ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুশান্ত মজুমদার

গল্প ॥ বাক বাহাদুর

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

গল্প ॥ বাক বাহাদুর

পাশ বিল্ডিংয়ের কার্নিশে ধাক্কা খেয়ে ফালি রোদ এসে পড়েছে একপাট খোলা পুব জানালার কাচে। অমন জ্বলজ্বলে আলোর কারণে চোখ ঠিকরে আসে। হাফিজ তাঁর দৃষ্টি রুমের মধ্যে ফিরিয়ে আনে। টেবিল থেকে পেপার ওয়েটটা ডান মুঠোয় নিয়ে নিজের খেয়ালে টিপতে থাকে। হাতের তালু ধীরে ধীরে ঘেমে উঠছে টের পেয়ে নিঃশব্দে পেপার ওয়েটটা সে রেখে দেয়। এবার নজর রাখে মির্যা সুলতানের জেল্লাধরা ফর্সা মুখে। বাপ-দাদার বনেদি বিত্তের জোর না থাকলে এই ফাঁপা মানুষটার এতো দূর আসার কথা না। নিজের মধ্যে খানা-খন্দভর্তি মির্যা সুলতান একটা পাক্ষিক পত্রিকার সম্পাদক, অথচ এর গৌরব করার মতো কোনো বিদ্যা নেই। কাজের উপযোগী জ্ঞানও নেই। না পারে সঠিক এক লাইন লিখতে, না পারে লেখা এডিট করতে। অথচ হাফিজের মতো নিরুপায় ক’জন এর প্রতিষ্ঠার পেছনে মুখ বুজে প-শ্রম দিচ্ছে। সো-ও-ও শুকনো বাতাস ছড়িয়ে মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। এখানে মহামতি সম্পাদক বসেন-এতো শোভিত উজ্জ্বল রুমে এসি থাকা উচিত। ডাট বলো, চেহারায় চেকনাই বলো মির্যা সুলতানের আসানিও আরও বাড়ত। হাফিজ ভাবনা নাকচ করে দেখে, লেখাটা নামিয়ে রেখে একরাশ বিরক্তি টেবিলের ওপর মির্যা সুলতান ছাড়িয়ে দিয়েছেন-‘তোমাদের এই একটা দোষ, লেখার সাবজেক্ট খালি প্যাঁচাও।’ তোমাদের বলে সে হাফিজের জেনারেশনকে হয়তো বুঝিয়েছেন। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, তাঁর আরও কি বলার আছে-‘এতো ডিপে যাওয়ার দরকার কী।’ হাফিজ সোজা হয়ে বসে নিজের মনোভাব অটুট রাখতে চায়-‘আমি তো পরিবহন খাতের দুরবস্থা তথ্যসহ তুলে ধরতে চেয়েছি, এ জন্যই শিরোনাম দিয়েছি-মৃত্যু ফাঁদে এক পা বাড়িয়ে। অমত করা প-িতিভাবে চোয়াল শক্ত করে মির্যা সুলতানÑ‘বুঝলাম, কিন্তু আমাদের রিডাররা তো সিরিয়াস না।’ লেখাটার ওপর কলমের দাগ দেন তিনি-‘এই যে এখানে বড় সমালোচনা করেছ। বাদ দাও। পোলায়েটলি...।’ কথা অসমাপ্ত রেখে এবার সে হাফিজকে সরস স্বরে ভিজিয়ে দিকে চায়Ñ‘তোমার হাত এমনিতেই চমৎকার। আবার লেখো। পারবে তুমি।’ মির্যা সুলতানের ধূর্ত স্বর বেড়ে যাচ্ছে দেখে হালকা একটা রাগ হাফিজের মাথায় মধ্যে বিলি কাটে। টেবিলে পাতা ঢাউস কাচের ওপর ঝুঁকে নিজের মুখের আদল সে দেখতে চায়। কী ব্যাপার, স্বীয় চেহারাই সে যথাযথ খুঁজে পায় না। কেমন বেঁকেচুরে যাচ্ছে। মির্যা সুলতানের মাথার প্রতিফলিত ছায়া গ্লাসের সামনের অংশে পড়ে আয়তনে বাড়ছে দেখে হাফিজ ভেতরে চমকে ওঠে। বিতৃষ্ণ হয়ে নিঃশব্দে টেবিল থেকে লেখাটা তুলে ঢিলা পায়ে সে রুম ছেড়ে আসে। এখন কি করা? মাথায় কোনো কাজ আসছে নাÑফাঁকা ফাঁকা। কিছুক্ষণ পর হাফিজের ডাক এল মির্যা সুলতানের রুম থেকে। লোকটা আবার কোন ছল-অছিলা করে কথা বলবেÑকে জানে! ধুর, আর ভালো লাগে না। নিকুচি করি চাকরির! শিথিল পায়ে রুমে ঢুকতেই ইশারায় হাফিজকে বসতে বলে মির্যা সুলতান কানে ফোন চেপে দূরের কণ্ঠের উদ্দেশে গলা খুলে খুশি নিবেদন করেনÑ‘আরে যাবে যাবে। অফিসের ইমার্জিংম্যানকে পাঠাবো। কী-আমাকে? সময় কই? আরে কী যে বলেন, আচ্ছা, ঠিক আছে আসবো। হ্যাঁ, নেক্সট ইস্যুতেই ছাপা হবে। ঠিক বলেছেন, এই যুগে উইম্যান ফ্রিডম ছাড়া সোসাইটি রান করতে পারে না।’ কথা শেষ হলে খুব আদুরে হাতে রিসিভার নামিয়ে রাখেন মির্যা সুলতান। ভাবখানা, ও প্রান্তের পেলব ছোঁয়া ফোনের মধ্য দিয়ে এসে এখুনি বুঝি তাঁকে জড়িয়ে ধরেছে। এবার হাফিজের জন্য মোলায়েম স্বর তিনি জমা দেন-‘শোনো, সন্ধ্যার মধ্যে গুলশান পাঁচ নম্বরে তোমাকে যেতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতাবাসটা তো চেনো, তাঁর পাশের দোতলা বাড়িটা। নারী সংস্থার একটা প্রোগ্রাম আছে। ছবি পাওয়া যাবে, ও ব্যবস্থা আমি করবো। সভা-সমাবেশ বিভাগের জন্য গোছালো একটা প্রতিবেদন চাই। আমিও থাকবো। তুমি তোমার মতো চলে যেও। ও-কে।’ রোদ হারাতে হারাতে কেন্দ্রীয় নক্ষত্র যখন পশ্চিমে সরছে, আজ দেরী করেই হাফিজ রাস্তার উল্টো পাশের অতি সাধারণ হোটেলে খেয়ে আসে। ইদানীং বাইরে খেলে পর কখনও কখনও গলা-বুকে চিনচিন জ্বলুনি ধরে। বোঝা যাচ্ছে শরীরে ক্ষত ধরছে। নিজের মধ্য থেকে এবার নিজের জন্য নিন্দা উঠে আসেÑতাই যদি বোঝো, ওহে পামর, এই যে লেখা কাঁটছাটের উপলক্ষ ধরে দুই-দুটো সিগারেট কেন ছাই করতে গেলে! এই ভাবনার পেছন ধরে আরও কি ধিক্কার আসতে গিয়ে টুপ করে খসে যায় রুমের মধ্যে কাগজের ফাইল গোছানোর শব্দে।Ñ‘আপনি বলে কই যাইবেন, টাইম আইলে খেয়াল দিতে কইছিলেন।’ অফিসের পিয়ন ছেলেটা টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। হাফিজকে উঠতে হয়। দেয়াল ঘড়ির কাঁটা পাঁচটার কাছাকাছি। মগবাজার পেরিয়ে ভাঙচুর রাস্তায় শায়েস্তা হতে হতে সিএনজিতে বসে হাফিজ দেখে, এফডিসির দিকে বাঁয়ে মোড় নেয়া রাস্তার ফুটপাথে মাঞ্জামারা চেহারায় তসলিম দাঁড়িয়ে। অসময়ে একা তসলিমকে অমন দাঁড়ানো দেখে অবাক হয়ে সে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে। হাফিজকে দেখেই সোল্লাসে এগিয়ে আসে তসলিম-‘আরে দোস্ত, কই যাস?’ ধুর, সে কেন থামতে গেল? মনে মনে বিপদ গোনে হাফিজ। গুলশানের ওদিকে একটা এ্যাসাইনমেন্ট আছে বললে ফ্রি খাওয়া পাওয়ার সম্ভাবনা আছে ভেবে তসলিম তাঁর সঙ্গ নেবে। অতীতে এমন ঘটনাও আছে, পাঁচতারা হোটেলে একটা দৈনিকের আয়োজিত প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তসলিমকে নিয়ে যাওয়ার পর মাতাল হয়ে মানইজ্জত প্রায় পয়মাল করে দিয়েছিল সে। উঁহু, আজকের প্রোগ্রামে মির্যা সুলতানও থাকবে। অফিসের কাজে বন্ধুবান্ধব সঙ্গে থাকলে ব্যাটা ঝাল দেয়া কথা শোনানোর সুযোগ নেবে। রাস্তার আওয়াজ ছাপিয়ে শোনানোর মতো করে হাফিজ তার স্বরে ফুকরে ওঠে-‘বস্ ডেকেছে। যাই।’ বলে, ড্রাইভারকে সে সিএনজি চালাতে বলে। এবার নিজের বোকামির জন্য তাঁর ঠোঁট কামড়াতে ইচ্ছে হয়-সে যাচ্ছে উত্তরে, ওখানে বস্ ডেকেছে মানে, তসলিম কী এতোই নির্বোধ! দুই-দুটো সিগন্যাল বিরতি পেরিয়ে গেলে পর ডানে ঘুরে সামান্য ভেতরে গাছগাছালি ভর্তি ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাড়িটা-উঁচু দেয়াল দিয়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ছোট করে কালোর মধ্যে সোনালি রঙে বাড়িটার নম্বর প্লেট লাগানো। তার পাশে সাদা দোতলা বাড়ি-সামনে ব্যালকনি। সিএনজি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে হাফিজ নিশ্চিত হয় এটাই তাঁর গন্তব্য। মাঝখানে চলাচলের স্পেস রেখে রাস্তায় পার্ক করা গাড়ির পর গাড়ি। দু-পাশের ঝাঁপানো বড় বড় গাছগুলোর তলঅব্দি গাড়ির সারি এসে পড়েছে। তার মানে গাড়িআলাদের উপস্থিতিই এখানে বেশি। কোনো কোনো গাড়ির সিটে ড্রাইভার গা-এলিয়ে বসা। চেপে দাঁড়িয়ে ক’জন গুলতানি মারতে মারতে জোরে হেসে উঠলো। লোহার সাদা রঙের গেটটা সামান্য খোলা। কোনো দারোয়ান দেখা গেল না। আজ হয়তো অবাধ প্রবেশ। ছাঁটাই সবুজ ঘাসের চমৎকার লন। দেয়াল ঘেঁষে বোগেনভেলিয়া। খানিক তফাতে উঁকি দিচ্ছে ফুল আর ফুল যেন খিলখিল হাসছে। ফুল লতাপাতা আলোয় বাহারি হয়ে উঠেছে বাড়ির আভিজাত্য ও যৌবন। মোজাইক করা পরিচ্ছন্ন বারান্দায় হাঁটতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায় হাফিজ। এমন ঝকমকে ফ্রেশ বাতাসের পরিবেশে তাঁর ধুলোমলিন স্যান্ডেলপরা পাজোড়া বেশ বেখাপ্পা। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেই হাফিজের মগজে ঝাঁকি মারে। বুকের কলকব্জা ঘুরে ওঠে। অনেক নারী, আলো-আঁধারিময় ঠা-া হলরুম তাঁদের কলকাকলিতে মুখর। অনুষ্ঠান কি শেষ? চেনা দু’জন রিপোর্টারকে পাওয়া গেল। এক মহিলাকে পাশে রেখে তাঁরা আলাপ করছে। আর একটা দৈনিকের স্টুডিও রিপোর্টারের চোখে চোখ পড়তেই সে হাত তোলে-হেই। মুখ দেখে মনে হলো তাঁর মন বুঝি নিমখুন হয়ে আছে। কানের কাছে মুখ নামিয়ে সে ফিসফিস করে-‘পানিপুনি তো দেখছি না। এসব বোগাস ফাংশনের কোনো মানে আছে?’ একটা পাক্ষিকের স্মার্ট এক প্রতিবেদক কোত্থেকে উড়ে এসে এবার কাছাকাছি হয়-‘ধুর ধুর, গুলশানের পার্টিতে এসে চুমুক না দিতে পারলে লেখা-দেখা বৃথা। যত্তোসব...।’ পানাহারই বুঝি এদের প্রধান চাওয়া। হয়তো ব্যবস্থা থাকতে পারে-লিমিটেড মানুষের জন্য; নারীদের ব্যাপার তো। মন যোগানো বাক্য পেয়ে স্টুডিও রিপোর্টার ঘাড় শ্রাগ করে ব্যাগবন্দী ক্যামেরাটা দোলালোÑ‘মাত্র দুটো স্ন্যাপ নিয়েছি’ বলে, সে অনাগ্রহের সঙ্গে ঠোঁট ঝুলায়। ফ্লোরের চার দেয়ালে শুয়ে আছে অতিশয় ফ্লুরেসেন্ট আলো। এমন শোভন আলোয় ডুবেও হাফিজের মনে ফুরফুরে ভাব আসে না। এই সমাবেশ নিয়ে কি লিখবে সে; আর ইনফরমেশন পাবে কার কাছ থেকে? আয়োজনের উদ্দেশ্য বা কী? বুঝলাম মহিলাদের প্রোগ্রাম; কিন্তু সাবজেক্ট তো কেবল কলকাকলি, গুলতানি, আড্ডা হতে পারে না। হলেও এ-সব নিয়ে লেখার আগ্রহ কখনোই তাঁর হয়নি। সম্পাদকের তাগাদায় লিখতে হলে নিজের নাম সে ব্যবহার করবে না। জোটবাঁধা গল্পগুজবের মধ্যে পাক দিতে দিতে, বিভিন্ন অঙ্গসৌষ্ঠব, রূপ মাধুরী দেখতে দেখতে মির্যা সুলতানকে পাওয়া গেল বারান্দার বাইরে। ছোট ছোট চারাগাছে ভর্তি একফালি নিরিবিলি জায়গায় এক ফুটন্ত যুবতীর সঙ্গে তিনি কথা বলছেন। হাফিজকে দেখে তাঁর মুখের আলো যেন কমে গেল। -‘তুমি তো লেট করে ফেলেছো।’ মির্যা সুলতান এই বুঝি নারীর সামনে সম্পাদকী বাহাদুরি শুরু করলেন। বাধ্য হয়ে হাফিজ তাঁকে মনে করিয়ে দেয়-‘আপনি তো লেখাটা কেটেছেটে নতুন করে লিখতে বলেছেন। কাজ শেষ করে আসতে হলো।’ মির্যা সুলতান প্রসঙ্গ বদলান-‘আলাপ করিয়ে দিই, এ নিশাত জাহান, নারী সংস্থার অর্গানাইজিং সেক্রেটারি। আর নিশাত, এ হচ্ছে হাফিজ রশিদ। আমার পত্রিকার...।’ বলে, ডেজিগনেশনটা তিনি স্থগিত রাখেন। -‘ওমা, এতো ইয়াং আপনি!’ বিস্ময়ে গলে যেতে যেতে নিশাতের গলা সুরেলা হয়ে ওঠে। -‘বয়স্ক ভেবেছিলেন?’ হাফিজ নারীর চাঞ্চল্যের ছোঁয়া যেন টের পায়। -‘ভাববো না?’ এই বয়সেই আপনি কি বুড়ো কথা যে লিখতে পারেন। আপনার লেখা থার্ড ওয়ার্ল্ডের পভার্টির আর্টিকেলটা পড়েছি। উহ্, কী ক্রাইসিস না যাচ্ছে! এতো হাংরি পিপল এ সাবকন্টিনেন্টে, বিলিভ মি, ডিপলি জানতাম না।’ মির্যা সুলতানের গলা সহসা খলবল করে ওঠে-‘রাইট, ডিকটেশনটা কার দেখতে হবে না। লেখাটার ওপর দু’বার হাত দিয়েছি। আরে, উনি মিসেস বদরুদ্দিন না?’ বারান্দার ও মাথায় নজর উড়িয়ে মির্যা সুলতান তাঁর কথার বিষয় বদলানÑ‘যাই ঈদ সংখ্যার জন্য আগাম একটা উপন্যাস চেয়ে রাখি।’ দেখো, সম্পাদকই বানোয়াট বুলি আউড়ে দিব্যি সাধু মানুষের মতো হেঁটে গেলেন। এ-সব মানুষ কী অসাধারণ পটু! ডিকটেশন আর এডিট-এমন ডাহা মিথ্যার জন্য কাল থেকে অফিসমুখো না হওয়াই উচিত। কিন্তু তাঁর কি জীবনধারণে নির্ভরযোগ্য আর কোনো উপায় আছে? কলমপেশা ছাড়া আর কোনো কাজে সে উপযুক্ত না। চিন্তার কাছাকাছি আরেকটি পত্রিকার জব্ না পাওয়া অব্দি এখানেই আপোস তাঁকে করতে হচ্ছে। মেনে নিতে হচ্ছে জাল, শঠ মানুষের কেরামতি। মির্যা সুলতান সামনে থেকে সরে গেলে আকস্মিক এক সন্ত্রস্তভাব চলে আসে। হাফিজ টের পায় এই অযথা ভয়-ব্যাকুলতা ক্রমান্বয়ে নিজের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এমন জাঁক দেখানো আয়োজনে আসলে সে বেমানান। প্রচারসর্বস্ব কোনো অনুষ্ঠান বা উৎসবে গিয়ে হাফিজ বরাবর আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। হয়তো তাঁর মফস্বলী চিন্তা থেকে পুরনো শেঁওলা সরে যায়নি। ধুর, নিকুচি করি বোঝাবুঝি-বোধ-আন্দাজের। এখন, এই নারী উদ্যোগ বিষয়ে লিখতে হলে ইনফরমেশন কই পাবে! অগত্যা, লেখালেখির পুঁজির জন্য নিশাত জাহানের কাছেই জ্ঞাতব্য প্রশ্ন তাঁকে রাখতে হয়-‘আপনাদের এই প্রোগ্রামটা আসলে কী? জাস্ট দু’চার লাইনে যদি বলেন।’ শুনে ঠোঁটের আঠা সরিয়ে নিশাত জাহান যেন প্রস্ফুটিত হন-‘এই যে দেখছেন, জলনীলিকা নামের একটা ক্লাবের সঙ্গে আজ জয়েন্টলি একটা প্রজেক্ট আমরা...।’ মাথা নাড়ে হাফিজ-‘আপনাদের অর্গানাইজেশনের নিশ্চয় কোনো আইডিয়া আছে। মানে, দেশে এই যে এতো নারী নির্যাতন, এর প্রোটেস্টে কোনো প্রোগ্রাম...।’ -‘নো নো, প্রতিবাদের নামে কোনো ন্যুইসেন্স এ্যাকটিভিটিসে আমরা নেই। আমাদের টোটাল লুক, বলতে পারেন, ওই যে, ধুর, আমার আবার ঠিকঠাক বাংলা বলা হয় না। ও হ্যাঁ, সুকুমার চর্চা। গত মাসে এই তো আমরা ফ্লাওয়ার এ্যাকজিবিশন করলাম। আমাদের ব্যানারে চার দিন বুটিকস মেলা হলো।’ নিশাত জাহান আরও কী-সব কথা ছড়ালেও কোনো শব্দই হাফিজের কান গ্রহণ করে না। মনের মধ্য থেকে সাড়া না এলে কথাবার্তা অনর্থক মনে হয়। শুনতেও ইচ্ছা হয় না। হাফিজের বাঁ কাঁধের পাশে জানালা। নিশাত জাহান থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিতে নজর ভেতরের রুমে ছুড়ে দেয় সে। দেখে, কাপ থেকে সম্ভবত চা শোষণ করছে লিপস্টিক মাখা ঠোঁট। এক ইয়াংম্যানের হাতে ক্যামেরা থাকায় তাঁর সামনে দুই তরুণী ঘুর ঘুর করছে। হাফিজ দেখে, কোমরে থাক থাক মেদ, এ মহিলা শরীরে কাপড় পরেছেন নবযুবতী ঢংয়ে। চোখে তাঁর বালিকা দৃষ্টি। পাশের আরেক জনের মুখশ্রীর ওপর হাফিজের নজর পড়ে। যেন কোনো রসালো আলাপ শুনছেন এমন মজার চাপে নিজের ঠোঁট কামড়ে আছেন। নাহ্, একটা নারী সামনে রেখে এভাবে বাক্যশূন্য মূর্তির মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা অস্বস্তির। উপায় হিসেবে হাফিজ কথায় ফেরেÑ‘এরা সবাই, ভেতরে-বাইরে, আপনাদের অর্গানাইজেশনের মেম্বার?’ হাফিজের প্রশ্নে নিশাত জাহান আধখানা হাসে-‘সবাই কই?’ নিজের ভেতরে গোপন গোলাপি আভার ঢাকনা খুলে উজ্জ্বল হতে হতে কণ্ঠে জোয়ার নিয়ে আসে সে-‘প্রেসিডেন্ট আপা দেশে থাকলে তো আরও জমতো। গেদারিং আরও হতো।’ বলে, সভানেত্রীর নিজস্ব বিষয়কে সে আপন করে নেয় -‘প্রেসিডেন্ট আপার বড় ছেলে ইথাকায়, হাজব্যান্ড এখন নিউইয়র্কে। একবার এই স্টেটে, আরেকবার ওই স্টেটে। কী জার্নি না তাঁকে করতে হচ্ছে!’ প্রেসিডেন্ট আপার দরদে এবার শরতসজল হয়ে বা অনুপস্থিত ওই মহিলার দূর জার্নির পেরেশানের কথা ভেবে গুলশানের এই বাসায় কষ্টের উদ্রেকে নিশাত জাহান গলে পড়ে। সহসা ছড়ানো সাদা আলোর ভেতর দিয়ে মধ্য বয়সী সফেদ কারুকার্যময় এক মহিলা প্রায় উড়ে এসে এই বিগলিত করুণাময়ীকে চাঙ্গা করতে নিষ্ঠার সঙ্গে সচেষ্ট হন-‘ও নিশাত, তুমি এখানে? সেই কখন থেকে তোমাকে খুঁজছি। ইস...’ শোনা গেল মহিলার দরদকাতর স্বরঝঙ্কার-‘খাটুনির চাপে তোমার চোখ-মুখ তো শুকিয়ে গেছে। উহুঁ-হুঁ, চলো। কিছু মুখে দাও।’ ফিগারের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে দারুণ সজাগ এই মহীয়সীর ওপর হাফিজ এবার আঁতিপাঁতি ধরনের চাহনি রাখে। মঙ্গলদায়িনীর ভুরু প্লাক করা। এর শরীরের ভেতরে শাঁস হয় তিনি বিলি করে দিয়েছেন, নয় কেউ শুষে নিয়েছে। স্লিভলেস বাউজের বাইরে তাঁর শুকনো ডাঁটা হাত দুটো ঝুলছে। এ-সব প্রোগ্রামে সচরাচর সন্তোষসাধনে ফাস্টফুডই থাকে। এর কিছু মুখে দেয়ার জন্য সৌজন্য করে নিশাত জাহান আহ্বান জানালে হাফিজ সুশীল ভঙ্গিতে তা নাকচ করে দেয়। মির্যা সুলতানকে এখন কোথায় পাবে? এই বাড়িটা স্থূলই বলা যায়, এখানে বড় মানুষদের সমাবেশ, তাও কোথায়, কোন্ রুমে নারীদের কলধ্বনির মধ্যে মানুষটা তৃপ্তি ও খুশিতে বাগ বাগ হয়ে বাক্যালাপে মশগুল কে জানে! হাফিজের