ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মনোয়ার হোসেন

উগ্রবাদের বিরুদ্ধে সরব ছিল সংস্কৃতি অঙ্গন

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১ জানুয়ারি ২০১৭

উগ্রবাদের বিরুদ্ধে সরব ছিল সংস্কৃতি অঙ্গন

সময়ের স্রোতধারায় পুরনোকে পেরিয়ে হাতছানি দিচ্ছে নববর্ষের নতুন সূর্যোদয়। পেছনের সাফল্যকে সঙ্গী করে ব্যর্থতা মুছে দিয়ে মঙ্গলের প্রত্যাশায় এগিয়ে যাবে ইংরেজী নববর্ষ ২০১৭। প্রশ্ন জাগে, কেমন কেটেছে রাজধানীবাসীর বিদায়ী বছর ২০১৬। ভাল-মন্দ অনেক ঘটনাই ঘটেছে যানজট ও জনজটের এই যান্ত্রিক শহরে। তবে সব নেতিবাচকতাকে ছাপিয়ে ইতিবাচক রূপ পেয়েছে ঢাকার সংস্কৃতি অঙ্গন। উগ্রবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী প্রকাশ্যে জ্বলে উঠেছে রাজধানীর সংস্কৃতি ভুবন। বছরের শুরু থেকেই শহরকেন্দ্রিক সংস্কৃতিচর্চায় ছিল বেগবান গতিধারা। বছরের মাঝামাঝি উগ্রপন্থার আগ্রাসনে হঠাৎ করে যেন ধাক্কা খায় সেই সচলতা। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈগদা ময়দানসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গী হামলার ঘটনায় আকস্মিক স্থবিরতা নেমে আসের শিল্পের ভুবনে। কিন্তু সংস্কৃতির শাণিত শক্তিতে সেই বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। সহজাতভাবেই সংস্কৃতির শুভ চেতনার কাছে পরাজিত হয়েছে অশুভ শক্তির অভিপ্রায়। কণ্ঠশিল্পীর গানের সুরে, বাঁশরিয়ার সুরেলা শব্দধ্বনিতে, বাচিকশিল্পীর কবিতার শিল্পিত উচ্চারণে, লোকগানের সহজিয়া সুরে মজেছে নাগরিক মন। অপতৎপরতাকে পাশ কাটিয়ে শহরে বয়েছে প্রশান্তির সুবাতাস। সংস্কৃতির স্বতঃস্ফূর্ততায় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে প্রকাশিত হয়েছে প্রতিবাদী উচ্চারণ। বছরজুড়ে আর্ট গ্যালারিগুলোয় শোভা পেয়েছে চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবি কিংবা ভাস্করের গড়া ভাস্কর্যসহ বহুমাত্রিক শিল্পকর্ম। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার তিন মঞ্চ ও বেইলি রোডের মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মঞ্চে অসংখ্য নাট্য প্রদর্শনীর পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হয়েছে নাটককেন্দ্রিক বেশকিছু উৎসব। বিগত নবেম্বর মাসে সংস্কৃতিবান শহরবাসী সন্ধ্যা পেরিয়ে সারা রাত জেগে ভোর অবধি ভেসে বেরিয়েছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের সুরসুধায়। পাঁচ রাত ধরে চলা ধ্রুপদী সঙ্গীতের শুদ্ধতায় অবগাহনের জোয়ারে জেগে উঠেছিল শহুরে মানুষের মানবিক বোধ। প-িত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার সুমধুর বাঁশির সুর কিংবা প-িত শিবকুমার শর্মার প্রশান্তিময় সন্তুরের বাদনে মুগ্ধতার ঘোর নিয়ে ঘরে ফিরেছে সংস্কৃতিপ্রেমী শহরবাসী। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবে দেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পীদের পাশাপাশি উপমহাদেশের ওস্তাদ, প-িত, গুরু ও বিদুষীদের নৃত্য-গীত ও যন্ত্রসঙ্গীতের অনবদ্য সব পরিবেশনা ছড়িয়েছে স্নিগ্ধতার আমেজ। এই উৎসব ছাড়াও স্মরণীয় নবেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে আরও একটি আন্তর্জাতিক সঙ্গীত উৎসব। দেশের লোকসঙ্গীতের নবজাগরণের প্রত্যাশায় অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব। বাংলার মমতাজের মায়াবি কণ্ঠে গানের মুগ্ধতার সঙ্গে শ্রোতাদের উচ্ছ্বসিত করেছে ভারতের পাঞ্জাবের দুই বোনের গানের দল নুরান সিস্টার্সের পরিবেশনা। সঙ্গীতের