন্য বইয়ের মতোই আলমারিতে তুলে রাখলেন। এরপর কত মাস, কত বছর কেটে গেল। সেই মেয়ে লেখাপড়া শিখলো। বিয়ে হলো তার। বছরের শেষে ছোট্ট ফুটফুটে এক বাচ্চার মাও হলো সে। স্বামী অফিস থেকে বিদেশে দায়িত্ব নিয়ে গেলেন। মেয়েটিও কিছুদিন পর রওনা হলো স্বামীর কাছে। যা যা নেয়ার তা নেয়া হলো। কথা না শেখা ছোট্ট মেয়ের জন্য বাজার ঘুরে বাংলা ছড়ার বই, ছড়ার ক্যাসেট কত কি কেনা হলো। যাওয়ার আগে বাপের বাড়ির বইয়ের আলমারি খুলে তার নিজের ছোটবেলার বই থেকে সেই ছড়ার বইটিও নিয়ে গেল। মেয়েটির নাম জানা জরুরী নয়। ওকে নিয়ে হয়ত বা ছড়া কাটা যায়। ‘মেয়েটি গেল দূর প্রবাসে সঙ্গে নিল কি? সঙ্গে নিল বাংলা ভাষার ছড়ার বইটি’ বইয়ের গল্প শুনে জানতে চাইলাম ‘ছড়ার বইয়ের নামটা মনে আছে?’ ‘ছড়াগুলো কিছু কিছু মনে আছে, বইয়ের নাম তো মনে নেই, দেখি ভাইজির সেঙ্গ কথা হলে তখন জেনে নেব’। প্রায় বছর ঘুরতে চললো। ফেব্রুয়ারি মাসও এসে গেল। কথাটা আবার মনে করিয়ে দিলাম। এবার বান্ধবী কথাটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিল। ইচ্ছা ছিল বইয়ের নাম জানতে পারলে বইটি দেশ থেকে আনিয়ে নেব। বান্ধবীর ওপর অভিমান হলো, একটি বইয়ের নাম জানতে এত সময় লাগছে ওর! বইটির তথ্য যোগাড়ের চেষ্টায় বিফল হয়ে শেষ পর্যন্ত ছড়ার ওই বইসহ দুই প্রজন্মের ছবি আমাকে এনে দিল। বান্ধবী বাংলা একাডেমিতে বেশ কয়েকবার ই-মেইল করে জানতে চেয়েছিল বইটি এখনও বাজারে কিনতে পাওয়া যায় কিনা। পাওয়া গেলে সে অর্ডার দিতে চায়। কোন উত্তর সে পায়নি। আমার বান্ধবীর ধারণা, বাংলা একাডেমি সব বাংলা বইয়ের খবর রাখে। ওর আন্তরিকতায় সঙ্গে সঙ্গে আমার অভিমান উবে গেল। আমি বই পেলে খুশি হতাম। তবে ছবিসহ তথ্য আমার এই লেখা তৈরিতে কিছুটা অন্যরকম বৈচিত্র্য এনে দিল। ছবিতে বইয়ের নাম দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। ‘ফুলের কাছে পাখির কাছে’ নামে সুন্দর ছড়ার বইটি বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখক, ছড়াকার আল মাহমুদের। বই পড়তে এমনিতেই মজা, আর ছড়ার বইয়ে অফুরান মজা। এই বইতে রয়েছে চেতনায় আলো জ্বেলে দেয়া ছড়া। ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ দুপুর বেলার অক্ত বৃষ্টি নামে বৃষ্টি কোথায় বরকতের রক্ত’ এই আইরিশ মহিলা চাকরি নিয়ে বাংলাদেশে ছিলেন কিছুদিন। নাম তার শেইলা রায়ান, মাতৃভাষা গেইলিক। ঢাকাতে আমাকে একটি কথা বলে আপ্লুত করেছিলেন, আমরা নাকি বড় বিস্ময়কর এক জাত ভাষা বাঁচাতে জান কবুল করেছি। দুঃখ করে বলেছিলেন, তাদের ভাষা প্রায় মরেই গেছে, ওই ভাষাতে কথা বলার মানুষ কদাচিৎ মেলে। বাংলা ছড়ার বইসহ মা-মেয়ের ছবি দেখে মনে হলো বাংলা ভাষা বেঁচে থাকবে, ভালবাসা পাবেই। একে রক্ষার জন্য মানুষ বুকের রক্ত দিয়েছে যে! ‘মেয়েটি ছিল আন্দোলনে মেয়েটি ভীষণ একা মেয়েটির নাম বাহান্নতে বুলেট দিয়ে লেখা’ মেয়েটি কে? শিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য্য গানে গানে যে মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন সেই হচ্ছে আমাদের অনেক সাধের বাংলা ভাষা।
×