ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাম্পের জয় ॥ বিভাজিত আমেরিকা

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ১ জানুয়ারি ২০১৭

ট্রাম্পের জয় ॥ বিভাজিত আমেরিকা

২০১৬ সালের সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশেষজ্ঞ মহল ও মিডিয়ার সমস্ত হিসাব নিকাশ, বিচার বিশ্লেষণ ও জরিপের ফলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে দুনিয়াজুড়ে যে আলোড়ন কিংবা আরও সঠিকভাবে বললে শকওয়েভ সৃষ্টি করেছেন তার কম্পন বহুদিন ধরে অনুভূত হতে থাকবে। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের বিপুল ব্যবধানে বিজয় সম্পর্কে সবাই যখন নিশ্চিত ছিলেন তখন ট্রাম্পের এই বিধ্বংসী বিজয় সবাইকে স্তম্ভিত ও স্তব্ধ করে দেয়। রিয়েলস্টেটের ব্যবসায়ী ও ক্যাসিনো মালিক থেকে রিয়েলিটি টিভি স্টার এবং অতপর বিশ্বের একক পরাশক্তি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বনে যাওয়া, এই মানুষটি রাজনীতি করেননি। একটা দিনের জন্যও কোন সরকারী পদ ধারণ করেননি, কখনো কোন ধরনের জনপ্রতিনিধিত্বও করেননি। নির্বাচনী প্রচারে ে পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল একজন অভদ্র, অশিষ্ট, অমার্জিত, স্থূল ও কুরুচিপূর্ণ মানুষ হিসেবে। যিনি শুধু গলাবাজি করে বাজার মাত করতে পারেন অথচ যার মধ্যে সারবস্তু বলে কিছু নেই। প্রাক-নির্বাচন পর্বে উন্মোচিত হয়েছিল ট্রাম্পের যৌনতা বিষয়ক নানা কেলেঙ্কারি এবং তার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল নানা কদর্য উক্তি। আর তা থেকে লোকের ধারণা হয়েছিল ট্রাম্প সভ্যতা-ভব্যতা-শালীনতা সবকিছু ধূলিস্যাত করে দিয়েছেন। রাজনীতিতে তিনি নিয়ে এসেছেন বর্ণবাদ, যৌনতা ও নেটিভ চিন্তাধারা। রাজনীতি না করা ট্রাম্প আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে অজনপ্রিয় এবং রাজনীতিতে ঝানু হিলারি দ্বিতীয় সর্বাধিক অজনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণাগুণের বিচার হিলারির তুলনায় সবদিক দিয়ে পিছিয়ে ছিলেন ট্রাম্প। তারপরও হিলারিকে তিনি শোচনীয়ভাবে হারালেন কিভাবে স্বভাবতই তা নিদারুণ বিস্ময় জাগায়। সেই বিস্ময়ের কারণ সন্ধান করতে গেলে নিচের বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া দরকার। প্রথমত : ট্রাম্পের বিজয় বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বেরই অভিপ্রকাশ। তার বিজয় গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে একটি প্রতিক্রিয়া ও বিদ্রোহ বিশেষ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুনাফা করার অনিবার্য তাগিদ থেকেই এক পর্যায়ে জন্ম নিয়েছে বিশ্বায়ন। অর্র্থাৎ গোটা বিশ্বই একটা গ্রামে পরিণত হয়েছে যেখানে অবাধে সব দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-, ব্যবসা-বাণিজ্য চলবে এবং বাজারের নিয়মেই পণ্য ও সার্ভিসের কেনাকাটা হবে। বিশ্বায়ন শুরু হয় আশির দশকে রিগ্যান আমলে। তারপর গত ২৫ বছরে তা সবকিছু গ্রাস করে নিজেকে আরও পরিপুষ্ট করে তুলেছে। বিশ্বায়নের সুযোগে পুঁজি বা মূলধন অবাধে চলাচল করতে পেরেছে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে গেছে। এতে মুনাফা বেড়েছে পুঁজির মালিকদের। যত বেশি সচলতা তত বেশি মুনাফা এবং তত বেশি সম্পদ সৃষ্টি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সেই সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজিপতির হাতে। বিশ্বায়নের সব থেকে লাভবান হয়েছে সর্বাধিক ধনীরা। তাই দেখা যায় যে বিশ্বের এক