তীর্থভূমিতে পরিণত হওয়া এ শহরে বৈভবময় সংস্কৃতির প্রবাহে হারিয়ে গেলে সাম্প্রদায়িক শক্তির উসকে দেয়া নিরাপত্তাজনিত শঙ্কা। দেশের শিল্পীদের সঙ্গে প্রাচ্য ও পশ্চিমা দেশের নামজাদা শিল্পীরা শঙ্কাহীন চিত্তে অংশ নিয়েছেন এসব সঙ্গীতাসরে। এ মাসেই বৈশ্বিক সাহিত্যের উদ্যাপনে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা লিট ফেস্ট। এ আয়োজনে সাহিত্যপ্রেমী নগরবাসী তুমুল আগ্রহ নিয়ে শুনেছেন নোবেলজয়ী ত্রিনিদাদের সাহিত্যিক ভিএস নাইপলের লেখক হয়ে ওঠার গল্প। এ মাসেই আরেকটি সুখবর বয়ে এনেছে বাঙালীর সার্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখের অন্যতম অনুষঙ্গ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। ৩০ নবেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক এই শোভাযাত্রা পেয়েছে ওয়ার্ল্ড ইনট্যানজিবল হেরিটেজ বা বিশ্ব স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি। মানবতার আহ্বানে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী প্রকাশে সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় নাট্যোৎসব। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেও রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে অনুষ্ঠিত হয়েছে নানা আনুষ্ঠানিকতা। বিজয় দিবস উদ্্যাপনে সঙ্গীতানুষ্ঠান, আবৃত্তিসন্ধ্যা, নাটকের মঞ্চায়ন, চিত্রকর্ম প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র প্রদর্শনীসহ রকমারি অনুষ্ঠানমালায় উদ্দীপ্ত হয়েছে শহর। প্রতিটি পরিবেশনায় স্মরণ করা হয়েছে একাত্তরের শহীদদের। উচ্চারিত হয়েছে বীর বাঙালীর বিজয়গাথা। বিদায়ী বছরে সংস্কৃতি ভুবনে নগরবাসীর অন্তর ও মননে দাগ কেটেছে তেমন কিছু বিশেষ আয়োজন নিয়ে সাজানো হয়েছে এ প্রতিবেদন। যাপিত জীবনে আনন্দের উল্টো পিঠেই বিচরণ করে বেদনা। সেই সূত্রে বছরটিতে আমরা হারিয়েছি কবি, চিত্রশিল্পী. সঙ্গীতজ্ঞসহ সকলের প্রিয় বেশ ক’জন বরেণ্য ব্যক্তিত্বকে। প্রয়াত সেই বরেণ্যজনরাও স্মরিত হয়েছেন এ লেখায়। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব : এদেশের ধ্রুপদী সঙ্গীতের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব। শিল্পীর সংখ্যা ও বিপুুলসংখ্যক শ্রোতার অংশগ্রহণ এবং ব্যাপ্তির বিবেচনায় এটি পরিণত হয়েছে উপমহাদেশ তথা বিশ্বের সর্ববৃহৎ উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবে। বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়ামে পঞ্চরজনীর আসরটির সূচনা হয় ২৪ নবেম্বর। উচ্চাঙ্গের সুর-তাল ও লয়ের মাধুর্যে শ্রোতা-দর্শককে বিমোহিত করা সঙ্গীতাসরটি শেষ হয় ২৮ ডিসেম্বর। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হককে উৎসর্গীকৃত উৎসবটি নাগরিক জীবনের উজ্জীবন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশাল এ সঙ্গীতযজ্ঞে দেশের ১৬৫ জন শিল্পীর সঙ্গে অংশ নিয়েছেন ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের প্রবাদপ্রতিম শিল্পীরা। পঞ্চম আসরে শ্রোতাদের মাঝে সর্বোচ্চ উদ্দীপনা ছড়িয়েছেন বিশ্ববরেণ্য বংশীবাদক প-িত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। উৎসবের সমাপনী দিন ২৮ নবেম্বর ভোর রাতে তাঁর বাঁশির সুরে তোলপাড় হয়েছে হাজার মানুষের অন্তরাত্মা। একই রাতের বিশেষ আকর্ষণ ছিল প-িত শিবকুমার শর্মার সন্তুর বাদন। এছাড়াও উৎসবে ওড়িশি নাচের আশ্রয়ে দর্শককে মুগ্ধ করেছেন বিদুষী মাধবী মুডগাল ও তাঁর শিষ্য আরুশি মুডগাল। খেয়ালের অনবদ্য সুরে