ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভাষা আন্দোলন শুধু রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল না

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ভাষা আন্দোলন শুধু রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল না

ফেব্রুয়ারি মাস এলে বাংলাদেশে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও গণমাধ্যম উচ্ছ্বাসে-আবেগে দিশেহারা অবস্থায় পৌঁছায়। অন্যদিকে বইমেলা উপলক্ষে লেখক-প্রকাশকদের নাভিশ্বাস অবস্থা। শিক্ষায়তন, সাংস্কৃতিক-সামাজিক প্রতিষ্ঠানে চলে অনুষ্ঠান ও প্রকাশনা নিয়ে প্রবল ব্যস্ততা। শিক্ষিত ভুবনের সব নজর তখন একদিকে অর্থাৎ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের তৎপরতার দিকে। আর এসব দেখেশুনে মনে হতে পারে যে অনুষ্ঠানের পর অনুষ্ঠানের চাপে মননের চর্চা বোধ হয় সক্রিয় হতে পারছে না। বিশেষ করে ঘটছে না সমাজে একুশের চেতনার প্রভাব, আন্দোলনের চরিত্র বৈশিষ্ট্যের প্রভাব কৈশোর-তারুণ্যে ব্যাপক মাত্রায় দাগ কাটছে না। কাটছে না ভাষিক চেতনার আদর্শিক বিচারে। অবশ্য সে জন্য দরকার একুশের আদর্শিক দিকগুলোর গভীর মূলীয় বিচার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মর্মবস্তু গ্রহণ। সত্যি বলতে কি এদিকটা কিছু পরিমাণে অবহেলিত বিশেষত চর্চার দিক থেকে। এদিককার নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে লেখার সংখ্যাও অপেক্ষাকৃত কম। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে সূচিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু রাষ্ট্রভাষার অধিকার আদায়ের দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, তাতে ছিল ভাষিক জাতীয়তা বোধের একাধিক মাত্রার প্রকাশ। একদিকে যেমন গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোর সামাজিক রূপায়ণ তেমনি অন্যদিকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মাতৃভাষা-রাষ্ট্রভাষার ব্যবহারের নিশ্চয়তা। এক কথায় বলতে গেলে মাতৃভাষা-রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষার ঐক্যবদ্ধ নান্দনিক ব্যবহারিক রূপের প্রকাশ যা নিশ্চিত হবে শিক্ষার সঙ্গে জীবিকার সঙ্গে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে এবং সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে। একটি সত্যিকার ভাষিক জাতিরাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে। একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি তার ভাষিক চেতনাকে রাষ্ট্রিক ও জাতীয় স্তরে পরিস্ফুট ও বিকশিত করে তুলবে। একুশের চেতনা ধৃত এই মর্মবস্তু বায়ান্নোর আন্দোলনে সচেতন ও প্রচ্ছন্ন এ দুই ধারায় উপস্থিত ছিল বলে আমাদের বিশ্বাস। একুশের বিস্ফোরক দিনগুলোতে মিছিলে মিছিলে উচ্চারিত সেøাগানগুলোতে এই চেতনারই প্রকাশ ঘটেছে। উচ্চারিত সেøাগানগুলো ও দাবিগুলোর বিচার-বিশ্লেষণে এমন সত্যেরই প্রকাশ ঘটে। একুশের ইতিহাস হয়ে ওঠে প্রতিবাদী চেতনার, জাতীয় চেতনার ইতিহাস। এ আন্দোলন মূলত ছাত্রযুব শ্রেণী এবং শিক্ষায়তনগুলোকে কেন্দ্র করে সূচিত হলেও এর উত্তাপ ও প্রভাব সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে যায়। অচিরে ছাত্র আন্দোলন গণআন্দোলনে পরিণত হয়। এবং তা শুধু রাজধানী শহর ঢাকাতেই নয়, দেশের সর্বত্র জেলা শহর, মহকুমা শহর থেকে থানা শহর হয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষায়তন অর্থাৎ স্কুল পর্যন্ত। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, কক্সবাজার থেকে দূর উত্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জে স্কুলছাত্রদের সে কী গর্বিত প্রতিবাদী পদচারণা, মিছিল থেকে মিছিলে! পূর্ববঙ্গের গোটা সমাজ বায়ান্নোতে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার টানে কী যে উদ্দীপনা ও সাহসের প্রকাশ ঘটিয়েছিল তা ভাবতে গেলে অবাকই লাগে। বিচার-বিশ্লেষণে তাই মনে হয়। অথচ তখন এটাই স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। প্রতিবাদী এই দৃপ্ত পদচারণার আন্দোলিত প্রকাশ ঘটেছিল দেশের সর্বত্র। এর উৎস ঢাকায় দুটি অসাধারণ ঘটনাকে ঘিরে। প্রথমত, বিশে ফেব্রুয়ারি বিকেলে সরকারী প্রশাসন থেকে ঘোষিত ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা যা জারি করা হয় একমাসের জন্য। কিন্তু সাধারণ ছাত্র সমাজ প্রতিবাদের দৃঢ়প্রত্যয়ে ১৪৪ ধারার শিকল ভেঙ্গেছিল যে জন্য একুশে প্রতিবাদী একুশের আন্দোলনে পরিণত হয়। দ্বিতীয়ত, একুশে ফেব্রুয়ারি দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেল প্রাঙ্গণের জমায়েতে এবং রাস্তায় ফুলার রোডের পাশে বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে ছোট প্রতিবাদী জটলা লক্ষ্য করে পুলিশের গুলিবর্ষণ। ফলে সে দিন রফিক, জব্বার, বরকত প্রমুখের পুলিশের গুলিতে আত্মবিসর্জন তথা শাহাদাত বরণ। এ ঘটনা বিদ্যুতের মতো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ছাত্রজনতার চেতনায় প্রচ- প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটায়। শুধু ঢাকা শহরেই নয় দেশের সর্বত্র ছাত্র আন্দোলন গণআন্দোলনে পরিণত হয়। এবং অবিশ্বাস্য স্বতঃস্ফূর্ততায়। কাউকে বলে দিতে হয়নি চলো, চলো, মিছিলে চলো। এক অদ্ভুত ভাষিক আবেগে প্রতিবাদী চেতনার আগুন ছড়িয়ে পড়ে দেশের সবখানে। এই স্বতঃস্ফূর্ততাই ছিল আন্দোলনের মূল বৈশিষ্ট্য। সেই সঙ্গে ছিল ছাত্রযুব নেতৃত্বের তুলনায় আন্দোলন তৈরিতে ছাত্রযুব সমাজের এক কথায় সাধারণ ছাত্রযুবাদের লৌহদৃঢ় প্রত্যয়। সে দিন তারা রাজনৈতিক নেতাদের মতামত অগ্রাহ্য করেছিল। এবং যথারীতি ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে একুশের দিনটিকে রক্তস্নাত একুশে ফেব্রুয়ারিতে পরিণত করেছিল। একুশ হয়ে ওঠে একদিকে শহীদ দিবস, অন্যদিকে প্রতিবাদের জাতীয় দিবস। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৬ সাল পেরিয়ে শহীদ দিবস পালনের আবেগ-উদ্দীপনা পাকিস্তানী পূর্ববঙ্গে জনচেতনা এতটা গভীরভাবে তাড়িত করে যে তা ক্রমশ স্বাধিকার চেতনাকে রাজনৈতিক তাৎপর্যে সমৃদ্ধ হতে সাহায্য করে। আপাত বিচারে সাংস্কৃতিক আন্দোলন রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের নানা মাত্রিক আন্দোলনে পরিণত হয়। আর সে ধারায় ভাষিক জাতীয়তাবোধ ক্রমশ রাজনৈতিক শক্তিকে পরিণত হয়। একুশের চেতনা এভাবে মাত্র দুই দশকের আন্দোলনের ধারায় যে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চেতনার প্রকাশ ঘটায় তা সচেতন গণজাগরণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার চেতনায় পরিণত হয়। ছয় দফা হয়ে ওঠে এক দফার আন্দোলন। আরোপিত যুদ্ধের টানে জন্ম নেয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। একুশের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমন্বিত যাত্রা একাত্তরের রণাঙ্গনে পৌঁছে একরাশ রক্তের বিনিময়ে যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটায়। যে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক চরিত্রের প্রকাশ ঘটে ভাষিক জাতিরাষ্ট্রে যে রাষ্ট্রের নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
×