চাহনি জোর পায় না। আহ্, কী সুরভি সময়, অনেকটা বিভোর পায়ে এদিক-সেদিক ঘুরে ভেতরের এক রুমে বাক্যবীর সম্পাদককে শেষাবধি পাওয়া গেল। দুই মহিলার সঙ্গে কথা বলতে বলতে পরমসখাভাবে তিনি স্ট্র দিয়ে কোক পান করছেন, না তরল কোক চুষে খাচ্ছেন বোঝা দুষ্কর। একজনকে দেখে মনে হলো গর্বিনী নাচুনি-তার অঙ্গলাবণ্য তরমুজের ভেতরের রঙের মতো। নাকি কসমেটিকের প্রলেপে দেহবর্ণ সাময়িক বদলে নিয়েছেন-কোন্টা! এই জমানায় সবই সম্ভব। আরেকজনের পরনে নীল শাড়ি, নীল ব্লাউজ। চোখের নিচেও নীল পালিশের টান। কাছাকাছি হলে হাফিজের আপাদমস্তকে দৃষ্টি টেনে তিনি এমন রুচি রক্ষার মুখ করে খানিক সরে দাঁড়ালেন যেন এই কালে এসেও তাঁর বর্ণবাদের পক্ষে যাওয়াই সমীচীন। -‘কি, লেখার ইনফরমেশন কালেক্ট কমপ্লিট তোমার?’ প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে মির্যা সুলতান পরামর্শ না বিবেচনা কোন্টা যে জমা রাখলেন হাফিজের বোধে পরিষ্কার হলো না। তাঁর তৈরি করা পুরুষোচিত কণ্ঠে এবার শোনা গেল-‘তুমি তো আবার নীরস প্রোজ। এই রিপোর্টটা অন্তত লিরিক্যাল হয় যেন।’ বলে, জ্ঞানী মানুষের ভঙ্গি নিয়ে মির্যা সুলতান নারীদ্বয়কে শোনানোর জন্য তাঁর কথার মধ্যে ফিরে যান-‘যা বলছিলাম। উইদাউট উইম্যান ইম্যানসিপেশন, নো সোসাইটি পোলারাইজেশন। জেন্ডার ইনইকুয়ালিটি যাবে না। এই যে আমরা ফ্রেন্ড আছে ক’জন। পার্টিতে যাচ্ছে, ক্লাবে যাচ্ছে, এনজয় করছে, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে মিসেসকে দেখা যায় না। হোয়াট দ্য ম্যাটার? স্ত্রী ঘরবন্দী। ভেতরে ভেতরে এরা টু দ্য ফুলেস্ট এক্সটেন্ট সুপারসটিশাস। তাঁদের মাথায় অলওয়েজ পেট্রিঅ্যাক থট।’ মির্যা সুলতানের এই বাগাড়ম্বর, ধুর, অকেজো বিষয় বুঝে হাফিজ ডান হাত তুলে ইঙ্গিত রাখে, মানে সে চলে যাচ্ছে। না বলে গেলে কালই হয়তো তাঁর নাখোশ কণ্ঠ বাজাবে-যাবে, আমাকে বলে যেতে। মানুষটা এমনিতেই চতুর, কথার ফোঁড় দিতেও ওস্তাদÑতোমাকে আমার গাড়িতে লিফট দিতাম। বাসার কাছে নামতে। প্রায় আড়াই বছর হলো, মির্যা সুলতানের অফিসে বুদ্ধি পুড়িয়ে হাফিজ ছাই করছে, কোনোদিনই তাঁকে ভুল করেও গাড়িতে উঠতে বলেনি, সে দেবে লিফট! এই মানুষটার ছলবাক্য বানানোর মেশিনটা সর্বক্ষণ বুঝি চালু থাকে। এক পা দু’পা করে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ও হাফিজ আর পেছনে ফেরে না। বাইরে পার্ক করা গাড়ির সংখ্যা কম। নারী সংস্থার সদস্যা ও আমন্ত্রিতদের অনেকেই হয়তো চলে গেছেন। রোডলাইট জ্বলছে। দু’পাশের বড় বড় গাছের পাতার ফোকর দিয়ে নিচে পড়ে এলোমেলো আলোর ছড়া ফুটে আছে। তবু অন্ধকার এখন প্রধান। আঁধারের প্রেত হাত সবকিছু টেনে নিয়েছে অস্পষ্টতার ভেতর। পরদিন ধীরচিত্তে অফিসে পৌঁছে হাফিজ দেখে, দুই পিয়ন নিজেদের মধ্যে গুলতানি করছে, আর কেউ আসেনি। তাঁরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠে দাঁড়ালে তাঁদের গল্পগুজব চালিয়ে যাওয়ার ইশারা করে সে। এবার স্বীয় অভ্যাসে স্ট্যান্ড থেকে সে দৈনিক কাগজের ফাইলটা নিয়ে বসে। বাসায় কোনো