শ্রোতাদের আনন্দ দিয়েছেন ড. প্রভা আত্রে ও ওস্তাদ রশীদ খান। রাহুল শর্মার সন্তুর পরিবেশনাটিও ছিল উপভোগ্য। এ ছাড়া ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে উৎসব মাতিয়েছে প-িত রনু মজুমদারের বাঁশি ও ইউ. রাজেশের ম্যান্ডোলিনের যুগলবন্দী পরিবেশনা, সেতারে মিষ্টি সুর ছড়িয়েছেন পূর্বায়ণ চট্টোপাধ্যায় ও প-িত সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়, সরোদের সুরে মুগ্ধ করেছেন প-িত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার, তবলায় যুগলবন্দী পরিবেশনায় শ্রোতার মন ভরিয়েছেন প-িত যোগেশ শামসি ও প-িত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশের শিল্পীদের মধ্যে খেয়াল পরিবেশন করে নজর কেড়েছেন প্রিয়াঙ্কা গোপ, মুনমুন আহমেদ ও তাঁর দলের কত্থক নৃত্য, বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের নবীন শিল্পীদের তবলার বাদন ছড়িয়েছে ভালোলাগার অনুরণন, দলীয় কণ্ঠসঙ্গীতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিল্পীদের পরিবেশনাটি ছিল অনবদ্য। আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব : দেশের লোকসঙ্গীতের নবজাগরণের প্রত্যাশায় নবেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট। শেকড়সন্ধানী সুরের আবাহনে আর্মি স্টেডিয়ামে তিন রাত ধরে চলেছে এ উৎসব। ১০ নবেম্বর সূচনা হয়ে শেষ হয়েছে ১২ নবেম্বর। লোকজ আঙ্গিকের কণ্ঠসঙ্গীতের সঙ্গে যন্ত্রসঙ্গীত ও লোকনৃত্যের উপস্থাপনা উৎসবকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। সান ইভেন্টস আয়োজিত এ উৎসবে এতে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, স্পেন, যুক্তরাজ্য ও কানাডার লোকগানের খ্যাতিমান শিল্পী ও সাধকরা। বাংলার পালাগান, দেহতত্ত্ব-ভাবতত্ত্ব ও কবিগানসহ ভিনদেশী রাষ্ট্রের নানা আঙ্গিকের লোকগানের সহজিয়া সুরে ঝলমল করেছে এ উৎসব। লোকগানের আন্তর্জাতিক এ আয়োজনে শ্রোতা-দর্শককে তুমুলভাবে আলোড়িত করেছেন বাংলার লোকসঙ্গীতের অহংকার মমতাজ ও বারী সিদ্দিকী এবং ভারতের পবন দাস বাউল ও কৈলাশ খের। তবে সবাইকে ছাপিয়ে চড়া কণ্ঠে লোকগান শুনিয়ে শ্রোতাদের মাতোয়ারা করেছেন ভারতের পাঞ্জাবের জ্যোতি নুরান ও সুলতানা নুরানের গানের দল নুরান সিস্টার্স। পাকিস্তানের জাভেদ বশিরের পরিবেশনাতেও আনন্দ পেয়েছে শ্রোতারা। লোকজ সুরের সঙ্গে ফ্লামেঙ্কো নাচের যুথবদ্ধ পরিবেশনায় উৎসবে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে স্পেনের কারেন লুগো ও রিকার্ডো মোরো। এছাড়া দেশের শিল্পীদের মধ্যে বিশেষভাবে নজর কেড়েছেন ইসলাম উদ্দিন কিস্্সাকার, টুনটুন বাউল ও শফি ম-ল। সাহিত্যের উদ্্যাপনে ঢাকা লিট ফেস্ট ॥ সাহিত্যের উদ্্যাপনে নবেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা লিট ফেস্ট। ১৭ থেকে ১৯ নবেম্বর পর্যন্ত তিন দিনের এ উৎসবের ভেন্যু ছিল বাংলা একাডেমি। ৯০টি অধিবেশনে সাজানো তিন দিনের এ আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের বাইরে বিশ্বের ১৭টি দেশের ৬৬ জন খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক, লেখক, গল্পকথক, গবেষক, সাংবাদিক ও প্রকাশক। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন দেশের দেড় শতাধিক দেশের কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পী। আন্তর্জাতিক এ সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন করেন যুক্তরাজ্যে আবাস গড়া নোবেলজয়ী ত্রিনিদাদের কথাসাহিত্যিক ভি এস নাইপল। বাংলা একাডেমির বিশাল আঙিনাকে ঘিরে সেজে উঠেছিল এ উৎসব। তাঁবুতে চলেছে সাহিত্যের আলোচনা, গল্পবলার আসর ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। বিভিন্ন মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে সাহিত্যবিষয়ক বহুমাত্রিক আলাপ। একাডেমির সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত লনে ভেসে বেড়িয়েছে গানের সুর। আবার কোনো মঞ্চে থেকে শ্রোতারা শুনতে পেয়েছে নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরীসহ দেশের খ্যাতিমান ও নবীন কবিদের স্বরচিত কবিতাপাঠ। এছাড়া উৎসবের চারপাশজুড়ে রকমারি বইয়ের সম্ভার নিয়ে ছড়িয়ে ছিল বুক স্টল। সব মিলিয়ে সাহিত্যের আনন্দময় উদ্্যাপনের বারতায় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে শিল্প-সাহিত্যের আলোকময় শক্তিতে জ্বলে উঠেছিল এ উৎসব। মিলনায়তন পরিপূর্ণ শ্রোতার সামনে নিজের লেখক হয়ে ওঠার গল্প শুনিয়েছেন ভিএস নাইপল। হুইলচেয়ারে চড়ে মঞ্চে ওঠা এ সাহিত্যিক বলেছেন, পাগলামি ছাড়া কোনো সৃষ্টিশীল কাজ হয় না। যে কোন কাজের নেপথ্যে থাকে অদ্ভুত এ পাগলামি। শুরুতে আমি জানতাম না, কি লিখব। বুঝতে পারলাম, এজন্য আমাকে কাঠখড় পোড়াতে হবে। আমার কাছে বিষয়টি খুব বিব্রতকর ছিল। লন্ডনের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম। নিজের ব্যাপারে নিজেই বিরক্ত হতাম। এক সময় বিবিসির লন্ডন অফিসের ডার্করুমে বসে টাইপরাইটারে বসে লিখতে শুরু করলাম। অনেক চিন্তাভাবনার একটা কিছু দাঁড়াত। একটা সময় আমি বুকপকেটে নোটবই নিয়ে ঘুরতাম এবং যাদেরকে ভিন্নরকম মনে হতো, তাদের সঙ্গে কথা বলতাম এবং সেগুলো লিখে রাখতাম। সাহিত্যের এ উৎসবে দেশের খ্যাতিমান লেখকদের সঙ্গে শামিল হয়েছেন নানা অঙ্গনের আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সাহিত্যে পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী ভারতীয় বংশোদ্ভূত কবি বিজয় শেষাদ্রী, বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ অনুবাদ ডেবোরাহ স্মিথ, দক্ষিণ আফ্রিকার গল্পকথক ভিউয়েলা মালুলিকি, ভারতের এনডিটিভির প্রধান সম্পাদক সাংবাদিক বারখা দত্ত, ব্রিটিশ সাংবাদিক বেন জুদাহ, মার্কিন কবি জেফরি ইয়াং বেন জোদাহ প্রমুখ। উগ্রপন্থার প্রতিবাদে জাতীয় নাট্যোৎসব : জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী প্রকাশ ও মানবতার আহ্বানে ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে রাজধানীতে শুরু হয় জাতীয় নাট্যোৎসব। ‘এ মাটি নয় জঙ্গীবাদের, এ মাটি মানবতার’ সেøাগানে ১৮ দিনব্যাপী এ নাট্যোৎসবের যৌথ আয়োজক ছিল বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তন, এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হল ও স্টুডিও থিয়েটার হল এবং বাংলাদেশ মহিলা সমিতির ড. নীলিমা ইব্রাহীম মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় বৈচিত্র্যময় বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন নাটক। উৎসবে ঢাকার বাইরের ৮টি বিভাগের ২৬টি এবং শিল্পকলা একাডেমিসহ ঢাকা মহানগরের ৩২টিসহ মোট ৫৮টি নাট্যদলের নাটক মঞ্চস্থ হয়। শিল্পের বৈভবময় দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী : শিল্পের বৈভব ছড়িয়ে ১ তারিখে শুরু হয়ে ডিসেম্বর মাসজুড়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৭তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার ছয়টি গ্যালারির সঙ্গে জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনালয়ে শিল্পকলার এ আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী চলেছে। শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত শিল্পের এ মহাযজ্ঞে উপস্থাপিত হয়েছে দেশ-বিদেশের শিল্পীদের সৃজিত নানা মাধ্যমে আঁকা দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক চিত্রকর্ম থেকে শুরু করে ভাস্কর্য, স্থাপনাশিল্প, আলোকচিত্র, ভিডিও-শিল্পের ও পারফরমিং আটে। বাংলাদেশসহ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৫৪টি দেশের শিল্পীরা আলোকিত করেছেন শিল্পের এই উৎসবকে। অশুভের বিরুদ্ধে সুন্দরের বারতা ছড়িয়েছে এ প্রদর্শনী। বাংলাদেশের ১৪৮ জন শিল্পীর বাছাইকৃত ৫৪টি শিল্পকর্ম ঠাঁই পেয়েছে প্রদর্শনীতে। এছাড়া দেশের খ্যাতিমান ৫৪ জন আমন্ত্রিত চিত্রশিল্পীর ৫৪টি শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। এর বাইরে ছিল ৫৩টি দেশের ১২৭ জন শিল্পীর ২৭৭টি শিল্পকর্ম। অংশগ্রহণকারী দেশগুলো থেকে শিল্পী, শিল্প সমালোচক, মিউজিয়াম কিউরেটরসহ মোট ১৪৬ জন বিদেশী এ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব : ২০১৬ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে ৬৪ জেলা শিল্পকলা একাডেমির অংশগ্রহণে শুরু হয় বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব। আবহমান বাংলার শেকড়ের গভীরে প্রোথিত শিল্প-সংস্কৃতিকে মেলে ধরাই ছিল ১৮ দিনের এ উৎসবের মূল লক্ষ্যে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে একাডেমির নন্দন মঞ্চে প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত অবধি চলমান বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন সারা দেশের চার হাজার শিল্পী। সকল জেলা শিল্পকলা একাডেমির শিশুদল ও বড়দের পরিবেশনায় উপস্থাপিত হয়েছে সমবেত সঙ্গীত, সমবেত নৃত্য, একক সঙ্গীত, আবৃত্তি ও অভিনয়। সেই সঙ্গে ছিল বিভিন্ন জেলার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিশেষ পরিবেশনা। বিদায়ী বরেণ্য ব্যক্তিত্বরা : আনন্দের উল্টো পথে চলা বেদনার অধ্যায়ে বছরটিতে চিরবিদায় নিয়েছেন প্রিয় কবি, চিত্রশিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্রনায়িকাসহ অনেকে। ‘পাহাড়ের কান্না দেখে, তোমরা তাকে ঝরনা বলো’Ñএই অমর গানের সুরকার সঙ্গীতজ্ঞ খোন্দকার নূরুল আলম মারা যান ২২ জানুয়ারি। দেশবরেণ্য এই সুরকার, গায়ক, সঙ্গীত পরিচালক দীর্ঘ সংগীতজীবনে ছয় শতাধিক গানের সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। ভক্তদের কাঁদিয়ে এ বছর বিদায় নিয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী পারভীন সুলতানা দিতি। দীর্ঘদিন রোগভোগের পর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ মার্চ তিনি মারা যান। ৩১ বছরের অভিনয়জীবনে দুই শতাধিক ছবিতে কাজ করেছেন দিতি। সাবেক সচিব, ক্রীড়ালেখক ও সাহিত্যিক রণজিৎ কুমার বিশ^াস ২৩ জুন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অবস্থানকালে অসুস্থ হয়ে পরলোক গমন করেন। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্য কবি কায়সুল হক ১৩ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসাধীন অবস্থ’ায় মারা যান। চিত্রশিল্পী ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা খালিদ মাহমুদ মিঠু ৭ মার্চ অনাহূত এক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। ধানম-ি ৪ নম্বর সড়কে রিকশা করে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশে বৃষ্টিতে ভিজে শিকড় আলগা হয়ে থাকা একটি গাছের চাপায় প্রাণ হারান এই শিল্পী।
×