শতাংশ ধনীর হাতে বিশ্বের সম্পদের সিংহভাগ গিয়ে জমা হচ্ছে। বাকি সম্পদ বাকি জনগোষ্ঠীর মধ্যে নানাভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকছে। পুঁজির অবাধ চলাচল ও মুক্ত বাণিজ্য থেকে আরও একটা শ্রেণীও লাভবান ও বিকশিত হয়েছে। সেটি হচ্ছে নতুন করে সৃষ্ট এক মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এই শ্রেণী ব্যাপক পরিসরে প্রসারিত হয়েছে। তবে তা ধনী দেশগুলোতে নয়- চীন, ভারতের মতো দেশগুলোতে। আর ধনী দেশগুলোতে যেটা হয়েছে সেটা হলো ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধি, সম্পদের বৈষম্য তথা ধনী-গরিবের ব্যবধান বৃদ্ধি, কারখানা শিল্প বন্ধ হওয়া বা সংখ্যা কমে যাওয়া, বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া, প্রবৃদ্ধিতে মন্থরতা সৃষ্টি। বিশ্বায়নের সুযোগে পশ্চিমী দেশগুলোতে চীন, মেক্সিকোর সস্তা পণ্য বাজার সয়লাব করে দিয়েছে যার ফলে স্থানীয় ভোক্তাদের লাভ হলেও মার খাচ্ছে দেশীয় শিল্প। ধনী দেশগুলোর বিভিন্ন পেশার মানুষের ভবিষ্যত হয়ে উঠেছে অন্ধকার থেকে অন্ধকারতর। ট্রাম্পের উত্থান হলো এই বিশ্বায়নের একটি প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া। তিনি চলমান বিশ্ববাণিজ্যের বিরোধী। তিনি বলেন যে, বিশ্বায়ন আমেরিকার অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তিনি আমেরিকায় আগের গৌরব ফিরিয়ে আনতে চান। তাই তার মুখ থেকে সেøাগান উঠেছে ‘আমেরিকা হ্যাজ টু বি মেড গ্রেট এগেইন’, বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে তিনি উগ্র জাতীয়তাবোধ ও বর্ণবাদকে উস্কে দিয়েছেন, ইমিগ্রেন্টদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল দেয়ার কথা বলেছেন। ট্রাম্পকে বিপুলসংখ্যায় মানুষ ভোট দিয়েছে কারণ তাদের কাছে মনে হয়েছে তিনি এস্টাবলিশমন্টের বিরুদ্ধে কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন যাদের কারণে আজ মার্কিন অর্থনীতির এই হীন অবস্থা। আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গরা হলো জনগোষ্ঠীর প্রায় দুই তৃতীয়াংশ। তারা হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য কোমড় বেঁধে ট্রাম্পের পেছনে সমবেত হয়েছিল যদিও আমেরিকার সেই আগের সুদিন ফিরিয়ে আনা কখনই সম্ভব নয়, এমনকি রক্তপাত, যুদ্ধবিগ্রহ করেও নয়। ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক শ্রেণীর ভোট পেয়েছেন নজিরবিহীন সংখ্যায়। কলেজ শিক্ষিত শ্বেতাঙ্গদেরও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের ভোট পেয়েছেন। বিশ্বায়নের কারণে আর্থিক পরিস্থিতির অবনতি ও চাকরি হারানোর জন্য এরা নিদারুণ ক্ষুব্ধ ছিল। সম্মিলিতভাবে এই শ্বেতাঙ্গরা হয়ে দাঁড়ায় এক পপুলিস্ট শক্তি। এমনকি এই শ্বেতাঙ্গদের যারা ডেমোক্র্যাট সমর্থক ছিল তারাও স্বপক্ষ ত্যাগ করে দলে দলে ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দেয়। দেখা গেছে, ৫৮ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ, ৮ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ও ২৯ শতাংশ হিসপানিক ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে। ট্রাম্প সমর্থকরা মনে করেন যে, তিনি তাদের জীবনে পরিবর্তন আনবেন। সেই পরিবর্তন সামান্য নয় বরং ব্যাপক গভীর ও ঐতিহাসিক। সত্যি সেই পরিবর্তনটা আসবে কিনা নাকি ঠিক উল্টোটাই হবে সেটা নির্ভর করছে আগামী ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হওয়ার পর ট্রাম্প বিভিন্ন ক্ষেত্রে কি কি নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেন তার উপর। ট্রাম্প দায়িত্ব নেয়ার পর ঠিক কি করবেন এখনও তা স্পষ্ট না হলেও যেসব ইঙ্গিত পাওয়া গেছে তাতে মনে হয় সুপ্রীমকোর্টের শূন্য আসনে অপেক্ষাকৃত কম বয়সী রক্ষণশীল বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে তিনি দীর্ঘদিনের জন্য সর্বোচ্চ আদালতে রক্ষণশীল প্রাধান্য কায়েম করবেন। ওবামার বিশুদ্ধ জ্বালানি পরিকল্পনা সমস্যাকবলিত হবে এবং তার ফলে বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন হ্রাস করার উদ্যোগে ভাটা পড়বে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সীমিত করার মার্কিন উদ্যোগ খর্ব হবে। প্যারিসে জলবায়ু চুক্তি দুর্বল হবে। ওবামা কেয়ার বাতিল হওয়ার সম্ভবনা আছে। ট্রাম্প কর্পোরেট ট্যাক্স সংস্কার করবেন। তার ফলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো শত শত কোটি ডলার স্বদেশে ফেরত পাঠাতে পারবে। এতে করে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়বে তবে তার সংস্কারনীতি বিশ্ব অর্থনীতির প্রতি হুমকি সৃষ্টি করবে। তার সংরক্ষণবাদী ও একলা চলো নীতির কারণে আমেরিকা অন্তর্মুখী ও একঘরে হয়ে পড়বে। ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপের অপমৃত্যু ঘটতে পারে। আর ট্রাম্প যদি চীনা পণ্যের উপর ৪৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়ে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করে দেন তাহলে দু’দেশেরই বাণিজ্য মার খাবে এবং বিশ্বব্যাপী আরেক মন্দা শুরু হয়ে যাবে। শোনা যাচ্ছে যে, ট্রাম্পের প্রতিরক্ষা বিষয়ক অগ্রাধীকার তালিকায় ইসলামিক স্টেটকে পরাজিত করার কথা আছে, নতুন সাইবার নিরাপত্তা কৌশল উদ্ভাবনের কথা আছে, কিন্তু রাশিয়া সম্পর্কে কোন কথা নেই। অথচ বেশ কয়েক দশক ধরে মার্কিন কেবিনেট প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা বিভাগ বিপুল পরমাণু অস্ত্র ও অত্যাধুনিক সাইবার সক্ষমতা থাকার কারণে রাশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতি পয়লা নম্বরের হুমকি বলে উল্লেখ করে এসেছিল। এখন ট্রাম্প যদি সত্যিই রাশিয়াকে সেই তালিকা থেকে বাদ দেয়, তাহলে এই ইস্যুতে কংগ্রেসে তাকে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হবে। রাশিয়ার প্রতি অমন মনোভাব নিলে ট্রাম্প ক্রেমনিলকে ইউক্রেনসহ অন্যান্য এলাকার উপর প্রভাব বলয় রাখার সুযোগ দেবেন। রুশবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট সিরিয়ার বাশার সরকারকে সন্ত্রাস দমনের নামে বিরোধী শক্তিকে ইচ্ছামত আঘাত হানার সবুজ সঙ্কেত দেবেন। এ সবই হচ্ছে জল্পনা। আসলে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতি কি হয় সেটা দেখার জন্যই সবার ব্যগ্র দৃষ্টি রয়েছে। নির্বাচনী প্রচারকালীন বিভিন্ন বক্তব্য থেকে পরিষ্কার দাঁড়ায় যে, ইরানের প্রতি ট্রাম্পের নীতি হবে নেতিবাচক। তিনি বহুবার বলেছেন যে ইরান চুক্তি বাতিল করবেন। ওবামা নীতিকে মুছে দেয়াই যদি তার লক্ষ্য হয় তাহলে ওই চুক্তি অবশ্যই বাতিল হবে এবং সেক্ষেত্রে এর পরিণতি হবে বিপর্যয়কর। সংক্ষেপে বলতে গেলে, ২০১৬ সাল ছিল ট্রাম্পের বিজয়ের বছর, আর ২০১৭ সাল হবে তার শাসনের বছর। নির্বাচিত হয়ে তিনি আমেরিকার দীর্ঘদিনের সুপ্রতিষ্ঠিত এস্টাব্লিশমেন্টের গায়ে নিদারুণ আঘাত হেনেছেন, চপেটাঘাত করেছেন এলিট শ্রেণীকে। আর দুনিয়াজুড়ে তুলেছেন কম্পন। তার এই নির্বাচন নিয়ে মার্কিন জনগণ বিভক্ত হয়ে গেছে যা আগে কখনও ঘটেনি। এখন এই বিভাজিত আমেরিকাকে ট্রাম্প কিভাবে চালাবেন সেদিকেই থাকবে সবার দৃষ্টি।
×