ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উৎসব উদযাপন ও বাঙালী সংস্কৃতি

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

উৎসব উদযাপন ও বাঙালী সংস্কৃতি

গত কয়েক বছর ধরে পহেলা বৈশাখের মতো ফাল্গুনের প্রথম দিনও উৎসবে উদ্ভাসিত হয় দেশীয় ঘরানায়। রবীন্দ্রনাথের গান নৃত্যনাট্য আবৃত্তিতে মগ্ন বাঙালীর এ উৎসব বাজার অর্থনীতির সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিপরীতে একটু হলেও ভরসা যোগায়। হিন্দী-বাংলা সিরিয়াল, বহুজাতিক পণ্যের বিজ্ঞাপন, গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের গলিঘুঁচির অহর্নিশ তত্ত্বতালাশ, যে সাংস্কৃতিক উপনিবেশ তৈরি করেছে তার দুর্ভেদ্য দেয়াল ভাঙ্গার শক্তিশালী অস্ত্র হতে পারে নিজেদের ঐতিহ্যময় উৎসবের ঘন ঘন উদযাপন। যদিও এসব উৎসবের অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা চলে গেছে বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে। যারা দেশীয় সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন দিক, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, জাতীয় সঙ্গীত ইত্যাদির পণ্যায়ন করে নিজেদের বাণিজ্যের প্রসার ঘটাচ্ছে। একসময় বাঙালী মুসলমান মধ্যবিত্তের ক্ষুদ্র একটি অংশ বিভ্রান্ত ছিল তারা বাঙালী না মসুলমানÑ এ প্রশ্নে। নিজেদের বাঙালী বলে পরিচয় দিতে দ্বিধায় ভুগেছে। বিভ্রান্তির অতলে হারিয়ে হিন্দুদের খাঁটি বাঙালী ভেবেছেন আর নিজেদের তাদের থেকে আলাদা ভেবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন বাঙালী সংস্কৃতি থেকে। ভেবেছেন, ধর্মের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্রের পত্তন তার নাগরিক হিসেবে নিজেদের বাঙালী বলে পরিচয় দেয়া অধর্মের কাজ, তাতে রাষ্ট্রের ভিত্তি নড়বড়ে হবে। ভাবতে পারেননি চর্যাপদ, পদাবলি, মঙ্গলকাব্য বাঙালী হিন্দুর সম্পদ যতখানি ঠিক ততখানি তাদেরও সম্পদ। বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে বাদ দিলে বাঙালীর অস্তিত্বের তল খুঁজে পাওয়া যায় না। বাতিলের কাজটি তারা সযতেœ করতে চেয়েছিলেন। হয়ত সে জন্যই একসময় প্রগতিশীল বলে পরিচিত কবি ফররুখ আহমদ পাকিস্তানের জন্য লড়ে আমূল বদলে গিয়েছিলেন। নিজের সমৃদ্ধ সাহিত্যিক ঐতিহ্য উপেক্ষা করে ভিন দেশী সাহিত্য সংস্কৃতিতে ভরসা করতে চেয়ে রচনা করেছিলেন ‘নৌফেল ও হাতেম।’ ছদ্ম নাম নিয়েছিলেন ‘হায়াত দরাজ খান পাকিস্তানী।’ কিন্তু ভুল পথে পা বাড়িয়ে বিস্মৃতির চোরাবালিতে তলিয়ে গেছেন। আর আরেক বাঙালী মসুলমান সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দেশের সীমার বাইরে থেকেও আজীবন বুকে ধারণ করেছেন নিজের দেশ ও সংস্কৃতিকে। নিজের সৃষ্টিতে অমর হয়ে আছেন। বাঙালী মুসলমানের অগ্রসর অংশের প্রতিনিধি ছিলেন বলেই সমাজের মূল স্রোতের গতি-প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিলেন তীক্ষèচোখে। যে রাষ্ট্রের ভিত নড়বড়ে হবে বলে বাঙালী মুসলমানের কূপম-ূক অংশ নিজেদের বাঙালী পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত ছিল, সে রাষ্ট্রের চারিত্র্য বৈশিষ্ট্য তিনি প্রায় শুরুতেই বুঝেছিলেন। ‘লাল সালু’র মজিদকে তিনি উপস্থাপন করেছেন অনেকটা ওই কূপম-ূক শিকড়হীনদের অবয়বে। শস্যহীন এক এলাকা থেকে সুজলা সুফলা অঞ্চলে এসেছিল মজিদ। যেখান থেকে সে এসেছে সেখানে ‘শস্যের চেয়ে টুপি বেশি।’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়েছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, স্বাধীন দেশে ফেরার আগেই তার মৃত্যু হয়। বেঁচে থাকলে হয়ত স্বাধীন বাংলাদেশের সামাজিক মনস্তত্ত্বে¡র একটি রূপরেখা তার কালোত্তীর্ণ অন্য কোন রচনায় পাওয়া যেত। যেমন পেয়েছি লাল সালুতে। যে পটভূমি সাতচল্লিশ এনেছিল সেখান থেকে জাতীয়তাবাদী চেতনা দানা বাঁধতে বাঁধতে একটি স্যেকুলার রাষ্ট্রের জন্ম অনিবার্য করেছিল, সে রাষ্ট্র মধ্য বয়সের কাছাকাছি পৌঁছলেও টুপি এখনও পিছু ছাড়েনি! ইংরেজী মাধ্যম স্কুল, যেখানে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আরবীও শেখানো হয়, নাগরিক মধ্যবিত্ত মা-বাবা পরম নির্ভরতায় সন্তানের নাম লেখান সে স্কুলে। তৃতীয় ভাষা যদি শিখতেই হয় তবে আরবী কেন? ফ্রেঞ্চ, জার্মান, স্প্যানিশ নয় কেন? তবে কি পুণ্যের লোভ? তা আছে তো নিশ্চয়ই তবে মনে হয় সেটাই সব নয়, এক ধরনের ব্যালান্স করার অক্ষম চেষ্টাই মুখ্য। ইংরেজী মাধ্যম শিক্ষার নানা ধরনের অপপ্রচারে ভীত অভিভাবক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে বয়ে যাওয়ার স্রোতে বাঁধ দিতে আরবীর ছলে ধর্ম শিক্ষাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজেন। সন্তানটি মেয়ে হলে লেভেল থ্রিতে হিজাবে মুড়ে যাবে মাথা ও শরীর। আপাদমস্তক হিজাবে মোড়া শরীরের মনটি কি মুক্ত থাকে? থাকা কি সম্ভব? সম্পন্ন শহুরে মধ্যবিত্তের একাংশের ঝোঁক এখন এদিকেই। আন্তর্জাতিক চেন অর্গানাইজেশনের অঙ্গ এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাঙালীর আত্ম পরিচয়ের শিকড় সন্ধান কোথায় করবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। তবে কি আবারও সেই পরিচয় সঙ্কট? সঙ্কট ঠিক কিসের তা পুরোপুরি স্পষ্ট না হলেও এটুকু বলা যায়, সাতচল্লিশের পরের সঙ্কটটির দেশীয় ভার্সনের নাম ছিল সাম্প্রদায়িকতা। ওতে আচ্ছন্ন হয়ে বাঙালী ‘বাঙালী’ না হয়ে হয়েছিল হিন্দু ও মসুলমান সম্প্রদায়। এখনকার ভার্সন আগের মতো সরল রৈখিক নয়, অনেক বেশি সর্পিল। জটিলতার পরত এত বেশি যে সঠিক শিক্ষা ও যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণী ক্ষমতা না থাকলে সমস্যার শেকড় চিহ্নিত করা কঠিন। মধ্যবিত্ত সব সময়ই দোদুল্যমান। কখন কোন্ দিকে দুলবে অনেক সময় বোঝা যায় না। এই দোদুল্যমানতাকে পুঁজি করে এ অঞ্চলে অনেক বড় বড় নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। মধ্যবিত্তের মধ্যে এখন সাম্প্রদায়িক বিভাজন না থাকলেও চেতনাগত নানা বিভ্রান্তিতে আচ্ছন্ন সে। এই বিভ্রান্তির বিচ্ছিন্ন সুতাগুলোয় ঐক্যের ঝঙ্কার তুলতে সাংস্কৃতিক সূক্ষ্মতাকে লালন করা জরুরী। যদিও অসুস্থ অর্থনীতির দৌরাত্ম্যে বাস করে সাংস্কৃতিক সুস্থতা আশা করা অবান্তর। পহেলা বৈশাখ বা পহেলা বসন্ত নিজস্ব দর্পণে মুখ দেখার ভরসা যোগায় বলেই এ দুইয়ের আবেদন এত বেশি। বৈশাখ কিংবা ফাল্গুনের উদযাপন সামন্ত সমাজে এভাবে হতো না, এখন যেভাবে হচ্ছে। এই শহুরে আয়োজনের পেছনে বাণিজ্যিক কারসাজি রয়েছে ঠিকই তবে সেখানেও নিজস্ব বাণিজ্যের পরিসর অনেক বেড়েছে। বসন্ত উদযাপন, ভালবাসা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারিÑ পর পর এ তিন উৎসবে শুধু ফুল ব্যবসায়ীরাই ব্যবসার টার্গেট করেছেন এবার বিশ কোটি টাকা। পোশাক, এক্সেসরিজ, কসমেটিকস ব্যবসায়ীদের মুনাফার হিসাবও নিতান্ত কম নয়। ঈদ-পুজোয় ভারতীয় পণ্যের ভিড়ে কোণঠাসা হয়ে মারখান দেশী পোশাক উৎপাদন ও বিপণনকারীরা। ফাল্গুন ও বৈশাখে এ থেকে তারা মোটামুটি মুক্ত। অন্য সংস্কৃতির কতটুকু নেব কতটুকু নেব না সে বোধ অর্জনের জন্যও নিজের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থাবান থাকা জরুরী। নিজের শিকড় শক্ত না হলে বিশ্ব নাগরিক হওয়া দূরের কথা সাংস্কৃতিক উদ্বাস্তু হয়ে আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে পথ হাতড়ানোর দুর্ভাগ্য মেনে নিতে হয়। আমরা যেন সে পথে পা না বাড়াই।
×