১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি যে তিনজন ভাষার জন্য প্রাণ দিলেন, তারা পুরনো ঢাকার বাসিন্দা ছিলেন। একথা হয়তো অনেকেই জানেন না, ‘৫২ সালে ঢাকা শহর বলতে পুরনো ঢাকাকেই বোঝাতো। নতুন ঢাকা তখনো শুরু হয়নি। মতিঝিল ছিল ধু-ধু ফাঁকা প্রান্তর।
তিনজন ভাষা শহীদ, সালাম, রফিক, বরকত পুরনো ঢাকার বাসিন্দা ছিলেন বলে জানা যায়। বিশেষত শহীদ রফিক বাংলা বাজারের হেমেন্দ্র দাস লেনের একটি একতলা বাড়িতে বসবাস করতেন। পরে বাড়িটি বিক্রি করে দেয়া হয়। সেখানে এখন বহুতল বিল্ডিং উঠেছে। পুরনো ঢাকার অধিকাংশ বাসিন্দা রাজনীতি সচেতন নন বলে একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। সরদার ও পঞ্চায়েত শাসিত পুরনো ঢাকা নবাব আমল থেকে মুসলিম লীগের সমর্থক ছিল। কিন্তু একথা ধ্রুব সত্য যে, ১৯৪৭ সালের পর দেশের প্রথম আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, জনগণের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। পুরনো ঢাকার জনগণ একই ভাষা আন্দোলনে সতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে।
ই. আর খান যিনি ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য রাজনৈতিক আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়ে এসেছেন। তিনি ছিলেন কলতা বাজারের বাসিন্দা। তার বাসা ছিল রাজনৈতিক কর্মকা-ের কেন্দ্র। মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের জীবনের বেশ কিছু সময় ই. আর খানের সঙ্গে কাটিয়েছেন।
সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে আশেক লেনের নাজির আহমেদ এবং সাঈদ আহমেদ বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। সাঈদ আহমেদ সচিব হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন। তিনি নিরীক্ষামূলক নাটক লিখে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার বিখ্যাত নাটক ‘মাইলস্টোন’। তার মৃত্যুর পর বাংলা একাডেমী তার সবগুলো নাটক একত্রিত করে বই প্রকাশ করেছে।
নাজির আহমেদ দেশের চলচ্চিত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন।
পুরনো ঢাকার বনেদি পরিবারগুলো ঘরে উর্দু বললেও, চিন্তাভাবনায় ছিলেন মুক্তমনের। নাট্যকার সাঈদ আহমেদ এবং চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব নাজির আহমেদ উজ্জ্বল উদাহরণ।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর যে কটা উল্লেখযোগ্য আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, তাতে পুরনো ঢাকার বাসিন্দাদের এক বিরাট ও ব্যাপক ভূমিকা ছিল। পঞ্চায়েতের সর্দার ছিলেন দেশপ্রেমিক অকুতোভয় যোদ্ধা। তারা বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালী সংস্কৃতির সমর্থক ছিলেন।
আমার শৈশবে দেখেছি একুশের একাধিক মিছিল পুরনো ঢাকা থেকে বের হতো। তখনতো নতুন ঢাকার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। পুরনো ঢাকা বলতে ওয়ারি, গেন্ডারিয়া, নারিন্দা, লালবাগ, চক বাজার ইত্যাদি এলাকা বোঝাতো।
পুরনো ঢাকার নারিন্দার শরৎগুপ্ত রোডে দুটো সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘রূপছায়া’ ও ‘অভিযান্ত্রিক‘ বেশ কর্মতৎপর ছিল। ‘রূপছায়া’র প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন মীজানুর রহমান, যিনি ‘রূপছায়া’ নামে একটি চলচ্চিত্র মাসিক এবং মীজানুর রহমানের পত্রিকা নামক একটি সিরিয়াস সাহিত্য পত্রিকা নিজ সম্পাদনায় প্রকাশ করতেন। ‘রূপছায়া’ রম্যমাসিকে জহির রায়হান, সৈয়দ শামসুল হক, আনিস চৌধুরী, আব্দুল গাফফার চৌধুরী প্রমুখ। কথাসাহিহিত্যকেরা উপন্যাস লিখতেন।
মীজানুর রহমান ভাইদের বিশাল বাসভবনের পেছনে বিস্তৃত জায়গা ছিল। সেখানে মহিলারা সেই ১৯৫৭ সালে নাটক মঞ্চস্থ করে। ঢাকার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এটা এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। বাসভবনের সামনের যে জায়গা সেখানে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো।
