ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সংসার চালান ভিক্ষা করে!

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

দুই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সংসার চালান ভিক্ষা করে!

বাবুল সরদার, বাগেরহাট থেকে ॥ মোরেলগঞ্জে দুই মুক্তিযোদ্ধা গরজ উদ্দিন (গয়জ) সরদার ও হাচেন আলী সরদারের সন্তানরা এখন ভিক্ষা ও দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বারইখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ সুতালড়ী গ্রামে পৈত্রিক ভিটে বাড়িতে তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও নেই। বসতবাড়িসহ প্রায় আড়াইশ’ বিঘা জমির সবই অন্যের দখলে। অভিযোগ রয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের পরপরই স্থানীয় রাজাকার আলবদররা মুক্তিযোদ্ধা সৈজদ্দিন সরদার ও সেরাজ উদ্দিন সরদারকে জবাই করে হত্যা করে। এরপর মুক্তিযোদ্ধা হাচেন আলী ও গরজ উদ্দিনকে মারপিট করে বিভিন্ন মামলায় জড়ায়। পরিবারের সদস্যদের ওপরও চালানো হয় পৈশাচিক নির্যাতন। পুড়িয়ে দেয়া হয় বসতঘর। গুরুতর আহত অবস্থায় দেশ স্বাধীনের ৭ দিন পরে হাচেন আলীকে নিয়ে তার ছেলেমেয়েরা ঘষিয়াখালী গ্রামে নানার বাড়ি আশ্রয় নেয়। ১৯৭৬ সালে সেখানেই বিনা চিকিৎসায় মারা যান হাচেন আলী। এখন তার নিঃস্ব ৪ সন্তান সবুরজান বিবি, জলিল সরদার, সূর্যবান বিবি ও খলিল সরদার ওই গ্রামে ভিক্ষা ও দিনমজুরি করছেন। জন্ম সনদ জমা দিতে না পারায় এখনও ভাতা তালিকায় নাম উঠেনি হাচেন আলীর। ২০১০ সালে দায়ের হওয়া একটি যুদ্ধাপরাধ মামলার বাদী হাচেন আলীর মেয়ে সূর্যবান বিবি জানান, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হাচেন আলীর সন্তানরা কালিবাড়ি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে থাকতেন। ’৭৬ সালে পিতা মৃত্যুর এক বছর পর থেকেই তিনি ভিটেবাড়ির সন্ধানে নামেন। কিন্তু তেমন কোন ফল হয়নি। দফায় দফায় শুধু সালিশ-বৈঠক হয়েছে। সর্বশেষ মাঠ জরিপে .৩১ শতক জমি রেকর্ড হয় এই মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নামে। .১৬ শতক জমি আপোষে ছেড়ে দেন যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি দখলদার সত্তার খান। ২০১৪ সালে .১৬ শতক জমি অলিয়ার খানের দখল মুক্ত করেন সূর্যবান বিবি। অলিয়ার খান ওই জমির কোন দলিল দেখাতে পারেনি। যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামিরাই এই দুই মুক্তিযোদ্ধার ভিটেবাড়ি দখল করে তাদের সন্তানদের তাড়িয়ে দিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন সূর্যবান বিবি। হাচেন আলীর চাচা গরজ উদ্দিন সরদার স্বাধীনের প্রায় ১০ বছর পরে ঘষিয়াখালী গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে মারা যান। তার ৮ ছেলেমেয়ের সকলেই এখন ঠিকানাবিহীন। মেয়ে ওরশনারা বেগম (৫৭) ও যমুনা বেগম (৬৫) খুলনার রামনগর ও রহিমনগরে ভিক্ষা করেন। মালতি বেগম (৬২) দিনমজুরি খাটছেন রহিমনগরে। ঢাকায় দিনমজুরি করেন ছেলে লাভলু সরদার (৫৫)। অভাবের তাড়নায় ভারতে কাগজ কুড়িয়ে সংসার করেন মেয়ে মায়া বেগম (৬০) ও মর্জিনা বিবি (৫৮)। দুই মুক্তিযোদ্ধার অসহায় সন্তানরা ও স্থানীয় লোকজন জানান, হাচেন আলী সরদারের ভিটেবাড়ি এখন নাজিম খানের দখলে। ইউনুস হাওলাদারের দখলে গয়জদ্দিন সরদারের ভিটেবাড়ি। তবে তারা কিভাবে এই বাড়িঘর ভোগ দখল করছে তা কারও জানা নেই। এ সম্পর্কে ওই জমির কথিত দখলকারী যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি ২৭২নং ভাষন্ডা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অলিয়ার রহমান খান বলেন, ‘গয়জদ্দিন ও হাচেন আলী তাদের সকল জমি বিক্রি করে গেছেন। জবরদখলের অভিযোগ মিথ্যা।’ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান লাল বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের পরে ওই পরিবার দুটি গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। তাদের জমিজমা কেউ জোরপূর্বক দখল করছে কিনা তা আমার জানা নেই’। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোঃ লিয়াকত আলী খান বলেন, ‘অছিম উদ্দিন সরদারের ছেলে গয়জদ্দিন সরদার ও ছদের উদ্দিন সরদারের ছেলে হাচেন আলী সরদার ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। স্বাধীনতাবিরোধী তথা প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা ওই দুই মুক্তিযোদ্ধার অনেক জমি বেআইনীভাবে ভোগ দখল করছে। প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ছাড়া তা উদ্ধার সম্ভব নয়’। ভাতা তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হাচেন আলীর নাম না ওঠার বিষয়ে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোঃ মঞ্জুরুল হাসান বলেন, ‘যথা সময়ে জন্ম সনদ জমা দিতে না পারায় হাচেন আলীর নাম তালিকায় এখনও উঠেনি। তবে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন’।
×