কাগজ সে রাখে না। পাঁচ-পাঁচটা দৈনিক সংবাদপত্র একত্রে অফিসেই তো পড়তে পারছে। ইদানীং কাগজের হেডিং পড়ে সে বেশি। বিষয়ের গুরুত্ব বুঝে কখনও পোস্ট এডিটোরিয়াল, কলাম পড়ে ভাবনা-চিন্তা জমাতে চায়। এমন আগ্রহও ধীরে ধীরে এখন কমে আসছে। তবে খেলার পৃষ্ঠায় ক্রিকেট সে খুটে খুটে পড়ে। রাজনৈতিক খবরাখবর আদৌ ভালো লাগে না-ঘটনা একঘেয়েমিতে ম্লান। আজ পবিত্র একটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দুর্ঘটনার খবর ছাপা হয়েছে। পবিত্র শব্দ ব্যবহারে হাফিজের ভিন্নমত আছে। পবিত্র শব্দটি অনাবশ্যক, কারণ অপবিত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বলো, কি অবস্থান বলো কিছু নেই। এই যে সেনাবাহিনী সম্পর্কে বক্তৃতা-বিবৃতিতে দেশপ্রেমিক শব্দটির এতোই ব্যবহার, কেউ কি জানিয়েছে দেশদ্রোহী সেনাবাহিনী বলে কিছু আছে! অবশ্য দেশপ্রেমের নামে ও জাতির দুর্দিনে নীরব না-থাকার ধুয়া তুলে নিজের দেশ সেনাবাহিনী একাধিকবার দখল করেছে। হঠাৎ রুমে নিস্তব্ধতা ধ্বংস করে মাঝটেবিলে রাখা ল্যান্ড টেলিফোনটা পীড়ন করা শব্দে বেজে ওঠে। অফিসের এই ফোনটা পাশের রুমে স্থানান্তর দরকার। মনোযোগ নষ্ট করে। হাফিজ অনিচ্ছুক হাতে ফোনটা তুলে নেয়। -‘হ্যালো হাফিজ, আমি মির্যা। নিশ্চয় তোমার হাত এখন খালি?’ -‘জ্বি।’ মোলায়েম স্বরের নিচে বিরক্ত চাপা দেয় হাফিজ। -‘শোনো, আমার বাসায় তোমাকে একটু আসতে হবে।’ মির্যা সুলতানের নরম শান্ত কণ্ঠ শুনে মুহূর্তে হাফিজ বুঝে যায়, এখুনি তাঁকে কোনো একটা অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে হবে। সত্যি তাই। ও প্রান্ত থেকে আরেকবার শিষ্টস্বর ভেসে এল-‘আমার লেখাটার জন্য বসতে পারিনি আমি। তোমাকেই লিখতে ... বুঝলে। ডোন্ট মাইন্ড, তুমি রওনা দাও।’ কিছু অনুচ্চ, কিছু ভাঙা বাক্যের মধ্য দিয়ে যা বোঝার হাফিজ তা আন্দাজ করে। ভাল-মন্দের খোঁজ নেয়ার মতো করে হাফিজ জিজ্ঞাসা রাখেÑ‘আপনি আসছেন না আজ?’ মির্যা সুলতানের এবার নিস্তেজ স্বর-‘শরীর ভালো না, রেস্ট নেব।’ টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখতে রাখতে হাফিজ ভাবনার মধ্যে পড়ে যায়-আমার লেখা মানে, মির্যা সুলতানের? কোন্ লেখা? এডিটোরিয়াল? বাইরে এখন ক্ষমাহীন রোদের দাহ। আশ্বিন মাসের প্রায় শেষ, শরতকাল চলছে, অথচ অতিরিক্ত গরম পড়ছে আজকাল। এই গরমের কারণে অসময়ে ডিপ্রেশন হতে পারে। হোক, ঝড়-বৃষ্টির জন্য মানুষ ঠা-া তো পাবে। বাইরের অসহ্য যানজট, বিশৃঙ্খলা দুরবস্থা ও তাপ বুঝে হাফিজ চৌধুরীপাড়ার উদ্দেশে রিকশা ভাড়া করে। মাঝবয়সী গায়ে কাবু রিকশাঅলা অলিগলির মধ্য দিয়ে যাওয়ার শর্টকাট উপায় জানে না, হাফিজকেই সোজা-ডানে-বাঁয়ে বলে দিতে হয়। মনে হলো রিকশাঅলা খানিক খুশি-‘বড় রাস্তাদা গ্যালে জ্যামের গ্যানজামে খবর আছিল। ঠাঁয় সেদ্ধ হইতাম। তয় স্যার-।’ রিকশাঅলা, আরও কি কথা আছে, কিংবা লোকটা বাচাল কিসিমের, মুখ তাঁর চালু রাখতে চায়। -‘স্যার...।’ ফের আওয়াজ করলে হাফিজ স্বরে উষ্মা ঢেলে ধমক দেয়-‘কিসের স্যার? আমি স্যার না, অর্ডিনারিম্যান।’ বলে, হাফিজ নিজের ওপর বিরক্ত হয়-ধুর, রিকশাঅলা অর্ডিনারিম্যান, এই ইংরেজি শব্দটার মানে বোঝে কি? তাঁরও মাথা খারাপ। হবে না কেন? এডিটোরিয়াল লেখে শাহরিয়ার। সে এখন ছুটিতে। ব্যাটা লেখার দায়িত্ব তাঁর ঘাড়ে এখন চাপাতে চাইছে। অত্যন্ত বাঘা ব্যক্তি সেজেছো মির্যা, লেখো না এক প্যারা কেমন পারো! অথচ এই ব্যক্তি একজনের লেখা অসংকোচে নিজের নামে চালিয়ে যাচ্ছেন। আরে, ক’জন সম্পাদক আছেন নিজে লেখেন বা লিখতে পারেন? তাঁর লেখা লেখেন এডিটোরিয়ালের স্টাফ। মির্যা সুলতান যে সচিত্র পাক্ষিকের সম্পাদক তার কতই-বা সার্কুলেশন, প্রকাশিত যে কোন লেখা তাঁর সম্পাদিত বলে অহরহ তিনি দাবি করেন। শুনে খোদ লেখকই লজ্জায় মুখে কুলুপ এঁটে রাখেন। দ্যাখো অবস্থা, মির্যা সুলতানকে এতোই যখন অপছন্দ, এই মানুষটার হামবড়াভাব মিথ্যা দিয়ে মোড়ানো তখন জেনেশুনে তাঁর নামে একটা লেখার বিশদ বিষয় বুঝে নিতে অফিস থেকে দূরে চৌধুরীপাড়ায় তাঁর বাসায় হাফিজ তুমি যাচ্ছো কেন? কথাবার্তা টেলিফোনেই তো সেরে নেওয়া যেত। একেই বলে জীবিকার জন্য আপোস। এতোই যখন দ্বিধাদ্বন্দ্ব, মানসিক অসুবিধা, দাও না ছেড়ে তোমার চাকরিটা। পরিষ্কার সে জানে, মির্যা সুলতান লেখার জন্য যে বসতে পারেননি পুরোপুরি এটা মিছা কথা। আশ্চর্য, নিজের কার্যকলাপের ন্যায্যতা দিতে লোকটা দিব্যি মুখ মুখের মতো ধরে রাখতে পারেন, তাঁর কপটতা, কার্যসিদ্ধির সাধনচাতুর্য কত স্বাভাবিক। চৌধুরীপাড়া পৌঁছে একই রিকশাতেই সে ফিরবে, ওয়েট করার জন্য বাড়তি ভাড়া দেবে, হাফিজের উদ্বেগশূন্য প্রস্তাবে রিকশাঅলা রাজি হয়। সিঁড়ি বেয়ে দোতলা-চওড়া করিডোর, সামান্য বামে গিয়ে নকশা করা দরজা, পাশের কলিংবেল টিপতে গিয়ে হাফিজ হাত নামিয়ে আনে। ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে সহসা নারী কণ্ঠের নিন্দামন্দের রুক্ষ স্বর উড়ে এসেছে-‘কালও তুমি দোজখ ঘেটে এসেছো। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! উনি নাকি সমাজের মান্যিগণ্যি জন। ছিঃ! বড় ছেলেটা কীভাবে ঘুরঘুর করে গন্ধ নিচ্ছিল। নিজে তো নষ্ট ভ- একটা। ছেলেপেলেরাও গোল্লায় যাচ্ছে এই তোমার জন্য।’ -‘হোল্ড ইয়োর টাং।’ পাল্টা শোনা গেল মির্যা সুলতানের চোয়াড়ে খেঁকানি। আর দশটা মেকি বাঙালি সাহেবের মতো সেও বেসামাল ক্রোধে ইংরেজিতে গরম ছড়াচ্ছে। পারলে পোষা বিড়াল-কুকুরও এরা ইংরেজিতে ধমকায়। এবার কানে আসে রুমের সিলিং ভেঙে ফেলার মতো চরম গর্জনের তেজ-‘চোখ রাঙায়ো না। ও-সব পাট্টি-পুট্টিতে কিসব হয় বুঝি না আমি?’ পাল্টা কোন্দলের কণ্ঠ ফুকরে উঠেছে-‘বুঝবে কি? গেছো কখনও?’ জবর দাবি নিয়ে মির্যা সুলতানের মিসেস বুঝি ঘোমটা ফেলে দিয়েছেন-‘হ্যাঁ, যাবো এখন থেকে।’ মির্যা সুলতানের চারু চেহারা তাঁর গলার উপহাসের সঙ্গে বুঝি খুলে এসেছে-‘ইউ, ডোন্ট সিলি টক। মেশার যোগ্যতা আছে তোমার? গেঁয়ো পেতœী কোথাকার। আর তোমাকে সঙ্গে নেব আমি? ইমপসিবল। আমার পজিশন লস করতে?’ হাফিজের জিজ্ঞাসু চোখ দরজার ওপর ঘুরতে থাকে। কোনো ভুল বাসায় এসে পড়েনি তো!
×