শরৎগুপ্ত রোডের মাঝামাঝি বসু বাজার লেনের উল্টোদিকে ১৯৫৬ সালে ‘অভিযান্ত্রিক’ সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। প্রয়াত মণ্টু খান এবং তার ভাই সাংবাদিক আবেদ খানদের বসুবাজার লেনের বাসায় সাংস্কৃতিক এবং বামঘেঁষা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা নিয়মিত আসতেন। বেশ জমজমাট আড্ডা হতো। ৩৮ নম্বর শরৎগুপ্ত রোডে বেগম সম্পাদিকা নূরজাহান বেগম, তার স্বামী রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাই এবং সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন বাস করতেন। নারিন্দা পুলিশ ফাঁড়ি থেকে শুরু করে দয়াগঞ্জ রেললাইন পর্যন্ত এই বিশাল বলয় জুড়ে যে সাংস্কৃতিক কর্মকা- গড়ে উঠেছিল তা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। এসব ইতিহাস লেখা হয়নি, কোন গবেষণায়ও আসেনি। গে-ারিয়া অঞ্চলে একটি বিশাল পাঠাগার গড়ে ওঠে পঞ্চাশ-ষাট দশকে এবং এই পাঠাগারকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে পরবর্তী পর্যায়ে। এসব ঘটনার ইতিহাস কেউ লিখে রাখেনি। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ প্রবন্ধ লিখেছেন, কিন্তু ব্যাপক কোন কাজ হয়নি।
পুরনো ঢাকার প্রতিটি এলাকা বা মহল্লার ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস আছে। এবং একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে ঐসব এলাকাবাসীর ব্যাপক সমর্থন না থাকলে কিছুতেই এই আন্দোলন সফল হতো না।
২০শে ফেব্রুয়ারির মধ্যরাত থেকে মহল্লাবাসী ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে তৈরি হতো। শহীদ মিনারের দিকে তারা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারিÑ আলতাফ হোসেনের এই গানটি গাইতে গাইতে নগ্ন পায়ে মেডিক্যালের কাছে শহীদ মিনারে গিয়ে পৌঁছতো।
আমাদের নারিন্দার শরৎগুপ্ত রোডে ঘোড়ার একটি আস্তাবল ছিল। তখন ঢাকা শহরে এত মোটরগাড়ি দেখা যেত না। ঘোড়াগাড়ি ছিল অন্যতম বাহন। আর ছিল রিক্সা। কিছুসংখ্যক বাস। রাস্তাঘাট খুব নির্জন ছিল। আজকের ঢাকার যে চেহারা, যানজট, মোটরগাড়ি, বাস তখনকার সঙ্গে মেলানো যাবে না।
একুশে ফেব্রুয়ারির বিকেল বেলা গে-ারিয়ার বিশাল মাঠে মেলা বসতো। এলাকার বাসিন্দারা ঘোড়াগাড়ি চড়ে সেইসব মেলায় অভিভাবকরা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে যেতেন। আমরাও যেতাম। সেইসব দিন ছিল আমাদের শৈশবের সবচেয়ে আনন্দের দিন। ঢাকার লালবাগ এলাকায়ও মেলা বসতো বলে শুনেছি।
পুরনো ঢাকার সঙ্গে গভীরভাবে এবং ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে একুশে ফেব্রুয়ারি। গবেষকরা এবং ইতিহাসবিদরা যদি তৎপর হন, যদি আমাদের অনুসন্ধিৎসু মন কাজ করে তাহলে আমরা অনেক অজানা তথ্য খুঁজে পাব।
এশিয়াটিক সোসাইটি বেশ ক’বছর আগে ঢাকা-উৎসব করেছিল। অনেক বইপুস্তক ছাপা হয়েছে। অনেক সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হয়েছে। বিস্ময়কর এবং মজার ব্যাপার এই যে, একুশে ফেব্রুয়ারি ও অন্যসব রাজনৈতিক আন্দোলনে পুরনো ঢাকাবাসীর যে অবদান রয়েছে সেসব নিয়ে তেমন একটা আলোচনা আমার চোখে পড়েনি। আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। ঢাকা নিয়ে অনেক কাজ হতে পারে, কিন্তু সেসব কে করবে? যারা যোগ্য মানুষ, তাদের এগিয়ে আসতে হবে। তাদেরকে ইতিহাস খুঁড়ে খুঁড়ে হারিয়ে যাওয়া ঘটনা বের করতে হবে।
ঢাকা নিয়ে প্রচুর বই লেখা হয়েছে। এবং এখনও হচ্ছে। কিন্তু সেখানেও ঘাটতি চোখে পড়ে।
বাংলাদেশ এবং একুশে ফেব্রুয়ারি যেমন আলাদা করা যায় না, তেমনি পুরনো ঢাকা এবং একুশে ফেব্রুয়ারিও আলাদা করা যায় না। একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের উৎস। পুরনো ঢাকা ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার এবং উৎস বলে কেউ কেউ বিবেচনা করেন। আমি ইতিহাসবিদ নই, আমি একজন নিবেদিতপ্রাণ ইতিহাস-পাঠক।
খুব ক্ষুদ্র পর্যায়ে হলেও একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে পুরনো ঢাকার প্রতিটি মহল্লা, সরদার এবং পঞ্চায়েতের যে ভূমিকা রয়েছে তা লিপিবদ্ধ হওয়ার অপেক্ষা রাখে। গবেষকরা এ বিষয়টি ভাবতে পারেন। তবে একথাও ঠিক সব সরদার ও সব পঞ্চায়েত যে সঠিক ভূমিকা পালন করেছিল তা কিন্তু নয়। তবে অধিকাংশ সরদার ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলনে এগিয়ে এসেছিলেন, প্রত্যেক্ষভাবে অংশগ্রহণও করেছিলেন, কিন্তু এসব তথ্য লিপিবদ্ধ নেই, কোনো ডকুমেন্টেশন নেই। আমরা যারা প্রত্যক্ষদর্শী, আমাদের অগ্রজ যারা এসব ঘটনা দেখেছেন, তাদের কাছ থেকে জেনে নিয়ে কাউকে না কাউকে লিখতে হবে। কিন্তু এই লেখার কাজটি ব্যক্তি পর্যায়ে হওয়াটা হয়তো বেশ কঠিন। কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোনো ঢাকাপ্রেমিক সহৃদয় ব্যক্তি যদি এগিয়ে আসেন, তাহলে সম্ভব। কেননা গবেষণার কাজটি ব্যয়বহুল।
শীর্ষ সংবাদ: